চ্যুতি তত্ত্বের এই হল মুশকিল—কীসের থেকে বিচ্যুতি, নর্ম বা আদর্শ কাকে বলব, তার এখনও স্পষ্ট হদিশ হল না। অথচ সাহিত্যের ভাষা যে অন্যান্য কথ্য ভাষা-ব্যবহার থেকে আলাদা, এবং কবিতার ভাষা যে সাহিত্যের গদ্য থেকে সাধারণভাবে আলাদা—এই হিসেবে তো কোনো ভুল নেই। তাহলে কি নর্ম-এর একটা সচল আদর্শ আমাদের ধরে নিতে হবে, একটা আপেক্ষিক আদর্শ ? সাহিত্যিক গদ্যের তুলনা করব কথ্য গদ্যের সঙ্গে, তাহলেই সাহিত্যিক গদ্যের নির্মাণ, ভিত্তি ও কলাকৌশল বেশি ভালো বোঝা যাবে আবার কবিতার ভাষার তুলনা করব সাধারণভাবে গদ্যভাষার সঙ্গে, যার পাশাপাশি কবিতার কৌশল ঠিক ঠিক বিশ্লেষণ করা যাবে ? আবার একটি বিশেষ গ্রন্থের বা রচনার ভাষাশিল্পের তুলনা করব সেই জাতীয় অন্যান্য গ্রন্থ ও রচনার ভাষাকৃতির সঙ্গে—যাতে তার অভিনবত্ব ফুটে ওঠে—যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’-র কাব্যভাষার তুলনা করব তাঁর এ জাতীয় অন্যান্য গ্রন্থের সঙ্গে? শেষ পর্যন্ত কথাটা তাই দাঁড়িয়ে যায়। সেজন্য অনেকে বলেন যে, শৈলীবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য স্টাইল নয় স্টাইলজ, শৈলীর সাধারণ ধারণা নয়, নানা শৈলী। কারণ প্রতিটি রচনাই এক হিসেবে অভিনব (তোদোরভ, ১৯৭১ : ৩১)। ফলে, ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের শৈলীকে বুঝতে হলে আমাদের বহু আদর্শের পটভূমিকা তৈরি করে নিতে হবে—
-
গদ্যভাষা ও কাব্যভাষা।
-
বাংলা কাব্যের ভাষার মূল স্রোত ও ‘মানসী’-র ভাষা।
-
রবীন্দ্রনাথের আগেকার কাব্যগুলির ভাষাশৈলী ও ‘মানসী’-র ভাষাশৈলী।
-
রবীন্দ্রনাথের সাধারণ (পূর্বাপর) কাব্যভাষা ও ‘মানসী’-র কাব্যভাষা। ৫. রবীন্দ্রনাথের অন্য প্রেম-ভিত্তিক কাব্যের ভাষা ও ‘মানসী’-র কাব্যভাষা ইত্যাদি।
অর্থাৎ শৈলীর ক্ষেত্রে আদর্শ বা নর্ম বলতে কিছুই নেই—আমার উদ্দেশ্য অনুযায়ী আমি একটি আদর্শ ধরে নেব এবং তার সঙ্গে তুলনায় আলোচ্য রচনাটির অভিনবত্ব লক্ষ্য করব। কবি বা লেখক যদি সচেতনভাবে বিচ্যুতি (deviate) সৃষ্টি করেন আত্মব্যক্তিত্বের চিহ্ন তৈরির জন্য, যেমন করেছেন বিষ্ণু দে বা কমলকুমার মজুমদার, তাঁদের ক্ষেত্রে তৎকালে প্রচলিত mainstream কাব্য বা গদ্যের আদর্শটিকেই বিচ্যুতি-বিন্দু হিসেবে ধরে নিতে হবে।
কিন্তু শৈলীচিন্তা কি শুধু সাহিত্যের বা কাব্যের ভাষা নিয়ে ব্যতিগ্রস্ত থাকবে? এ নিয়ে আধুনিক শৈলীবিজ্ঞানে দুটি মত তৈরি হয়েছে এবং এদের পথও আলাদা হয়ে গেছে। এ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে যখন রুশ আঙ্গিকবাদীদের আলোচনায় শৈলীবিজ্ঞানের নতুন ভিত্তি নির্মিত হতে থাকে, তখন শৈলীবিজ্ঞান ছিল সাহিত্যতত্ত্ব বা Poetics-এর অংশ। যেমন জিবমুস্কি জানাচ্ছেন (১৯৮৫ : ২৭৯) যে, “Stylistics is poetic linguistics….it considers the facts of general linguistics in their specific esthetic application. পরে লিও স্পিট্সার যখন তাঁর বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক শৈলীতত্ত্ব গড়ে তোলেন, তাতেও তিনি উচ্চাঙ্গ সাহিত্যের শৈলীর কথাই বিশেষভাবে বিবেচনা করেছিলেন।
কিন্তু literary stylistics-এর পাশাপাশি linguistics stylistics-এর একটি ধারাও তৈরি হতে থাকে। জিরমুস্কিই বলেন যে, ‘Practical language has its own devices ( আমরা যে কেজো ভাষা ব্যবহার করি তারও নানা বৈচিত্র্য আছে, কোনো দুটি লোকের ভাষা হুবহু একরকম নয়। আবার বিজ্ঞানের প্রবন্ধের ভাষা, আইনের ভাষা, ধর্মোপদেশের ভাষা, সাংবাদিকতার ভাষা— তারও বহু রকমফের আছে। এই উপলক্ষ্য-নির্ভর ভাষাভঙ্গি বা ভাষারীতিগুলির সাধারণ নাম ইংল্যান্ডের ফার্থ-পন্থী ভাষাবিজ্ঞানীরা দিয়েছেন—রেজিস্টার (register)। বাংলায় আমরা বলি ‘নিরুক্তি’। এখন প্রশ্ন হল, শৈলীবিজ্ঞান কি এই কাজের ভাষাগুলি আলোচনা করবে না? রুশ সমালোচক ও ভাষাবিজ্ঞানী ভিনোগ্রাদ সম্ভবত প্রথম ইঙ্গিত করেন, এ বিষয়ে (দ্র. Khrapchenko, ১৯৭৮ : ৩০৮-৯)। ওয়েলেক আর ওয়ারেনও (১৯৪৯ : ১৭৯) লক্ষ্য করেন যে, স্টাইলিস্টিক্স কথাটির একটি অর্থ সাহিত্য বা কাব্যের ভাষানির্ভর সৌন্দর্যের বিশ্লেষণ, যখন তা aesthetic aims of language অনুসন্ধান করে তখন তা এক ধরনের স্টাইলিস্টিক্স হয়ে ওঠে। তবে শৈলীবিজ্ঞানের বড়ো অর্থই সাহিত্যভাষা ও সাহিত্যের নির্মাণকলার সঙ্গে যুক্ত। রুশ, চেক ও ফরাসি শৈলীতাত্ত্বিকেরা শৈলীবিজ্ঞানের এই অর্থটিকেই মুখ্য অর্থ বলে গণ্য করেন।
অন্যদিকে ইংল্যান্ড ও কিয়দংশে মার্কিন দেশে শৈলীবিজ্ঞান সাহিত্যের ভাষা ছাড়াও অন্যান্য কেজো ভাষার বিচারকে উপেক্ষা করে না। যেমন ক্রিস্টাল ও ডেভি (Crystal and Davy, ১৯৬৯) আলোচনা করেছেন কথাবার্তা, অলিখিত ধারাবিবরণী, ধর্ম, সাংবাদিকতা, আইনের নথি, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির ভাষা। এ দুটি প্রধান বিভাজনের পরিকল্পনা, স্তর, লক্ষ্য ইত্যাদির মধ্যে প্রচুর সূক্ষ্মতা আছে, কিন্তু তার আলোচনা অন্য কোনো উপলক্ষ্যের অপেক্ষায় থাকুক।
Leave a comment