চন্দ্রশেখর উপন্যাসের চতুর্থ খন্ডের নাম ‘প্রায়শ্চিত্য’। এই অংশে শৈবালিনীর নরক দর্শনের চিত্রটি বর্ণিত হয়েছে। এই অংশটি সম্পর্কে জনৈক সমালোচক যথার্থ মন্তব্য করেছিলেন– “শৈবালিনীর নরকদর্শন বর্ণনা এমন শক্তিশালীতার পরিচায়ক যে, পড়িতে পড়িতে শিহরিয়া উঠিতে হয় এবং মেরী কলেরীর ‘Sorrows of the Satan’ এরটি বহুজনাদৃত ও ভীষণ সৌন্দর্য্যপূর্ণ অংশ মনে পড়ে। বঙ্কিম মনুসংহিতা ও পুরাণ হইতে নরকের চিত্র সংগ্রহ করিয়া থাকিবেন।” আবার সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন– “সমস্ত দৃশ্যটির মধ্যে অপরূপ কল্পনা সমৃদ্ধির ও আশ্চর্য কবিজনোচিত অর্ন্তদৃষ্টির (poeticvision) পরিচয় পাই। তাহা গদ্যসাহিত্যে তুলনারহিত। তাহা মিলটন ও দাস্তের সাহিত্যে বর্ণনার সহিত প্রতিযোগিতার স্পর্দ্ধা করিতে পারে। বঙ্কিম এখানে কবির বিশেষ অধিকারী দাবী করিয়া, ঔপন্যাসিকের যে কর্তব্য মন্থর পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্ববিশ্লেষণ, অবিচলিত ধৈর্য্যের সহিত কার্য কারণের শৃঙ্খলা রচনা– তাহা হইতে নিজেকে অব্যাহিত দিয়োছেন; এবং প্রতিভার বিদ্যুৎ শিক্ষার সম্মুখে সমালোচকের চক্ষু ও তাহার বিচারবুদ্ধি পরিচালনা করিতে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংগতির ত্রুটি ধরিতে সংকুচিত হইয়া পড়ে।” এককথায় নরক বর্ণনা বা প্রায়শ্চিত্য অংশটিতে মেলে বঙ্কিমচন্দ্রের সুন্দর প্রতিভার স্পর্শ।
কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে এই নরক দর্শন বর্ণনার কাব্যসৌন্দর্য্য যতই থাকুক না কেন, মূল কাহিনির সঙ্গে এর গভীর সংযোগ আছে কিনা কিংবা শৈবালিনী চরিত্রের স্বাভাবিক বিকাশের সঙ্গে এটি সামঞ্জস্যশীল কিনা তা বিচার্য বিষয়। অধিকাংশ সমালোচক এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন– শৈবালিনীর চরিত্রে এই নরকদর্শন সমস্ত সম্মত। হয়তো প্রথম থেকে শৈবালিনীর হৃদয়াবেশে যে সমাজচেতনা সংগোপনে আশ্রয় করেছিল তার পরিণতির ফল এই নরকদর্শন বর্ণনা। একদিকে সমাজসংস্কার অন্যদিকে মুক্ত ও স্বাধীন প্রণয় তৃষ্ণা উভয়ের দ্বন্দ্ব তার হৃদয়ে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। কাহিনির শেষ দৃশ্যে তা হয়তো অনুরূপ বিকৃত স্বপ্ন দর্শন, নরক ভীতির আকারে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে এ অভিমত অসঙ্গতিতে ভরা, কারণ মূলকাহিনির সূচনা থেকে নরকদর্শনের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত লেখক শৈবালিনীর হৃদয়ে কোথাও অনুরূপ দ্বন্দ্ব চেতনার আভাস দেননি। সমাজ শক্তির প্রতি কোনরূপ আনুগত্যের, আদর্শ অনুসরণ কিংবা ভীতিচেতনা যেভাবেই হোক না কেন, তা শৈবালিনীর চরিত্রে কোনরূপ পরিস্ফুট নয়। তাই যাঁরা শৈবালিনীর নরকদর্শনকে মনস্তত্ব সম্মত রূপে স্বীকৃতি জানিয়েছেন– তা ভিত্তিহীন বলেই মনে হয়।
আসলে শৈবালিনী মানস ব্যাভিচারিণী, কিন্তু তাঁকে প্রত্যক্ষ দ্বিচারিণী বলা চলে না। চন্দ্রশেখর ও প্রতাপকে কেন্দ্র করে শৈবালিনীর হৃদয়ে প্রণয় প্রসঙ্গে কোনোদিন কোনোরূপ দ্বিধা দ্বন্দ্ব সূচিত হয়নি। একমাত্র প্রতাপকে কেন্দ্র করে তাঁর প্রণয়া ভিলাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রতাপ তাঁর প্রণয় নিবেদন প্রত্যাখ্যান করলে তাঁর হৃদয়ে অপরিসীম দুঃখবেদনা সঞ্চারিত হয়েছে, কিন্তু সেখানে তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পাপচেতনার পরিচয়মাত্র প্রকাশিত হয়নি। এমনকি রমানন্দ স্বামী তাঁর ওপর যোগশক্তি প্রয়োগ করলে ও তাঁর চরিত্রের ধাতুগত কোনোরূপ পরিবর্তন সংসাধিত হয়নি। তাই কাহিনির শেষাংশে চন্দ্রশেখরসহ বেদগ্রামে প্রত্যাবর্তন কালে যুদ্ধ অভিযাত্রী প্রতাপকে শৈবালিনী জানিয়েছেন- “আমি সুখি হইব না। তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই – যতদিন তুমি এ পৃথিবীতে থাকিবে, আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করিও না। স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার; কতদিন বশে থাকিবে জানি না। এ জন্মে তুমি আর আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও না।” এ দেখে মনে হয় রমানন্দ স্বামীর যোগশক্তির প্রয়োগ শৈবালিনীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
এই নরকদর্শনের প্রায়শ্চিত্যের সঙ্গে শৈবালিনী চরিত্রের স্বাভাবিক বিকাশের সামঞ্জস্য নেই। এটি তাঁর চরিত্রে বাইরে থেকে আরোপিত, অন্তর্নিহিত নয়। শৈবালিনীর সংস্কার চেতনা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাপবোধ, নরকভীতি ‘কীভাবে মর্মে বিজড়িত মূল’ বঙ্কিমচন্দ্র তার কোনোরূপ পূর্বসূত্রের সন্ধান-পরিচিতি উপন্যাসমধ্যে কোথাও উপস্থিত করেন নি। প্রসঙ্গক্রমে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত মন্তব্য করেছেন– “শৈবালিনীর চিত্তবিকার উপন্যাসের প্রধান বিষয়; তার এরূপ অলৌকিক ও সহজ সমাধান করে বঙ্কিমচন্দ্র শিল্পধর্ম থেকে স্খলিত হয়েছেন। সে প্রায়শ্চিত্য ও পরিবর্তনের কথা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে তা যে শৈবালিনীর চিত্তের স্বাভাবিক পরিণতি এমন মনে হয় না। ….রমানন্দ স্বামীর যোগবল, যাদুবিদ্যা, উপন্যাসে বিশেষ স্থান নেই। রস অলৌকিক, কিন্তু অলৌকিক নয় আর শুধু শৈবালিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বলতে হয় যে যদিও মাঝে মাঝে শৈবালিনীর মনে অনুশোচনা উঁকি দিত, এই প্রায়শ্চিত্য যে তার অনিবার্য পরিণতি উপন্যাস পড়ে এমন কথা মনে হয় না। বরং মনে হয় প্রায়শ্চিত্যের বোঝা বাহির হইতে আসিয়া তাহাকে উৎপীড়িত করিয়াছে। ইহা শুধু অনুপোযোগী নয়, অস্বাভাবিকও।”
প্রতাপ মৃত্যুবরণ করেছেন, কারণ শৈবালিনী তাঁকে জানিয়েছেন, প্রতাপ বেঁচে থাকতে তাঁর সুখ নেই। শৈবালিনীর এই মুক্ত প্রেমের আকাশ চারণের স্বপ্নকল্পনা ও তার রূপায়ণের সম্ভব অসম্ভব বাস্তব প্রয়াস অশ্রুকরণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে– পরিবার জীবনে ঐতিহাসিক অধ্যায়ের এই ঘোর সংকটপর্বে অনুতাপ বিদ্ধ চিত্ত (অবশ্য এই অনুতাপ বেদনার উজ্জ্বল পরিচিতি প্রায়শ্চিত্তে পরবর্তী শৈবালিনীর মধ্যে মেলেনা।) শৈবালিনীর সঙ্গে চন্দ্রশেখরের নির্দ্বন্দ্ব দাম্পত্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে, এটি অকল্পনীয়। এমন ব্যাখ্যায় বিশ্বাস স্থাপন করলে শৈবালিনীর প্রায়শ্চিত্ত বরণ প্রসঙ্গে রসাভাসের ত্রুটি দৃষ্ট হবে। বরং বলা চলে, আদর্শবাদী বঙ্কিম ভারতীয় জীবনদর্শ ও সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত কাব্য-কাহিনির প্রেম অবধারণাকে যেন একদিকে স্বীকার করে নিয়েছেন। আবার অন্যদিকে তেমনি আধুনিক প্রায়শ্চিত্য রীতির জীবনাদর্শ ও সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত কাব্য-নাট্য-উপন্যাস-রোমান্স কাহিনির প্রেম অবধারণাকে অস্বীকার করতে পারেননি। ভারতীয় জীবনাদর্শের প্রেম অবধারণার বৃহত্তর মহত্তর সমাজকল্যাণের সঙ্গে ব্যক্তির প্রণয় তৃথ্বার সংঘাত উপস্থিত হলে একদিকে তিনি যেমন উভয়ের দ্বন্দ্ব সংঘাতের পরিণতিরূপে প্রথমটির জয় ঘোষণা করেছেন, আবার অন্যদিকে তেমনি পাশ্চাত্য জীবনাদর্শের প্রেম-অবধারণায় ব্যক্তিগত প্রণয়তৃষ্ণা ও তাকে শোকাবহ Tragic ব্যঞ্জনা-সমৃদ্ধির রূপচিত্রও অঙ্কন করেছেন– ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে উভয়েরই কাব্যসম্মত অভিব্যক্তি ঘটেছে।
সর্বোপরি, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সমগ্র বঙ্কিম-সাহিত্য পর্যালোচনায় অনুভূ ত হয়, অনেক স্থলেই শিল্পী বঙ্কিম পরাস্থ হয়েছেন নীতিবাদী বঙ্কিমের নিকট। শিল্পসংগতভাবে যা সংঘটিত হওয়া আবশ্যক ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে তা অনেক ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে বিষবৃক্ষ ও কৃষ্ণকান্তের উইলের কথা ধরা যেতে পারে। বিধবাবিবাহকে স্বীকৃতি না জানাতে বিষবৃক্ষে বঙ্কিমচন্দ্র অকারণে কুন্দনন্দিনীকে বিষপানে হত্যা করিয়েছে। কুন্দনন্দিনীর মৃত্যুর জন্য যে কারণ তিনি দর্শেছেন তা যথোপযুক্ত বলেই মনে হয় না। অন্যদিকে ‘কৃষ্মকান্তের উইলে’ গোবিন্দলালকে দিয়ে রোহিনীকে গুলি করে মারা হয়েছে। শরৎচন্দ্রের দৃষ্টিতে যা নীতিবিরুদ্ধ বলে মনে হয়েছে। এবং তা আর্টের অপমৃত্যু মাত্র। আসলে লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে যতখানি না তার শিল্পীমানস মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তার চেয়ে বেশি সজাগ ছিল নীতি ও ঐতিহ্য। তবে মনে রাখতে হবে– সাহিত্যের ক্ষেত্রে নীতি ও ঐতিহ্য কখনোই শিল্পসঙ্গত নয়। চন্দ্রশেখর উপন্যাসে শৈবালিনীর প্রায়শ্চিত্য অংশটি তেমন নীতি ও ঐতিহ্যের দ্বারা পরিচালিত। পাপবোধ যে ভারতীয় সংস্কৃতির একটা অঙ্গ, শৈবালিনীর চিত্তচাঞ্চল্যকে মূর্ত করতে তেমনই ধারা অনুসরণ করেছেন নীতিবাদী বঙ্কিম। আবার শৈবালিনীর নরকদর্শনকে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাতে শিল্পী বঙ্কিমের সদস্ত পদচারণা অনুভূত হয়। কাজেই স্বীকার করতে দ্বিধা নেই উপন্যাসমধ্যে শৈবালিনীর প্রায়শ্চিত্য অংশটি যেমন নীতিবাদী বঙ্কিমের ভাবনাজাল, তেমনি শিল্পী বঙ্কিমের চেতনাপ্রসূত।
Leave a comment