মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা জাতীয় জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেই আলোচনা লেখক ‘শিক্ষা ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করেছেন। অবশেষে, শিক্ষার উদ্দেশ্য কী সে সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন। শিক্ষা জাতিগঠনের শ্রেষ্ঠ উপায়। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু কোনো বিদেশি ভাষার মাধ্যমে এই শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে না। এদেশে ব্রিটিশ শাসনের কাল থেকে ইংরেজি ভাষার প্রচলন হল, সাধারণ মানুষ পরাধীনতার মূল্য হিসেবে এই ভাষা গ্রহণ করল। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে মেকলের শিক্ষাপদ্ধতি এদেশে চালু হয়। পরাধীন দেশের মানুষ এক উন্নত দেশের সমৃদ্ধ ভাষার প্রতি মোহে আকৃষ্ট হয়ে তাতে মগ্ন হয়ে রইল। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা দেশের শিক্ষা ও চর্চার ক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠল। তার ফল এদেশে যে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত হল, তা শিক্ষার অসম্পূর্ণতা দিনে দিনে বাড়িয়ে চলল। শিক্ষার্থী শিক্ষণীয় বিষয়ের ভিতরে অনুপ্রবেশ করতে পারল না। ফলে তার বিষয়জ্ঞান অগভীর ও ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেল। তার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষায় বছরের পর বছর ধরে যে ফলাফল বেরোল, তাতে ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত রীতিমতো বিস্মিত করে। এই প্রচণ্ড অপচয় জাতীয় জীবনের প্রধান অপচয়। লেখক তাই এই অপচয় নিবারণের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ ব্যাপারে লেখকের জাপান-অভিজ্ঞতাও কার্যকরী হয়েছিল। জাপানে গিয়ে লেখক দেখেছেন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবিদরা কীভাবে মাতৃভাষায় গবেষণার কাজ চালিয়ে যায়। সেখানে তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকরা নিজেদের মধ্যে বিজ্ঞানের আলোচনা করেন মাতৃভাষায়। জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার আধুনিকতম দিকও পড়ানো হচ্ছে জাপানি ভাষায়, পাশাপাশি জাপানি ছাত্ররা জ্ঞানের ক্ষেত্রে বহু দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এই সব ঘটনা লেখকের চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। ক্রমে ক্রমে লেখক অনুভব করেছেন যে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কত যথার্থ। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ফলে দেশে শিক্ষার্থীরা কীভাবে জটিল ও বিমূর্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। বড়ো বড়ো আলোচনাচক্রে গবেষকরা দোভাষীর মাধ্যমে আলোচনাকে সহ-সদস্যদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। এ-সব ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার অভাবে তাদের চিন্তা চর্চায় কোনো ক্ষতি হয় না। জাপানের অগ্রগতি সারা পৃথিবীতে বিস্ময় ও প্রশংসার দাবি করেছে তাই টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিভাগ আয়োজিত আলোচনাসভায় যোগদানে তিনি দ্বিধা করেননি। জাপানের এই অগ্রগতির মূলে আছে জাপানিভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করে তোলার পদ্ধতিতে। অভিজ্ঞতার এই সূত্রকে লেখক গ্রহণ করেছেন। লেখক তাই দেশে ফিরে এসে প্রস্তাব করেছেন যে এদেশে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হবে, যার বিশেষ ঝোঁক থাকবে বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের ওপরে এবং সেটা চালানো হবে কোনো ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে। লেখকের মতে “আমার বিশেষ আশা যে, একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সভাপতিত্বে মঞ্জুরি কমিশন এই প্রস্তাবটির প্রতি সদয় হবেন ও একে পূর্ণ সমর্থন জানাবেন।” লেখকের এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে প্রবন্ধটির সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে।

লেখক যে মানবতাবাদী দার্শনিক সেই পরিচয় এই ধরনের মন্তব্যে প্রোজ্জ্বল। প্রবন্ধের শেষে লেখক বার বার বলেছেন জাতীয় পতাকাকে জীবনের সবক্ষেত্রে সমুচ্চ করার আদর্শ যদি শিক্ষাব্রতীর থাকে তবেই এদেশে শিক্ষা সার্থক হবে। এখানে চাই সম্মিলিত চেষ্টা। ছোটোখাটো ভুল বোঝাবুঝি ও বিরোধ-ঈর্ষা মানুষকে কলুষিত করে, মানুষকে ক্ষুদ্র করে। লেখক আশা করেন, এই ক্ষুদ্র সংকীর্ণতার বেড়াজাল থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক একদিন মুক্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র বিদ্যার্জন, গবেষণা নয়। সন্দেহ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক স্তরের বিদ্যাচর্চা হয়। সেখানে মানুষ জ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত। কিন্তু তবুও এর মধ্যে পূর্ণতা নেই—“কেবলমাত্র বিদ্যা অর্জন ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে সহায়তা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ হতে পারে না।” তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ কী? বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ মানুষকে তার সার্বভৌমরূপে প্রতিষ্ঠিত করা। জাতি, ধর্ম, মতবাদ, ধনী, দরিদ্র এবং সামাজিক ও বংশমর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ যে মূলত এক, এই শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রচার করতে হবে। এই মানবতাবাদী আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। মানুষকে কোনো গভীর মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না। মানুষ স্বাধীন, মুক্ত ও বিশ্বতোমুখ। রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম’-তে এই মানববাদী দর্শনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই বৃহৎ মানুষ, মহৎ মানুষ সৃষ্টিই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত। শিক্ষার উচ্চতম উদ্দেশ্য মানুষের স্বীকৃতি। মানুষের এই মানবিক মূল্যে শিক্ষা মূল্যবান হয়ে উঠলেই তবেই জাতীয় অগ্রগতি, জাতীয় প্রগতি। জাতীয় পতাকার পবিত্রতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয় যদি মানুষ গড়ার চেষ্টায় ব্রতী হয়, তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ সার্থক হয়ে উঠবে। মানববিদ্যার মূল কথা মানবসত্য। “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”—মানববিদ্যার এই বাণী দিকে দিকে উদ্ভাসিত হোক, মানুষই যে সব চর্চার শেষ কথা সেই বোধ যেন দিকে দিকে বিচ্ছুরিত হয়। এই উক্তির মধ্যে লেখকের গভীর মানবতাবাদী প্রত্যয় ফুটে উঠেছে। লেখক কেবলমাত্র বিশ্রুতকীৰ্ত্তি মহৎ বৈজ্ঞানিক নন, লেখক একজন মহৎ মানবতাবাদী। তাই মানুষের মহিমাকে তিনি জাগ্রত করেছেন এমনই এক স্বর্গে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’/জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/আপন প্রাঙ্গণ তলে দিবস শবরী/বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি।”—এই কল্পস্বর্গে মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ হওয়া উচিত। মানবসৃষ্টির এইসব ক্ষেত্রে শিক্ষক হবেন ঋষি, ছাত্র হবে ঋত্বিক।