(প্রত্যেক তাৎপর্য আগে কে, কাকে, কোন প্রসঙ্গে, কখন বলেছে তা যুক্ত করে নিতে হবে)
১। ‘ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী”।
রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’য় অমিত রায় তার বন্ধুদের বলেছিল। তার মতে যারা সাহিত্যের ওমরাহ দলের যারা নিজের মনে রেখে চলে। অর্থাৎ যারা নিজের কিছু লেখার উপর তাদের নিজত্বটাকে প্রকাশ করতে চায় তাদের বলে স্টাইলিমটিক। এই স্টাইলিমটিক তাদের নিজস্বতাকে এক কৌশল ও বিশেষ ভঙ্গিমায় প্রকাশ করে সেটি হল তাদের স্টাইল। আর যারা আমলাদলের, দশের মন রাখা যাদের ব্যবসা, অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের সেই রকম করে তুলতে চায়, অনুকরণ করতে চায় সেটিই হল ফ্যাশান।
২। শুভ দৃষ্টিকালে বধূর মুখ দেখবার বেলায় বেনারসি ওড়নার ঘোমটা চাই।
রবীন্দ্রনাথ স্টাইল ও ফ্যাশান সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিভিন্ন লেখকের স্টাইল ও ফ্যাশান এনে হাজির করেছেন। যেমন বঙ্কিমের লেখা ‘বিষবৃক্ষে’, বঙ্কিম তাতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন, বঙ্কিমি ফ্যাশান নসিরামের লেখা—’মনোমোহনের মোহন বাগানে নসিরাম তাতে বঙ্গিমকে দিয়েছে মাটি করে। বারোয়ারী তাঁবুর কানাতের নীচে ব্যবসাদার নাচওয়ালীর দর্শন মেলে, কিন্তু শুভদৃষ্টির সময় তো আর তেমনটি করলে চলবে না, সেখানে এক নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া, তাই বধূর মুখ দেখার জন্য নাচওয়ালীদের মতো ওড়না ব্যবহার না করে নতুন বেনারসি ওড়না ব্যবহার করার কথা বলেছেন লেখক।
৩। দক্ষযজ্ঞের গল্পে এই কথাটির পৌরাণিক ব্যাখ্যা মেলে।
ঔপনাসিক রবীন্দ্রনাথ অমিতের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন যে ফ্যাশানটা হল মুখোশ, যা মানব সমাজের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মুখটা সমাজের অনুকরণ করে মুখোশের আড়ালে রেখে দেয়। আর স্টাইলটা হল মুখশ্রী যা মানুষের নিজস্ব সম্পদ, এখানে কারোর অনুকরণ করা যায় না। কেবল নিজস্বতা প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে।
ইন্দ্রবরুণ একেবারে স্বর্গের ফ্যাশান দুরস্ত দেবতা নাস্তিক মহলে তাঁদের নিমন্ত্রণ ও জুটত। শিবের ছিল স্টাইল যা তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ, এত ওরিজিনাল যে মন্ত্র পড়া যজমানেরা তাঁকে হব্যকব্য দেওয়াটা বেদন্তর বলে জানত। এই সমস্ত দেবতাদের এক একজনের এক এক রকম ফ্যাশান বা স্টাইল থাকত।
৪। স্ত্রীলোকের আশ্চর্য স্বাভাবিক বুদ্ধি!
অমিত ছিল স্ত্রীলোকটির সহোদরা, অমিত সব সময় কেবলই ছোটো লেখককে বড়ো করে, বড়ো লেখককে খাটো করে দেখে। সেই জন্যই অবজ্ঞায় ঢাক পিটোবার কাজে তার শখ, তাই সে অনেকের করে রেখেছে ঢাক পেটাবার কাঠি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই আলোচনার সময় ওই স্ত্রী লোকটি উপস্থিত ছিল সে কিছুতেই তার সহোদরার কথা বিশ্বাস করে না। তার বকবকানি অশান্তি লাগে, অমিতের সঙ্গে তার রুচির মিল থাকলে ও অমিতের বকবকানি তার ভালো লাগে না।
৫। যেন স্পেশাল ট্রেনের সেলুন কামরা-
স্পেশাল ট্রেনে যাত্রীদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের ব্যবস্থা থাকে বিশেষ বিশেষ কামরায়। স্পেশাল ট্রেনে সেলুন কামরা থাকায় সেখানে বোঝানো হয়েছে যে, মানুষের সমস্ত খুটিনাটিও ফ্যাশন বা স্টাইলের ব্যবস্থাও রয়েছে। যাদের বলা যেতে পারে বহু বাজারে চলতি লেখক, বড়োবাজারের ছাপা মারা, প্রশংসা করার জন্য যাদের লেখা পড়ে দেখবার দরকার হয়না, চোখ বুজেই গুনগান করলেই পাসমার্ক পাওয়া যায়। অমিতের পক্ষেও এদের লেখা পড়ে দেখা অনাবশ্যক, চোখ বুজে নিন্দে করতে ওর বাধে না। আসলে যারা নামাজাদ। তারা ওর কাছে বড়ো বেশি সরকারি বলে মনে হয়, বর্ধমানের ওয়েটিংরুমের মতো আর যাদেরকে ও নিজে আবিষ্কার করেছে তাদের উপর ওর খাস দখল, সেইজন্য লেখক এখানে স্পেশাল ট্রেনের সেলুন কামরায় সঙ্গে তাদের তুলনা করেছেন।
৬। যাদের ডাকনাম সিসি এবং লিসি, যেন নতুন বাজারে অত্যন্ত হালের আমদানি-
ফ্যাশানের পসরায় আপদমস্তক যত্নে মোড়ক করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট বিশেষ। উঁচু খুর ওয়ালা জুতো, লেসওয়ালা বুক কাটা জ্যাকেটের ফাঁকে প্রবাল্যে অ্যাম্বরে মেশানো মালা, শাড়িটা গায়ে তির্যভঙ্গিতে আঁট করে ল্যাপটানো। এরা খুট খুট করে দ্রুত লয়ে চলে ; উচ্চৈঃস্বরে বলে ; স্তরে স্তরে তোলে সূক্ষ্মাগ্র হাসি মুখ ঈষৎ বেঁকিয়ে স্মিতহাস্যে উঁচু কটাক্ষে চায়, জানে কাকে বলে ভাবগর্ভ চাউনি ; গোলাপি রেশমের পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুরফুর করে সঞ্চালন R করে, এবং পুরুষ বন্ধুর চৌকির হাতার উপর বসে সেই পাখার আঘাতে তাদের কৃত্রিম স্পর্ধার প্রতি কৃত্রিম তর্জন প্রকাশ করে থাকে।
৭। “গঙ্গার ওপারে ওই নতুন চাঁদ, আর এপারে তুমি আর আমি, এমন সমাবেশটি অনন্তকালের মধ্যে কোনো দিনই আর হবে না।”
অমিতের সঙ্গে সেদিন পিকনিকে গঙ্গার ধারে যখন ওপারের ঘন কালো পুঞ্জীভুত স্তদ্ধতার উপরে চাঁদ উঠল, ওর পাশে ছিল লিলি গাঙ্গুলী। তাকেও মৃদুম্বরে ওই উক্তিটি করেছিল। প্রথমটা লিলি গাঙ্গুলির মন একেবারে মুহূর্তের মধ্যে উতলা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা জানত এই কথাটা যতখানি সত্য সে কেবল ওই বলার কায়দা টুকুর মধ্যে। প্রেমিক প্রেমিকা যখন কোনও এক সুদূর গঙ্গার তীরে নতুন চাঁদের আলোয় বসে থাকে তখন যে তাদের কী আনন্দ ও তৃপ্তি ঘটে তা বলে বোঝানো যায় না। সেই জন্যই ওই কথাটি লেখক অমিতের মুখ দিয়ে বলেছিলেন।
৮। “পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু করবে। দুর্বলের আধিপত্য অতি ভয়ংকর”।
একদা মেয়েদের পরে পুরুষের আধিপত্যের অত্যাচার নিয়ে কোনো সমাজ হিতৈষী অবলাবান্ধব নিন্দা করেছিল। পুরুষদের অমিত মুখ থেকে সিগারেটটা নামিয়ে ফস করে ওই কথাটি বলেছিল। দুর্বল ব্যক্তির যদি কোনও আধিপত্য থাকে তাহলে সেই আধিপত্য সহজে টিকিয়ে রাখতে পারে না। টিকিয়ে রাখতে গেলে বিষয় সংকটজনক ব্যাপারও ঘটে যায়। সেইজন্য এখানে বলেছে যে দুর্বলের আধিপত্য অতি ভয়ংকর।
৯। “সাহিত্য থেকে লয়ালটি উঠিয়ে দিতে চান?”
এই প্রশ্নটি মণিভূষণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে একেবারেই। এখান থেকে কবি প্রেসিডেন্টের দ্রুত নিঃশেষিত যুগ। রবি ঠাকুর সম্বন্ধে তার দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল যে তাঁর সাহিত্য ও রচনা রেখা তারই অক্ষরের মতো গোল বা তরঙ্গ রেখার মতন, গোলাপ বা নারীর মুখ বা চাঁদের ধরনে ছিল রবি ঠাকুরের রচনা ও সাহিত্য। তাঁর ছিল প্রকৃতির হাতের অক্ষর মকশো করা। নতুন প্রেসিডেন্টের কাছে কড়ালাইনের ও খাড়া লাইনের, কিংবা বর্শার ফলার মতো। ইত্যাদি রকমের সাহিত্য রচনা করেন তিনি। সেইজন্য মণি ভূষণ ওই প্রশ্নটি করেছিলেন।
১০। “আজকের দিনে এই যে প্রশ্নের অঙ্কুর মাত্র, আগামী দিনে এর থেকে উত্তরে কম্পতি জেগে উঠবে।”
অনেকে হয়তো সামান্য ক্ষুদ্র জিনিসকে বা সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুচ্ছ বলে মনে করে। কিন্তু প্রাকৃতির নিয়ম অনুসারে কোনও বীজ যদি মাটিতে পোঁতা হয় তা অঙ্কুর বের হয়। সেই অঙ্কুরের মধ্যে থাকে ভবিষ্যৎ জীবনের অনন্ত ঐশ্বর্য্য যা বহু যত্নে ও বহু কষ্টে একটু একটু করে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। কিছু দিন পর তারা আবার বৃহতের সঙ্গে মিশে যায়। অর্থাৎ বনম্পতির সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। তখন সেই অঙ্কুর পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।
১১। “আমার মনটা আয়না, নিজের বাঁধা মতগুলো দিয়েই চিরদিনের মতো যদি তাকে আগাগোড়া লেপে রেখে দিতুম তাহলে তার উপরে চলতি মুহূর্তের প্রতিবিম্ব পড়ত না।”
অমিত সিসিকে এই উক্তিটি করেছিল, তার মতে সম্ভবপরের জন্যে সব সময়েই প্রস্তুত থাকাই সভ্যতার বিবর্তন। বর্বরতা পৃথিবীতে সকল বিষয় অপ্রস্তুত। তাকে প্রস্তুত করে নিতে হয়। তাই তার মনটা যেন আয়নার মতো, তার নিজের মতগুলো চিরদিন ধরে তাকে আগা গোড়া লেপে রেখে দিলে তার উপরে তাহলে চলতি মুহূর্তের প্রতিবিম্ব পড়ত না। সেই প্রতিবিম্ব নিয়েই যেন অমিতের দিন কাটে।
১২। ‘এ যেন অম্বুরি তামাকের হালকা ধোঁওয়া, জলের ভিতর দিয়ে পাক খেয়ে আসছে—নিকোটিনের ঝাঁঝ নেই, আছে গোলাপ জলের স্নিগ্ধ গন্ধ।
গাড়িতে অমিতের সঙ্গে যে মেয়েটির আলাপ হয়েছিল তার সম্পর্কে কথাটি বলা হয়েছে। মেয়েটির কণ্ঠস্বর অমিতের বড়ো ভালো লাগে, উৎসজলের যে উচ্ছলতা ফুলে ওঠে, মেয়েটির কণ্ঠস্বরটি তারই মতো নিটোল। অল্প বয়সের বালকের গলার মতো মসৃণ এবং প্রশস্ত। সেদিন ঘরে ফিরে এসে অমিত অনেকক্ষণ ভেবেছিল, এর গলার সুরে যে একটি স্বাদ আছে স্পর্শ আছে, তাকে বর্ণনা করতে গিয়ে অমিত এই কথাটি বলেছে।
১৩। “পথ আজ হঠাৎ এ কী পাগলামী করলে।”
অমিত বাড়ী ফিরে এসে মেয়েটির স্মৃতি আর ভুলতে পারছে না। ফলে সে নোট বই নিয়ে লিখতে বসে। তার মনে হয়েছিল পথ যেন আজ হঠাৎ পাগলামী করছে। দুজনকে জায়গা থেকে ছিঁড়ে এনে আজ থেকে হয়তো সেই রাস্তায় চালান করে দিল। যেন অ্যাস্ট্রনমার ভুল, অজানা আকাশ থেকে চাঁদ এসে পড়েছিল পৃথিবীর কক্ষপথে—লাগল তাদের মধ্যে পরস্পর ধাক্কা ‘মরণের তাড়নায় ভয়ে দুজনে যুগে যুগে একই দিকে চলেছে।
১৪। ‘সহস্র দুর্গানাম লিখতে লিখতে দিনের পূর্বাহ্ন যায় কেটে।
রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রাচীন পঞ্জিকার কথা বলেছেন। এমন-সকল পিতামহের নাতিরা যখন তারিখের বিপর্যয় সংশোধন করতে চেষ্টা করে তখন তারা এক দৌড়ে পৌঁছে যায় পঞ্জিকায় একেবারে উলটো দিকের টার্মিনাসে। এক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটল। জ্ঞানদা শংকরের নাতি বরদা শংকর বাপের মৃত্যুর পরে যুগ হিসাবে বাপ পিতামহের প্রায় আদিম পূর্বপুরুষ হয়ে উঠলেন। মনসাকেও হাত জোড় করেন, এমনকি শীতলাকেও যা বলে ঠাণ্ডা করতে চান, মাদুলি ধুয়ে জল খাওয়া শুরু হয়। সহস্র দুর্গা নাম জপতে জপতে তাদের দিন কেটে যায়। এইভাবে তাদের এলাকায় বৈশ্যদল নিজেদের দ্বিজত্ব প্রমাণ করে।
১৫। দেবী সরস্বতী যখন কোনো অবকাশে এঁদের আন্তঃপুরে প্রবেশ করতেন। তখন পাহাড়ায় তাঁকেও কাপড় ঝাড়া দিয়ে আসতে হত।
যোগমায়ার বাপের ঘরের মেয়েরা পড়া শুনো করতেন, তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ মাসিক পত্রে সচিত্র ভ্রমণ বৃত্তাস্ত লিখতেও ভোলেন না। সেই বাড়ীর মেয়েরা শুচি সংস্করণে যাতে অনুস্বার বিসর্গের ভুলবাচক না থাকে সেই চেষ্টায় লাগালেন তাঁর স্বামী। সনাতন সীমান্ত রক্ষা নীতির অটল শাসনে যোগমায়ার গতিবিধি বিবিধ পাসপোর্ট প্রণালীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। চোখের উপরে তার ঘোমটা নামল, মনের উপরেও। তাঁর হাতের ইংরেজী বইগুলো বাইরে হত বাজেয়াপ্ত, প্রাগ বঙ্কিম বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী রচনা ধরা পড়লে চৌকাঠ পার হতে পেত না। সেইজন্য লেখক তাদের সম্পর্কে ওই উক্তিটি করেছেন।
১৬। ‘যেন দেবীর প্রসাদের ধারা বয়ে গেল’।
রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসে, অমিতও লাবণ্যের আলাপের মধ্যে দিয়ে, লাবণ্যের রূপটি বর্ণনা করেছেন। চল্লিশের কাছাকাছি তাঁর বয়স, কিন্তু বয়সে তাকে শিথিল করে তোলেনি, কেবল তাকে গম্ভীর শুভ্রতা দিয়েছে। গৌরবর্ণ মুখ ঠসঠস করছে। বৈধব্যরীতিতে চুলছাঁটা, মাতৃভাবে পূর্ণ প্রসন্ন চোখ : হাসিটি স্নিগ্ধ। মোটা থান চাদরে মাথা বেষ্টন করে সমস্ত দেহখানি সংবৃত্ত রয়েছে, পায়ে জুতো নেই দুটিপা নির্মল সুন্দর। অমিত তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সময় অমিতের মনে হল শিরে শিরে যেন দেবীর প্রসাদের ধারা বয়ে গেল।
১৭। তাদের সৌন্দর্য পূর্ণিমা রাত্রির মতো উজ্জ্বল অথচ আচ্ছন্ন?
রবীন্দ্রনাথ এখানে লাবণ্যের সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছেন। স্মিতহাস্য মিশ্রিত প্রত্যেক কথাটি লাবণ্যর ঠোঁট দুটির উপর কীরকম একটি চেহারা ধরে উঠছিল, বসে বসে সেইটি ও মনে করতে লাগল। অমিত অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে, কিন্তু লাবাণ্যের সৌন্দর্য সকালবেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত। তাকে মেয়ে করে গড়বার সময় বিধাতা তার মধ্যে পুরুষদের একটা ভাগ মিশিয়ে দিয়েছেন। তাকে দেখলে মনে হয় তার মধ্যে কেবল বেদনার শক্তি নয় সেই সঙ্গে আছে মননের শক্তি। সেইজন্যই অমিতের লাবণ্যকে ভালো লাগে, অমিতের কাছে তার সৌন্দর্য যেন সৌন্দর্য পূর্ণিমা রাত্রির মতো উজ্জ্বল অথচ আচ্ছন্ন।
১৮। “প্রাণ যদি দিতেই হয় তো সাবধানে দেবেন।”
অমিত ও লাবণ্যের প্রেমালাপের সময় এই কথাটি লাবণ্য অমিতকে বলেছিল, অমিত যখন বলেছিল একক্ষুনি চোখ বুজে প্রাণ দিয়ে ফেলা উচিত, তারপর অনুতাপ করতে হয় রয়ে বসে করা যাবে। কমুনাল রায়টের সে যেতে রাজি নয়। মুসলমান বাঁচিয়ে ইংরেজ বাঁচিয়ে চলতে হবে। যদি দেখি বড়ো সড়ো গোছের মানুষ অহিংস্র মেজাজের ধার্মিক চেহারা, শিঙে বাজিয়ে মোটর হাঁকিয়ে চলেছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকিয়ে অমিত বলল যুদ্ধদেহি—ওই যে লোক অজীর্ণ রোগ সারাবার জন্য হাসপাতালে না গিয়ে এমন পাহাড়ে আসে খিদে বাড়াবার জন্যে নির্লজ্জ হয়ে হাওয়া খেতে বোরোয়। এইজন্যই অমিত লাবণ্যকে ওই সমস্ত কথাগুলি বলেছিল।
১৯। ‘জীবনে সেইটেই তো শোচনীয় সমস্যা, লাবণ্যদেবী সময় অল্প।”
অমিত ও লাবণ্যের সুবিস্তৃত প্রেমালাপের মধ্য দিয়ে তাদের, গাছতলায় বসা, ও পাথরের ওপরে বসা ঝিরঝর করে সেখান থেকে জলের ধারা বয়ে যায়। তখন যে সময় তাদের হাতে আছে সে সময় অনেক বেশি হলেও তাদের কাছে যেন খুবই অল্প সময় মাত্র। রবীন্দ্রনাথ প্রেমিক প্রেমিকার এই সময়ের চিন্তাভাবনাকে তিনি চিরন্তন সত্যেও বাস্তবতার রূপ দিয়েছেন। যা অমিত ও লাবণ্যের প্রেমের সম্পর্কটা পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যেও খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।
২০। নইলে লজ্জা করতে গেলেই লজ্জা’
অমিত বলেছিল চায়ের টেবিলের ভাষায় কোন্টা ভদ্র, কোনটা অভদ্র, তার হিসেবে মিটাতে চায় না কিন্তু এজায়গায় ভদ্রও নেই অভদ্রও নেই। সেই উপায় বার করার জন্য অমিত মনটাকে সহজ করার জন্য একটা কবিতা আওড়ানোর জন্য লাবণ্যের অনুমতি চায়। তাই লাবণ্য অনুমতি না দিলেই লাবণ্যের লজ্জা হতো। সেই কারণে লাবণ্য অনুমতি দিয়েছিল।
২১। “পাত্র–বাছাইয়ের বেলায় দুটি জিনিস লক্ষ্য করা চাই—নামের দ্বারা বর যেন ঘরকে ছাড়িয়ে না যায়। আর রূপের দ্বারা কনেকে।”
অমিত যখন যোগমায়ার কাছে ঘটকালি করতে এসেছিল তখন যোগমায়াকে অমিত বলেছিল, কারণ নাম যার বড়ো তার সংসারটা ঘরে অল্প, বাইরে বেশি। ঘরের মন-রক্ষার চেয়ে বাইরে মান রক্ষাতেই তার যত সময় যায়। মানুষটার অতি অল্প অংশই পড়ে স্ত্রীভাগে, পুরো বিবাহের পক্ষে যেটুকু যথেষ্ট নয়। নামজাদা মানুষের বিবাহ স্বল্প বিবাহ, বহু বিবাহের মতোই গর্হিত।
২২। “অন্নপূর্ণার পূর্ণতা প্রকাশ করতে হবে বলেই শিব নিজেকে ভিখারি কবুল করেন একটুও লজ্জা নেই।”
শিব যেমন স্বয়ং ভিখারি সেজে অন্নপূর্ণার পূর্ণতা প্রকাশ করতে এসেছিল। সেইরকম অমিত ঘটকালি করতে এসেছিল যোগমায়ার কাছে। অর্থাৎ লাবণ্যকে বিবাহ করার জন্য সে নিজেই লাবণ্যের পূর্ণতা প্রকাশ করতে লাবণ্যের মা যোগমায়ার কাছে এসেছিল এই প্রসঙ্গে লেখক ওই উক্তিটি অমিতের মুখ দিয়ে বলেছেন।
২৩। “যা লাবণ্য, মনটাকে পাষাণ কোরো না।”
অমিত হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে এবং যোগমায়াকে ব্যথা দেয়। তিনি প্রায় বলতে গিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে এসে থাকো কিন্তু থেমে গেলেন। ভাবলেন বিধাতা একটা কান্ড ঘটিয়ে তুলেছেন, তারমধ্যে আমাদের হাতপড়লে অসাধ্য জট পাকিয়ে উঠতে পারে। নিজের বাসা থেকে অল্প কিছু জিনিস পত্র পাঠিয়ে দিলেন আর সেই সঙ্গে লক্ষ্মীছাড়াটারও পরে তাঁর করুণা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। লাবণ্যকে বারবার বলেন সে তার মনটাকে যেন পাষাণ না করে।
২৪। “that much for it!”
কেটি আজ বুঝেছিল তার ব্যবহারের বিরুদ্ধে সিসির এই সংকোচ কড়া করে ভাঙতে হবে। চৌকি থেকে উঠে এক সিগারেট মুখে করে ধরাবার জন্য এগিয়ে এল। প্রত্যাখান করতে সিসি সাহস করতো না। কানের ডগাটা একটু লাল হয়ে উঠল। তবু জোর করে এমনি একটা ভাব দেখাল যেন তাদের পাশ্চাত্যকতায় যাদের ভ্রু এতটুকু কুণ্ঠিত হবে তাদের মুখের উপর তুড়ি মারতে প্রস্তুত। সেইটাকে বোঝাতে লেখক That much for it! কথাটি ব্যবহার করেছেন।
২৫। আমি রোমান্সের পরমহংস—
গল্পের বই থেকেই রোমান্সের ছাঁচ বসাতে হবে বলে মনে করেন লেখক। তাই রোমান্স সৃষ্টি করার কথা সে বলেছেন। তারা স্বর্গে গেলেও রোমান্স মর্তে থাকলেও রোমান্স। যারা একটাকে বাঁচাতে যায় আর একটাকে মারতে হয়। তারা মাছের মতো জলে সাঁতার দেয়, নয় বেড়ালের মতো ডাঙায় বেড়ায়, না হয় বাদুরের মতো আকাশে ফেরে। তাই অমিত রোমান্সের পরমহংস। ভালোবাসার সত্যকে সে একই শক্তিতে জলে স্থলে উপলব্ধি করতে চায়।
Leave a comment