শেষের কবিতা উপন্যাসে অমিত কেন্দ্রিয় চরিত্র এবং নায়ক। সে কথা বলে খুব ভালাে, এবং সেইজন্য সমালােচক বলেছেন- “আগাগােড়া সে আর কিছুই করে না, শুধু কথা বলে। ভালাে ভালাে…..।” কিন্তু কথা বলাটাও যে একটা আর্ট সে কথা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত অমিতের পক্ষে এটা স্বাভাবিক এই কারণে যে, সব বিষয়েই তার স্বাতন্ত্রের কথা লেখক উল্লেখ করেছেন- “পাঁচজনের মধ্যেও ও সে কোনাে একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম।” তার সম্বন্ধে লেখক আরও বলেছেন- “অমিতের নেশাই হল স্টাইলে।” স্টাইল বস্তুটা কী, সেকথা অমিত নিজেই জানিয়েছে- “অমিত বলে, ফ্যাশানটা হল মুখােশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী। ওর মতে যারা সাহিত্যের ওমরাহ দলের, যারা নিজের মন রেখে চলে, স্টাইল তাদেরই। আর যারা আমরা দলের দশের মন রাখা যাদের ব্যবসা, ফ্যাসন তাদেরই।”

প্রথাগত লেখা পড়ায় অমিত খুব বেশি দূর এগােয়নি, অন্তত ডিগ্রির যে ছাপমারা পরীক্ষা ব্যবস্থায় কাউকে খুব ভালাে আখ্যা দেওয়া হয়, তা তার ছিল না- “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ. কোঠায় পা দেবার পূর্বেই অমিত অক্সফোর্ড ভর্তি হয় ; সেখানে পরীক্ষা দিতে দিতে এবং না দিতে দিতে ওর সাত বছর গেল কেটে।” এই অমিত জীবনে প্রথম নাড়া দেবার মতাে মেয়ের সন্ধান পেয়েছে শিলঙ পাহাড়ে গিয়ে। লাবণ্যর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তাকে কেন্দ্র করে অমিতের ভাবনায় যে পরিচয় রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন তাতে একথা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়, যাকে প্রকৃত অর্থে প্রেম বলে, তাই এসেছে অমিতের জীবনে, এবং সে খুঁজে পেয়েছে এমন একটি মেয়ে যাকে বলা যায় ‘পাত্রী’। প্রেম মানুষের মধ্যে যে নিবিড় পরিবর্তন নিয়ে আসে সে পরিবর্তনের কথাও রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেই বলেছেন।

অমিতের মনে একটা ব্যাপক আলােড়ন শুরু হয়ে গেছে, যে অমিত নিজের চেয়ে বড়া মাপের কাউকে এতদিন দেখেনি, নারী জাতীর প্রতি যার কোনাে আগ্রহ দেখা যায়নি আজ সে লাবণ্যর সঙ্গে ঘনিষ্ট হবার জন্য উচ্ছ্বসিত। অমিত তার উচ্ছসিত প্রেম নিয়ে অপেক্ষা করতে নারাজ, সুতরাং বিবাহের প্রস্তাবটি সে নিজেই পাড়ে যােগমায়ার কাছে। অমিতের উচ্ছ্বাস এবং লঘুচালের কথা শুনে যােগমায়া বলেছিলেন- “বাবা, বিবাহ যােগ্য বয়সের সুর কখনও তােমার কথাবার্তায় লাগছে না, শেষে সমস্তটা বাল্য বিবাহ না দাঁড়ায়।” অবশ্য লাবণ্য অমিতের প্রস্তাবে রাজি হতে পারেনি। তথাপি অমিত যােগমায়াকে দিয়ে লাবণ্যকে অনেক বুঝিয়ে বিবাহে সম্মত করাতে সমর্থ হয়। উভয়ের বিবাহ প্রস্তাব সম্পূর্ণ রূপে যখন কার্যকরী হতে চলেছে তখন হঠাৎ করে কলকাতা থেকে কেটি মিত্তিরের আগমনে সমস্ত পরিকল্পনা একেবারেই বানচাল হয়ে যায়। লাবণ্য আত্মরক্ষার তাগিদে শিলঙ থেকে অগােচরেই নির্বাসিত হয়। তখন লাবণ্য বিহনে অমিতের মনে হতে থাকে- “সমস্ত শিলঙ পাহাড়ের শ্রী আজ চলে গেছে। অমিত কোথাও আর সান্ত্বনা পেল না।”

উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে অমিত যে তত্ত্ব প্রচার করেছে তা রীতিমত রসহ্যময়। যতি শংকরের মতাে মেধাবী ছাত্রও অমিতের কথা ভালাে বুঝতে পারেনি। প্রকৃত প্রেমে প্রেমিক তার প্রেমিকের মধ্যে অন্তরের সন্ধান পায়। প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার মিলন সর্বত্রই যে সম্ভব হয় এমন নয়, বিবাহে ব্যর্থতায় একটি মহৎ প্রেমের পরিসমাপ্তি হল- এমন ঘটনা পৃথিবীর সাহিত্য সংসারে বহুবার ঘটেছে। সেক্ষেত্রে দু’ধরনের পরিণতি লক্ষিত হয়—প্রেমিকার স্মৃতি বুকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়া অথবা তাকে ভােলার চেষ্টায় দাম্পত্য জীবনে কোনাে নতুন সঙ্গিনী বেছে নেওয়া। শেষের কবিতার নায়ক অমিতও সেকথা জানে, সে বলে- “যারা ওর একটাকে বাঁচাতে গিয়ে আর একটাকে দেউলে করে দেয় তাদেরই তুমি বল রোমান্টিক।” কিন্তু দুটোর কোনােটাই অমিত করেনি। সে লাবণ্যকে মনে রাখার জন্য বিবাগী হয়ে যায়নি। অথবা দুঃখ বরণ করার জন্য কেতকীকে বিয়ে করতে উদ্যোগী হয়নি। কেতকীর সঙ্গে তার নতুন উদ্যমে প্রেম সম্পর্ক স্থাপন যদি লাবণ্যকে ভুলবার জন্য হতাে, তাতে আশ্বস্ত হওয়া যেত, কিন্তু যখন সে বলে, তার লাবণ্যও রইল, কেতকীও থাকল, তখন মনে হয় ব্যাপারটা অবাক করার মতাে। লাবণ্য যে তার ওড়বার আকাশ এবং কেতকী তার বিশ্রামের নীড়-একটা যথার্থ রূপে মেনে নেওয়া যায় না। অবশ্য অমিত নিজেও স্বীকার করেছে— “আমি যা বলছি, হয়তাে সেটা আমারই কথা। সেটাকে তােমার কথা বলে বুঝতে গেলেই ভুল বুঝবে, আমাকে গাল দিয়ে বসবে।”

অমিতকে দুর্বোধ্য মনে হলেও লাবণ্যর কথা কিছু বােঝা যায়। সে বিদায় চেয়েছে। বারবার, বলেছে— “এবার পূজায় তাই আপনারে দিতে চাই বলি।” কিন্তু অমিত বলিদান দিতে চায়নি নিজেকে মনে হয়েছে সে যেন লাবণ্যকে আরও ভালােভাবে পেয়ে গেছে। এবং তার অধিকন্তু লাভ নতুন প্রেম পাত্রী কেতকী। অমিত রায়ের এই তত্ত্বর মধ্যে একটি স্পষ্ট আত্মবঞ্চনা দৃষ্টি হয়। কোথাও হারতে রাজি নয়, কারাে কাছে ছােটো হতে চায় না—এমন একটি চরিত্র বলেই কি অমিত এরকম একটি আত্মবনা বেছে নিয়েছে।

সুতরাং সিদ্ধান্ত করা চলে, অমিত রায় অপরিমিত বাক বৈদগ্ধ্য এবং স্বতন্ত্র রুচি নিয়েও সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি- প্রধানত তার বাস্তব বুদ্ধিরই অভাবে। অবশ্য অমিতের পরিণতি যে সুখের সে কথা মনে করা চলে। আদর্শের সঙ্গে যে বাস্তব জীবন মেলে না ‘চতুরঙ্গের’ শচীশ যেমন বুঝতে পারেনি ঘরে বাইরের নিখিলেশও পারেনি। শেষের কবিতার অমিত না পারলেও তার পরিণতি তেমন ভয়াবহ নয়। তবে, কেতকীর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবন তাকে আরও একটু বাস্তব জ্ঞান-সম্পন্ন করে তুললে এবং শােভনলাল লাবণ্য নামক আর একটি সুখী দম্পতির সঙ্গে পরিচিত হলে অমিত যে তার আত্মবনার স্বরূপ বুঝতে পারবে সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।