সমালােচক ও কবি বুদ্ধদেব বসু ‘শেষের কবিতা’র পরিণতি অংশটিকে সহজ মনে মেনে নিতে পারেননি। এই অংশটিকে তিনি অবিশ্বাস্য এবং আকস্মিক রূপে প্রতিপন্ন করেছেন, অর্থাৎ এটি মূল উপন্যাসের কাহিনি ধারার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। বুদ্ধদেববাবুর এ অভিমত কতখানি যৌক্তিকতাপূর্ণ তা উপন্যাস পর্যালােচনার নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যেতে পারে।
প্রথমত: সব প্রেমেই বিবাহে সাথক হয় না। পরিচয় গাঢ় হয়ে ভালােবাসায় পরিণত হবার পর তা মিলনে সাথর্ক হল না— এই বিষয় বস্তু নিয়ে ‘শেষের কবিতা’ই একমাত্র উপন্যাস নয়। বস্তুত, সম্ভাব্য তার বিচারে, এটিকে মাঝামাঝি স্থানে রাখা যেতে পারে। সততারটি পরিচ্ছেদে সমাপ্ত এই উপন্যাসে বিবাহ প্রস্তাব এসেছে সপ্তম পরিচ্ছেদেই এবং সে প্রস্তাব পেড়েছে স্বয়ং অমিত। অমিতের মতাে কল্পনা বিশ্বাসী ছেলের দাম্পত্য বন্ধন সুখের হবে কিনা সে বিষয়ে যােগমায়ার সন্দেহ ছিল। এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে ছিল একমাত্র অমিত। কিন্তু প্রথম থেকেই দেখা যায় লাবণ্যও বিবাহ সম্বন্ধে সংশয়ী। অমিতের প্রস্তাব শুনেই লাবণ্য বলেছে— ‘মিনতি করে বলছি, আমাকে বিয়ে করতে চেয়াে না। তােমার কাছ থেকে আমি যা পেয়েছি সে আমার পক্ষে যথেষ্ট, জীবনের শেষ পর্যন্ত চলবে।’ এখানেই শেষ নয়, লাবণ্য প্রায় সর্বক্ষণই ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে লাবণ্য যে বিবাহে সম্মত হয়েছিল সে মূলত অমিতের জোর জবরদস্তি এড়াতে না পেরে, অবশেষে কেটি মিটারের আগমনে অমিতের সাধ অপূর্ণ থেকে গেল।
সুতরাং সম্ভাব্যতার কথা বিচার করতে গেলে বলতে হবে, লাবণ্য অমিতের বিবাহ হতে পারে এ কথাই আমাদের কম বিশ্বাসযােগ্য মনে হয়। কারণ এ বিবাহে লাবণ্যের দ্বিধা প্রথম থেকেই দেখা গেছে। দুজনকে ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন যােগমায়া এবং লাবণ্য সে বন্ধন মেনে নিয়েছে অংশত যােগমায়ার প্রতি কৃতজ্ঞতায় এবং অংশত অমিতের প্রতি করুণায়। বিবাহের পাত্র নির্বাচনে কৃতজ্ঞতা ও করুণা কখনােই সর্বস্ব বিবেচিত হতে পারে না। অমিতকে দাম্পত্য-বন্ধনে গ্রহণ করার সমর্থন লাবণ্য নিজের মন থেকে কখনােই পায়নি বলেই বিচ্ছেদের সম্ভাবনাও কখনােই অস্বীকার করা যেতে পারে না।
দ্বিতীয়তঃ প্রশ্ন উঠেছে, উপসংহার অংশের বিচ্ছেদ বা বিষাদান্তক পরিণতির রূপায়ণ শিল্পসম্মত হয়েছে কিনা। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, ভালােবাসার প্রকৃত অনুভূতি লাবণ্য কখনােই পায়নি, অন্ততঃ শােভনলালের প্রতি তার আচরণে সেকথাই মনে হয়- যদিও এই বৃঢ়তা প্রেমের বিপ্রতীপ প্রকাশও হতে পারে। অমিতের প্রেমে লাবণ্য জেগে উঠেছে এবং অমিতকে প্রেমের আলােকে চিনে নেওয়ার সূত্রেই বুঝেছে বিবাহের বন্ধনে তাকে চিরকাল বেঁধে রাখা অসম্ভব। লাবণ্যর এই অনুভূতি প্রথম থেকেই এত তীব্র ও স্পষ্ট তাকে চিনে নিতে কোনাে অসুবিধাই হয় না। বরং অমিতের দিক থেকে বিবাহের আগ্রহ ছিল বেশি এবং শেষকালে লাবণ্যর কথা সে মেনে নিয়েছে বা মানতে বাধ্য হয়েছে। লাবণ্য তার প্রেমে দীপ্তিতেই শােভনলালের পূজাকে চিনতে পেরেছে, সুতরাং তার দোলাচল চিত্তে যখন পুনর্বার আবির্ভাব ঘটে শােভনলালের তখনই অনুমিত হয় পূজাকে সম্মানিত করার কোমলতা এখন তার ঘটবেএজন্য কোটশীপ বাঞ্ছনীয় ছিল বলে অন্ততঃ পাঠকের মনে হয় না। অর্থাৎ সম্ভাব্যতা ও শৈল্পিক মূল্যের বিচারে এই উপসংহার আমাদের অসংগত মনে করার কোনাে কারণ নেই। ঘটনার বাহুল্য না থাকায় এই উপসংহার সংক্ষিপ্ত ঠিকই, কিন্তু আকস্মিক মনে করা অসমীচীন।
তৃতীয়তঃ শেষ অভিযােগ হল, অমিত যা বলেছে, সেই যুক্তিগুলি কাঁচা মনের কথা কিনা। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, অমিতের মন পেকে যায়নি, সেটাইতাে তার বৈশিষ্ট্য। সপ্তম পরিচ্ছেদে যােগমায়া অমিতকে বলেছিলেন— “বিবাহযােগ্য বয়সের সুর এখনাে তােমার কথাবার্তায় লাগছে না, শেষে সমস্তটা না বাল্য বিবাহ হয়ে দাঁড়ায়।” আরও বলেছেন- “ওর ছেলেমানুষী আমার ভারি ভালাে লাগে।” অমিতের এই বাস্তব জ্ঞানহীন ছেলেমানুষি যে ছিল তার বিবাহােত্তর জীবন যাপনের সমস্ত পরিকল্পনাই তাে তার দৃষ্টান্ত। অমিত প্রেম সম্বন্ধে যে বিরাট আদর্শে বিশ্বাসী, সেই প্রেম অমিত ও লাবণ্যকে যে মহান জগতে উদার মুক্তি দিয়েছিল, প্রথাগত দাম্পত্য জীবন তাকে সংকীর্ণ করে তুলতে বাধ্যএকথা লাবণ্যর মনে হয়েছিল। আসলে এটা প্রেমের কোনাে তত্ত্ব নয়, প্রেম সম্বন্ধে অসাধারণ সত্যও নয়। অবশ্য অমিত ও লাবণ্যর মতাে অ-সাধারণ মানুষ যারা প্রেমকে জীবনের সর্বোচ্চ সাধনা হিসাবে গ্রহণ করেছে, তাদের কাছে একথা সত্য—সকলের কাছে নয়।
সর্বোপরি বলা যেতে পারে, অমিত ও লাবণ্য সামাজিক মতে বিবাহ করেনি, কিন্তু বিবাহের যা মূল তাৎপর্য সেই অর্থে কি তাদের বিবাহিত বলা চলে না ? যােগমায়া তাদের যে মিলন-সাধন করেছেন এবং সে মিলনকে দুজনেই মেনে নিয়েছে তাকে হৃদয়-সম্প্রদান ছাড়া কি বলা যায় ? ছােটো একটি আড়ম্বর আনুষ্ঠানিকতাও হয়ে গিয়েছে। এরপর সাধারণের চোখে বিবাহ যে জৈবিক সম্পর্কের দায়, তা যদি দুজনের ক্ষেত্রে দুরকম হয়। তবে কি বলতে হবে তারা ব্যভিচারী ? সম্ভবতঃ নয়, কারণ হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিলন, অন্তরের সত্য, তার তাৎপর্য সামাজিক রীতিসিদ্ধ অনুষ্ঠানের চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক। এই দুটি পৃথক সম্পর্ক যদি প্রতীকায়িত হয় এই উক্তিতে, তবে তাকে ছেলেমানুষী তত্ত্ব বলে উড়িয়ে দেওয়াটা উচিত নয়। অমিতের কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়েছে সেই সার সত্যটি- “একদিন আমার সমস্ত ডানা মেলে পেয়েছিলুম আমার ওড়ার আকাশ ; আজ আমি পেয়েছি আমার ছােট্ট বাসা, ডানা গুটিয়ে বসেছি। কিন্তু আমার আকাশও রয়েছে।”
Leave a comment