‘শেষের কবিতা’য় রবীন্দ্রনাথ বৃত্ত গঠনে পরিকল্পনার পরিচয় দিয়েছেন অত্যন্ত সুচারু উপায়ে। এর আখ্যান অংশ খুবই অল্প, স্বাতন্ত্রয ও নিজস্ব জীবনধারায় বিশ্বাসী এক যুবক প্রচলিত ফ্যাশনে গা ভাসায় না বলেই যাবতীয় অন্তঃসার শূন্য আচরণকে সে অর্থহীন মনে করে। জীবনযাত্রায় ও চিন্তায় স্বকীয়তায় বিশ্বাসী এই যুবক স্বাভাবিক ভাবেই তার উপযুক্ত প্রেমের পাত্রী খুঁজে পায় না নিজস্ব সােসাইটিতে। অবশেষে এইরকমই স্বকীয়তায় বিশ্বাসী এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এবং প্রকৃত প্রেমাকর্ষণ বােধ করে, প্রেমে তার দীক্ষা হয় ; সম্ভবত সেই নারীর গভীর ও উত্তুঙ্গ প্রেম বাস্তব জীবনের সংসার-যাত্রায় বিঘ্নিত হতে পারে বলে তারা পরস্পরের প্রতি গভীর প্রেমের পূজা হৃদয়ে নিয়েও বিবাহ করে অন্যত্র।
এই আখ্যানকে বিশ্বাসযােগ্যতা দান করার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসকে অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে বিন্যস্ত করেছেন। সমগ্র আখ্যানকে সতেরটি পরিচ্ছেদে তিনি বিভক্ত করেছেন, যদিও কেবল সংখ্যা নির্দেশের দ্বারাই এই বিভাগ চিহ্নিত হয়েছে। প্রত্যেক পরিচ্ছেদেই একটি করে শীর্ষনাম আছে, যার দ্বারা সেই পরিচ্ছেদের মূল বক্তব্য বুঝতে পারা যায়। এই ধরনের শীর্ষ নামাঙ্কিত অধ্যায় লেখকের একটি সুচিন্তিত বিন্যাসেরই প্রমাণ। যদিও ঘটনার সংখ্যা এ উপন্যাসে অতি অল্প, তথাপি এর বিন্যাসের গতিতে নাটকীয় ভাবধারা প্রমূর্ত হয়ে ওঠে। উপন্যাসের প্রথম পর্যায় হিসাব প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়কে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে ঘটনাকালের দিক থেকে প্রথম পর্যায়ের সঙ্গে দ্বিতীয় অধ্যায়ের কোনাে মিল দর্শিত হয় না বলে এক্ষেত্রে তাকে পরিহার করা হল। কারণ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ঘটনাটি নাটকীয়তা বজায় রাখবার জন্যই প্রাককথন পদ্ধতির মাধ্যমে পূর্ববর্তী ঘটনা লেখক বর্ণনা করেছেন।
উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্যায় রূপে পঞ্চম থেকে অষ্টম অধ্যায়কে চিহ্নিত করা যেতে পারে। পিরামিড আকৃতির ছকবিশিষ্ট নাটকে যাকে Rising Action বলা হয় তার সঙ্গে এই পর্যায়ে লাবণ্যর মিল আছে। অমিতের মত স্বাতন্ত্র্য বিশ্বাসী যুবকের সঙ্গে লাবণ্যর মতাে ব্যক্তিত্ব সুরভিত নারীর আলাপ কোন পর্যায়ে ওঠে সংঘাতেই শেষ হয় অথবা মিলনে অঙ্কুরিত হয় তা দেখার বাসনা পাঠক চিত্তে বুনে দেওয়াই এই পর্যায়ের কাজ।
উপন্যাসের নবম ও দশম পরিচ্ছেদকে চরমণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। অর্থাৎ এটিকে নাটকের তৃতীয় পর্যায়ে রূপে বর্ণনা করা যায়। লাবণ্য কখনাে তার মত পরিবর্তন করতে পারে কিনা, তা সহজেই বােধগম্য হয় না, কারণ যিনি তাকে সবচেয়ে বেশি চেনেন সেই যােগমায়াকেও বলতে হয়ছেএকবার তােমার মনের একটা জেদ চাপলে আর তােমাকে সােজা করা যায় না। তবে কেবল যে লাবণ্যকে ডেকে এনে লাবণ্যর জন্য অমিতের দুঃখের সাধনা তিনি যে দেখিয়েছেন তাই নয় লাবণ্য ও অমিতের গাঁটছড়াও তিনি বেঁধে দিলেন। অমিতও লাবণ্য একসঙ্গে তাঁকে প্রমাণ করেছে। এটি এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে এরপর এই বিবাহের অনুষ্ঠানিক ব্রিয়াকর্মাদি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকার কথা নয়।
নাটকের Falling Action শুরু হয়েছে এর পরবর্তী দুটি পরিচ্ছেদে। এই সময়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যাতে বােঝা যায় উপন্যাসটির চরমক্ষণ একটি নয় দুটি। এর গঠনে যে আরও একটি ‘Climax’ অপেক্ষা করে আছে তা সহজেই অনুমতি হয় এর ত্রয়ােদশ পরিচ্ছেদে, যার অব্যর্থ শিরােনাম—’আশঙ্কা’। কলকাতা থেকে অমিতের কোন সিসি আর কেটির আগমনে অমিত ও লাবণ্যর বিবাহ পণ্ড হয়ে যায়। কার্যত ‘যােড়শ’ পরিচ্ছেদে ঘটল তাদের ‘মুক্তি’। এখানে দেখা যায় শােভনলাল ফিরে এসেছে শিলঙে এবং লাবণ্য তাকে জানিয়েছে ‘তুমি আমার সকলের বড়াে বন্ধু’। অনুমান করা সহজ কি হতে চলেছে এবং অমিতকে যে লাবণ্য দাম্পত্য জীবন রচনায় গ্রহণ করবে না তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি কথায়—তার সম্বন্ধে অমিতকে সর্বপ্রকারে দায়মুক্ত করার প্রতিশ্রুতিতে। এরপর যখন তারই প্রস্তাবে অমিত বােনেদের নিয়ে চেরাপুঞ্জি যায় এবং ফিরে এসে লাবণ্যদের বাসা ফাঁকা দেখে, তখন শেষ পরিণতিও অভাসিত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ একইসঙ্গে Falling action এবং Catastrophe. রচিত হয় এই সংবাদে যে অমিত-কেটি এবং লাবণ্য-শােভনলাল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। নাটকের ভাবমােক্ষণের কাজ করে শেষের কবিতাটি।
উপস্থাপনা রীতির প্রশ্নে সাধারণত বিবেচ্য প্রথম পুরুষ, উত্তম পুরুষ বা চরিত্রমূলক পদ্ধতি—এর কোনটি উপন্যাসে ব্যবহার করা হয়েছে। উপন্যাসটি প্রচলিত রীতিতে অর্থাৎ প্রথম পুরুষের ভঙ্গিতেই রচিত। কিন্তু প্রথম দু-একটা পৃষ্ঠাতে উত্তম পুরুষের সুর ধ্বনিত হয়েছে। যে ‘আমি এই উপন্যাস বর্ণনার দায়িত্ব পেয়েছিল সে একজন নবীন লেখক যার পাঠক অতি অল্প এবং যার শ্যালক নবকৃষ্ণ “ইংরেজি সাহিত্যে রােম-হর্ষক এম. এ।” প্রথম পরিচ্ছেদের প্রারম্ভেই এই নবীন লেখক অন্তর্হিত হন এবং উপন্যাসটি প্রথম পুরুষে এগিয়ে যেতে থাকে।
এ উপন্যাসের ভাষারীতি স্বতন্ত্র এবং সবিস্তারে আলােচনার যােগ্য। সাধারণভাবে বলা যায় এর ভাষা কাব্যিক কিন্তু নাটকীয় ঘটনা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে অতিনাটকীয় হয়ে উঠেছে।
Leave a comment