সমালােচক ও কবি বুদ্ধদেব বসু একদা মন্তব্য করেছেন- ‘শেষের কবিতা’র শেষের কবিতাটি অপরূপ, কিন্তু গল্পটি শেষের কাছাকাছি এসে এমনভাবে এলিয়ে পড়ল, যে সেই দুর্ঘটনাকে চাপা দেবার জন্যই প্রয়ােজন হল ওই কবিতাটির।’ অর্থাৎ শেষের কবিতা উপন্যাসে কবিতার সংখ্যা প্রয়ােজনের থেকে বেশি, সম্ভবত এটাও অন্যতম কারণ যাতে কেউ একে উপন্যাস আখ্যা দিতে দ্বিধাবােধ করেন। কেবল কবিতার সংখ্যাধিক্যের জন্য নয়, তাদের উৎকর্যও এত বেশি যে বুদ্ধদেব বসু অনায়াসে উত্ত মন্তব্য করতে দ্বিধাবােধ করেননি।
এ উপন্যাসে কিছু ইংরেজি কবিতাংশ এবং তার সুন্দর অনুবাদ আছে। সেগুলি ছাড়া এখানে মােট কবিতা রয়েছে তেরােটি। এর মধ্যে নটি কবিতাই নিবারণ চক্রবর্তী ছদ্মনামে অমিত রায়ের, দুটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্ততঃ সেকথাই বলেছে লাবণ্য, একটি কবিতা অমিত নীলমাধবের খাতা থেকে উদ্ধার করে এনেছে এমন তথ্য পাওয়া যায় এবং শেষের কবিতাটি লাবণ্যর নিজেরই লেখা। কবিতাগুলির যে স্বতন্ত্র কাব্য মূল্য আছে তার প্রমাণ প্রায় প্রত্যেকটি কবিতাই রবীন্দ্রনাথ দুবছর পরে প্রকাশিত ‘মহুয়া’ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ‘নীল মাধবের কবিতা’ এবং ‘শেষের কবিতা’র প্রথম কবিতাটি ‘মহুয়া’ কাব্যে স্থান পায়নি। ‘পূর্ণ প্রাণে চাবার যাহা রিক্ত, প্রাণে চাস নে তারে’- নিবারণ চক্রবর্তীর এই কবিতা সঙ্গীত হিসাবে ‘গীতবিতানে’র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, প্রেম পর্যায়ের ৩২৪ সংখ্যক গান রূপে। অন্যান্য কবিতার মধ্যে নিবারণ চক্রবর্তীর কবিতাগুলি ‘মহুয়া’ কাব্যে শীর্ষনাম পেয়েছে- ‘পথের কাটা’, ‘অচেনা’, নির্বারিণী, ‘শুকতারা’, ‘প্রণতি’ ‘বাসরঘর’ ইত্যাদি। এছাড়া, লাবণ্য যে কবিতা দুটি রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত কবিতা হিসাবে উল্লেখ করছেন। তা ‘মহুয়া’ কাব্যে ‘নৈবেদ্য’ ‘অশ্রু’ নামে পরিচিত। আর লাবণ্যের নিজের কবিতা- ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও’। ‘মহুয়া’ কাব্যে ‘বিদায়’ নামে খ্যাত।
‘শেষের কবিতা’র প্রথম কবিতা উপযুক্ত পরিবেশে বর্ণিত হয়েছে। রবি ঠাকুরের দিন ফুরিয়েছে বলে ভিন্ন সুরে যে কবিতাটি পাঠ করা হয়েছে তার সুরের ভিন্নতা এত অভিনব যে তিনি ‘মহুয়া’ কাব্যে তাকে স্থান দেননি। ভাষা নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথেরই, কিন্তু এই ভঙ্গি রবীন্দ্রকাব্যে অপরিচিত, অদূরবর্তী নজরুল ইসলামকেই যেন স্মরণ করায়। অমিতের জীবনে প্রথম প্রণয় ঘটবার পরই দ্বিতীয় কবিতাটির সন্ধান মেলে। অমিত যদিও এ কবিতার সূচনায় বলেছেন— “কোথায় আছ নিবারণ চক্রবর্তী। এইবার ভর করাে আমার পরে, বাণী দাও বাণী দাও!” তবু কবিতাটি যখন পাঠ করা হয়- পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি তখন সন্দেহ থাকে না নিবারণ চক্রবর্তীর সমস্ত হুংকার এখানে প্রশমিত। প্রেমালাপ যখন গভীর হতে চলেছে তখন ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে পাওয়া যায় অমিতের এই কবিতা-
“রে অচেনা, মাের মুষ্টি ছাড়াবি কী করে
যতক্ষণ চিনি নাই তারে।”
দশম পরিচ্ছেদের কবিতাটি পড়বার আগেও অমিত ভণিতা করে বলেছে। “যেটা পড়তে যাচ্ছি সে লেখাটা কোনাে কবি সম্রাটের নয়। অথচ কবিতাটি পড়ার পরই স্মরণ করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথকে-
“পূর্ণপ্রাণে চাবার যাহা
রিক্ত হাতে চাসনে তারে ;
সিক্ত চোখে সামনে দ্বারে।”
অর্থাৎ এখানেই অমিত তথা নিবারণ চক্রবর্তীর মানসিক পরিবর্তন ঘটেছে। এইভাবেই দ্বন্দ্ব মধুর মিলন বিরহের মধ্য দিয়ে শেষের কবিতার কবিতাগুলি আবর্তিত হয়েছে।
অমিতকে যে লাবণ্য বুঝতে পেরেছে একথা গদ্য সংলাপে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু যে ভাষায় লাবণ্য তা প্রকাশ করে সে ভাষা সে কোথায় পেল এ দুয়ে রহস্যে অভিভূত হয়েই উপন্যাস পাঠ সমাপ্ত করতে হয়। “শুক্ল-পক্ষ হতে আনি রজনীগন্ধার বৃন্তখানি। যে পারে সাজাতে। অর্ঘ থালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে।” তাকে তাে আমরা চিনি, বারবার তাকে দেখা গেছে ধনঞ্জয় বৈরাগী, কিন্তু পাগল হিসাবে। আবার কবি বলেছেন-
‘তােমারে যে দিয়েছিনু সে তােমারই দান
গ্রহণ করেছে যত ঋণী তত করেছে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।’
এভাষা ও ভাবের মাহাত্মা একমাত্র বুঝাবেনা রসপিপাসু পাঠক। সুতরাং একথা স্বীকার করতেই হয়— শেষের কবিতাকে যদি গ্রহণ করা হয় এমন এক উপন্যাস হিসাবে, যার জীবন জিজ্ঞাসার প্রকৃতি কাব্যিক, অর্থাৎ যদি ধরে নেওয়া যায়, এটি কাব্যিক উপন্যাস, তবে কবিতাগুলি এর অধিচ্ছেদ্য ও উপভােগ্য অঙ্গ। কিন্তু এ কবিতা অমিত বা লাবণ্যর পক্ষে রচনা করা সম্ভব ছিল কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন জাগে। লাবণ্যর পক্ষে কোনােক্রমে নয়, অমিত বা নিবারণ চক্রবর্তীর পক্ষেও নয়-অর্থাৎ নিবারণ চক্রবর্তীর ভাবমূ্তিও উপন্যাসে অক্ষুন্ন থাকেনি। সব মিলিয়ে বলতে হয় উপন্যাস মধ্যে লেখক স্থান বিশেষে পাত্র পাত্রীর মুখ দিয়ে এমন সুন্দর সুন্দর কবিতার স্থান দিয়েছেন তাতে এ উপন্যাসকে কাব্যধর্মী উপন্যাস রূপে স্বীকৃতি না জানিয়ে উপায় নেই।
Leave a comment