প্রথম যুগের ঐতিহাসিক নাটক ও রোমান প্লে’গুলি দিয়ে শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি নাটক লেখার হাতেখড়ি হলেও এবং জীবনের শেষ পর্ব পর্যন্ত মাঝে মাঝে শেক্সপিয়র ট্র্যাজিক নাটক রচনা করলেও ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপাট্টা’ ও ‘জুলিয়াস সীজার’-এর কথা মনে রেখেও তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি নাটকরূপে চারটি নাটককে সমালোচকগণ চিহ্নিত করে থাকেন। এই নাটকগুলি তাঁর জীবনের তৃতীয় পর্বে রচিত। নাটক চারটি হচ্ছে ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’, ‘কিং লিয়ার’ ও ‘ম্যাকবেথ’।
হ্যামলেট : ‘হ্যামলেট’ নাটকটি সমালোচকদের মতে শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি নাটকগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রথম অভিনীত হয় ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে এবং তার দু’এক বছরের মধ্যেই প্রকাশিত হয়। নাটকের পরিণতিও খুবই দুঃখবহ। হ্যামলেট নাটকে হ্যামলেট আদর্শবাদী, দার্শনিক, সংবেদনশীল। হ্যামলেটের চরিত্রের কোনো দুষ্প্রবৃত্তি নয়, তাঁর মধ্যেকার পিতৃভক্তি ও বিচারবোধই তাঁকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে গেছে। তাঁর মধ্যেকার কামনা-বাসনা ও আত্মার দ্বন্দ্বে দীর্ণ চরিত্রটি শেষ জের মধ্যেই সংগ্রাম করে গেছে। বাইরের সংঘাতের চেয়ে অন্তরের এই সংঘাত, মনস্তাত্ত্বিক এই কাটাছেঁড়াই চরিত্রটিকে অবক্ষয়ের প্রান্তসীমায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এইখানেই রহস্যঘেরা চরিত্র হ্যামলেট মানুষ হিসেবে সবার সার্বিক সহানুভূতি লাভে হয়ে উঠেছে স্মরণীয়। আর এইখানেই শেক্সপিয়রের নাট্য-প্রতিভার মৌলিকত্ব।
হ্যামলেটের পিতা, ডেনমার্কের রাজা তাঁর ভাই ক্লডিয়াস কর্তৃক নিহত হন। ক্লডিয়াস নিহত রাজা তথা ভাইয়ের পত্নী গারট্রুডকে বিবাহ করেন এবং ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেটকে বঞ্চিত করে রাজ্যভোগ করতে থাকেন। এক শীতার্ত রাত্রে রাজপ্রাসাদে পিতার আত্মার সঙ্গে হ্যামলেটের সাক্ষাৎ ঘটে। বিদেহী আত্মা পুত্র হ্যামলেটকে তাঁর মৃত্যুর বিবরণ দেন এবং হ্যামলেটকে এই মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে বলেন। হ্যামলেট প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু হ্যামলেটের মানসিক বিষাদ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোদুল্যমানতা, দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতা (to be or not to be) এবং অত্যধিক চিন্তাপ্রবণতা “এই প্রতিশ্রুতি রূপায়ণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অপরদিকে, হ্যামলেটের ঔদাসীন্যে ও হ্যামলেটকে না-পাবার দুঃখে হ্যামলেট প্রিয়া ওফেলিয়াও মৃত্যুবরণ করেন। ক্লডিয়াসের ষড়যন্ত্রে ওফেলিয়ার ভাই লেয়ার্টেস-এর হাতে হ্যামলেটের মৃত্যু ঘটে। হ্যামলেট মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও ক্লডিয়াস ও লেয়ার্টেসকে চরম আঘাত হানেন। হ্যামলেটের জন্য প্রস্তুত বিষাক্ত পানীয় পান করে হ্যামলেটজননী গারট্রুডও প্রাণত্যাগ করেন।
অজস্র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নাটকের গভীর বিষাদময় পরিসমাপ্তি ঘটে। নাটকটি মনস্তত্ত্বপ্রধান। হ্যামলেটের বাইরের সংঘাত রাজা ক্লডিয়াস, পলনিয়স প্রভৃতির সঙ্গে; কিন্তু তাঁর মন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে প্রতিহিংসা ও নীতিবোধের দ্বন্দ্বে। হ্যামলেটের বহির্দ্বন্দ্ব ও অন্তর্দ্বন্দ্ব — তাঁর সত্তার বিক্ষুদ্ধ দহন জ্বালা এবং কর্তব্য ও চেতনার দ্বন্দ্ব ট্র্যাজেডিকে গভীর করেছে। পিতৃহত্যাকারী কাকা রাজা ক্লডিয়াসকে হ্যামলেট কেন সত্ত্বর হত্যা করেননি, সে সম্বন্ধে পণ্ডিতগণ একমত নন। কারও মতে (১) দুর্বলচিত্ততার জন্যই হ্যামলেট সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসমর্থ ; (২) বহির্ঘটনাগত দুষ্করতার জন্য কর্তব্যহীনতা; আবার কারও মতে শেক্সপিয়র নিজেও বিষয়টি সম্বন্ধে স্পষ্ট নন। আবার কেহ বলেন (৩) বিলম্বের মূল রয়েছে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির মধ্যেই, হ্যামলেট এই পরিস্থিতির দ্বারাই প্রভাবিত। বাস্তব জীবনের এক মূল্যায়ন রূপে নাটকটি স্মরণীয়।
ওথেলো: ‘ওথেলো’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে। নাটকটি পারিবারিক ট্র্যাজেডি (domes tic tragedy) নাটক। নায়ক-প্রধান। অর্থাৎ ওথেলোকে কেন্দ্র করেই সবকিছু, তাঁর প্রতিই সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ। ওথেলো ভিন্ন অপর যে দুটি চরিত্র সর্বকালের জন্য উজ্জ্বল হয়ে আছে তার একজন হচ্ছেন ওথেলো-প্রিয়া ডেডিমোনা—sweetest innocence, অপাপবিদ্ধা, ভোরের ফোটা ফুল। অন্যজন ভিলেন চরিত্র ইয়াগো (lago)। এই ইয়াগো চরিত্রটি নাটককে গতি দান করেছে। ওথেলো-ডেসডিমোনার বিচ্ছেদ ঘটাতে তাঁর কার্যধারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না উদ্দেশ্যহীন (motiveless) এবং চরিত্রটিকে ভিলেন বলা যায় কিনা এ নিয়ে সমালোচক মহলে বিচারবিতণ্ডার ইতি আজও শেষ হয়নি। কাহিনীর মধ্যে অতিনাটকীয়তা আছে, তবে শেক্সপিয়রের প্রতিভার স্পর্শে সেই অতিনাটকীয়তা ট্র্যাজেডিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
ভেনিসের কৃষ্ণাঙ্গ বীর সেনাপতি ওথেলো ভেনিসের সিনেটরের কন্যা শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী ডেডিমোনাকে বিয়ে করেন। এ ছিল ভালবাসার বিয়ে। এ বিয়েতে ডেডিমোনার পিতা, ভেনিসের সিনেটরের মত ছিল না। যাহোক, বিবাহের পরপরই সামরিক প্রয়োজনে, তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ডেসডিমোনাসহ ওথেলো সাইপ্রাসে যান। এই যাত্রায় ওথেলোর সঙ্গী হন সামরিক সহচর ইয়াগো। শ্বেতাঙ্গ ইয়াগো কৃষ্ণাঙ্গ সেনাপতির খ্যাতি ও সৌভাগ্যে পূর্ব থেকেই ঈর্যাতুর ছিলেন। কৌশলে ধীরে ধীরে ওথেলো ও ডেসডিমোনার মধ্যে ইয়াগো সন্দেহের বীজ বপন করেন। ইয়াগোর ষড়যন্ত্রে সন্দেহবশে অবিশ্বাসিনী ধারণায় ওথেলো ডেডিমোনাকে বধ করেন। মৃত্যুকালেও সতী ডেডিমোনা স্বামীর নিন্দা করেননি, শুধু স্বামীর প্রতি নিষ্কলঙ্ক প্রেম জানিয়ে ডেডিমোনা চিরবিদায় গ্রহণ করলেন। ভোরের প্রস্ফুটিত ফুল, the sweetest innocence’ ডেডিমোনাকে হত্যার পর পরই সহচরী প্রভৃতির কথায় ওথেলোর সম্বিত ফিরে আসে। বুঝতে পারেন ডেডিমোনার প্রতি তাঁর সন্দেহ অমূলক এবং নিছক ষড়যন্ত্রমূলক। বুঝতে পারেন এই ষড়যন্ত্রের মূলে রয়েছে ইয়াগো। ইয়াগোকে হত্যা করতে উদ্যত হন। কিন্তু পারেন না। শয়তানকে কোনো কালেই নিশ্চিহ্ন করা যায় না। অপ্রকৃতিস্থ ওথেলো ইয়াগোকে আহত করলেও হত্যা করতে পারেন না। ইয়াগোর উক্তি I bleed, Sir, but not killed’ শেক্সপিয়রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘বাক্-বিন্যাস’। ওথেলোর মন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে প্রেম ও সন্দেহের দ্বন্দ্বে। আর এরই ফলে ওথেলোর সংঘাত ইয়াগো, ক্যাসিও, ডেডিমোনার সঙ্গে, কিন্তু তাঁর অন্তরের সংগ্রাম তাঁর নিজেরই সঙ্গে। এই বাইরের (outer) এবং অন্তরের (inner) দ্বন্দ্ব (con flict)— তথা এই inner conflict বা অন্তর্দ্বন্দ্বেই বিধ্বস্ত ওথেলো নিজের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন। আপন হাতে মৃত্যুকে বরণ করে জীবনহীন প্রিয়তমার মরদেহের পাশে চিরশয্যা গ্রহণ করলেন। ওথেলো চরিত্রের এই অন্তর্দ্বন্দ্বই নাটকটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটকের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। আর এইখানেই শেক্সপিয়রীয় নাটকের অন্যতম স্বরূপ নিহিত।
কিং লিয়ার : ‘কিং লিয়ার’ নাটকটি অভিনীত হয় ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে। হলিনসেড তথ্যপঞ্জী (Chronicles) থেকে একটি কাহিনী অবলম্বনে প্রায় এক বছর আগে King Lear নামে একটা নাটক অভিনীত হয়। শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়ার’ হয়তো সেই ভস্ম থেকে জেগে ওঠা জ্বলদচিতনু। লিয়ারের ট্র্যাজেডির মূল উৎস রয়েছে লিয়ারের আশাভঙ্গের মধ্যে। তবুও তিনি বেঁচে থাকতে পারতেন। কিন্তু ছোটো মেয়ে কর্ডেলিয়ার মৃত্যু তাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিল। চরম একাকীত্বের যন্ত্রণাই তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত করে। তাই কোনো সমালোচকের মতে এই নাটকের ট্র্যাজেডি হচ্ছে আশাভঙ্গ ও একাকীত্বের ট্র্যাজেডি (tragedy of isolation)।
ব্রিটেনের রাজা লিয়ার বৃদ্ধ হয়েছেন। লিয়ার ঠিক করলেন, তাঁর রাজ্য তিনি তাঁর তিন কন্যার নামে ভাগ করে দেবেন। কন্যাদের মধ্যে প্রথমা গনেরিলের বিবাহ হয়েছিল আলবেনির ডিউকের সঙ্গে, দ্বিতীয়া রেগান কর্নওয়ালের ডিউকের গৃহবধূ। তৃতীয়া এবং সর্বকনিষ্ঠা কর্ডেলিয়া তখনও অবিবাহিতা। ফ্রান্সের এক ডিউক এবং ফ্রান্সের রাজা এই উভয়ের মধ্যে কে মনোনয়ন পাবেন, সে সম্পর্কে রাজা লিয়ার তখনও মনস্থির করতে পারেননি। বৃদ্ধ লিয়ার ভাবলেন, এই তিন মেয়েকে তিনি পরীক্ষা করে দেখবেন। তিন কন্যার মধ্যে যিনি তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন তাঁকেই দেবেন সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ। তাঁর মনে হল গনেরিল ও রেগান উভয়েই তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, এমন কি সবকিছুর বিনিময়েও। কর্ডেলিয়ার উত্তর তাঁর মনঃপূত হয়নি। কর্ডেলিয়া বলেছিলেন, কন্যা হিসেবে পিতাকে যতখানি ভালোবাসা যায়, তিনি পিতা লিয়ারকে ততখানি ভালবাসেন। কর্ডেলিয়া মিথ্যা স্তাবকতা জানতেন না, তাই পিতাকে ভালোবাসার কথাও তিনি স্তাবকতা করে বলতে পারেননি। এরই ফলে লিয়ারের ভুল ধারণা হল যে কর্ডেলিয়া তাঁকে ভালোবাসেন না। ফলে লিয়ার তাঁর সাম্রাজ্য দুই মেয়ের মধ্যেই ভাগ করে দিলেন এবং সর্বতোভাবেই হয়ে পড়লেন সন্তানদের মুখাপেক্ষী। এদিকে পিতা কর্তৃক অবহেলিতা, সম্পত্তিবঞ্চিতা কর্ডেলিয়াকে বিয়ে করলেন ফ্রান্সের রাজা। কিছুদিন পরে কন্যা গনেরিল, তারপর কন্যা রেগানের দ্বারা লিয়ার অপমানিত ও রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। লিয়ারের এই অসময়ে একমাত্র কর্ডেলিয়া সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। দুই কন্যার কৃতঘ্নতায় ও আপন ভুল সিদ্ধান্তের জন্য অনুশোচনা ও অনুতপ্ত লিয়ার হয়ে ওঠেন উষ্মত্তপ্রায়। ঝড় বৃষ্টি দুর্যোগের মধ্যে শিলাস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে লিয়ার নিজের নির্বুদ্ধিতা ও সংসারের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেছেন—
Blow winds and crack your cheeks ! rage ! blow !
You cataracts and hurricanes spout….
Singe my white head !….
Rumble the bellyful! Spit, fire! spout rain!
Nor rain, wind, thunder, fire are my daughters!
I tax not you, you elements, with unkindness
এ চিত্র নাটকে অক্ষয় হয়ে আছে।
সৎ, সহৃদয় পিতৃভক্ত কর্ডেলিয়া একদল সৈন্যসহ ফ্রান্স থেকে আসেন পিতাকে সাহায্য করতে। উন্মাদ রাজা তাঁকে চিনতে পারেন না। যুদ্ধে কর্ডেলিয়া পরাস্ত হন। দু’ মেয়ের হাতে লিয়ার ও কর্ডেলিয়া বন্দী হন। এই অবস্থায় লিয়ার চিনতে পারেন কর্ডেলিয়াকে। কারাবাসে অন্তত ছোটো কন্যার সান্নিধ্য পাবেন এই প্রত্যাশা লিয়ারের মনে জেগেছিল। কিন্তু তাও সইল না। কর্ডেলিয়াকে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃতদেহ কোলে নিয়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন লিয়ার। নিদারুণ হতাশা ও শোকে লিয়ারের মৃত্যু ঘটে।
নাটকের শেষে গনেরিল রেগানকে বিষ দিয়ে মারে। নিজেও আত্মহত্যা করে উন্নতমনা স্বামী Duke of Albany-র ভয়ে।
মৃত্যুকালে রাজা লিয়ারের অন্তর্ভেদী আর্তনাদ, তাঁর একাকীত্বের যন্ত্রণা নাটকটিতে ট্র্যাজেডির মাত্রা সংযুক্ত করেছে। নাটকে দুই বিরুদ্ধ শক্তির দ্বন্দ্ব অতি স্পষ্ট। লিয়ারের অসহ্য বেদনাময়তা—রাজশক্তি, দপ্ত অথচ স্নেহ প্রেম-করুণার আশ্চর্য মাধুর্য তাঁর মনে এনেছে তীব্র সংঘাত। এই প্রচণ্ড অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অন্তর্বেদনার পরিসমাপ্তি তাঁর উন্মত্ততায়, কর্ডেলিয়ার মৃত্যুতে ও শেষ পর্যন্ত লিয়ারের জীবনাবসানে। লিয়ারের মনের এই অন্তর্দ্বন্দ্বই (inner conflict) ‘কিং লিয়ার’ নাটকের ট্র্যাজেডির অন্যতম স্বরূপ।
ম্যাকবেথ : ম্যাকবেথ অভিনীত হয়েছিল রচনার বেশ কিছুদিন পরে, ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে। কাহিনীর সূত্র হলিনসেড। লিপ্সা, মৃত্যু, যুদ্ধ, ডাকিনীবিদ্যা, রক্তের গন্ধ সব মিলিয়ে ট্র্যাজেডির মেঘ এই নাটকে শুধু ঘন হয়েই ওঠেনি, নাটকটিকে করেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। নাটকটির শুরুতে নাট্যকারের বর্ণনা, বজ্রবিদ্যুতের ঘনঘটা, ডাইনীদের একসঙ্গে গান ‘Fair is foul and foul is fair.’ এই দুটি দৃশ্যের পরেই স্কটল্যান্ডের রাজার প্রেরিত সুসংবাদ ম্যাকবেথের পদোন্নতির কথা শুনে ম্যাকবেথের উক্তি, ‘so foul and fair a day I have not seen” (I. iii) এই নাটকটিকে কোন্ পরিণতির পথে নিয়ে যাবে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গ্রিক নাটকের মতো এখানেও ভবিষ্যদ্বাণী আছে এবং নাটকে ম্যাকবেথের জীবনে তা পুরোপুরি ফলে গেছে। নাটকটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজেডির চড়া সুরে বাঁধা।
স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকান। রাজ্যে বিদ্রোহ উপস্থিত হলে সেই বিদ্রোহ দমনে রাজা ডানকান ম্যাকবেথকে পাঠান। সহযোগী ব্যাঙ্কো। বিদ্রোহ দমিত হয়। তুষ্ট রাজা ডানকান ম্যাকবেথকে উচ্চতর সম্মান ‘থেন অব কডোর’ (The Thane of Cawdor) পদে অভিষিক্ত করেন এবং ম্যাকবেথের অতিথি হয়ে তাঁর গৃহে রাত্রিবাসের দুর্লভ সম্মান দেন। কিন্তু অতিরিক্ত লোভ, রাজ্যের অধিপতি হবার লোভ এবং স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথের প্ররোচনায় ষড়যন্ত্র করে তাঁর নাদে সমাগত প্রভু রাজা এবং সহৃদয় ডানকানকে ম্যাকবেথ নিশীথ রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন, এবং স্কটল্যান্ডের রাজা হয়ে বসেন। হত্যা করা হয় রাজা ডানকানের সেনাপতি ও তাঁর সহযোগী ব্যাঙ্কোকে। রাজা হলেও এই হত্যা বিবেক-তাড়িত ম্যাকবেথের মনে নিয়ে আসে অশান্তি। পাপবোধ ও বিবেকবোধ উভয়ের টানাপোড়েনে লেডি ম্যাকবেথও হয়ে ওঠেন উন্মাদিনী। তিনি নিদ্রাজাগর অবস্থায় প্রাসাদে ঘুরে বেড়ান, নিজের হাত দেখতে দেখতে ঘ্রাণ নেন আর বিড়বিড় করে বলেন Here’s the smell of blood still all the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand. লেডী ম্যাকবেথ মারা যান। শেষ পর্যন্ত এই পাপলব্ধ রাজ্য ম্যাকবেথ ভোগ করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে আশ্রিত ডানকানের পুত্র ম্যালকম ইংল্যান্ডের সহায়তায় সৈন্যদল নিয়ে এগিয়ে আসেন। সহযোগী হন স্কটল্যান্ডের বীর ম্যাকডাফ। এই ম্যাকডাফের স্ত্রী-পুত্রকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন ম্যাকবেথ। ম্যাকডাফের সঙ্গে অসি যুদ্ধে ম্যাকবেথের পরাজয় ঘটে, ‘পাপের বেতন মৃত্যু’ লাভ হয়। নাটকে নৈতিক মূল্যবোধই জয়ী হয়েছে। ম্যাকবেথ নাটকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখ করা যায়। ম্যাকবেথের ট্র্যাজিক পরিণতির জন্য দায়ী তাঁর প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এর সঙ্গে আছে নিয়তির নির্দেশ। নাটকের আগমন, ম্যাকবেথের ছুরিকা দর্শন প্রভৃতির মধ্যে প্রকাশ পায় পরিস্থিতির প্রতিকূলতা। চরিত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও ম্যাকবেথের হৃদয়ের তীব্র দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, বিবেকের তাড়না, কল্পনাপ্রবণতা, সংগ্রামী মানসিকতা তাঁকে মহৎ ও অসাধারণ করে তোলে। লেডী ম্যাকবেথের চরিত্র চিত্রণেও, একদিকে তাঁর চরিত্রের নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা এবং অন্যদিকে তাঁর অন্তরের বিষণ্ণ ট্র্যাজিক অনুভব চরিত্রটিকে অন্যমাত্রায় উদ্ভাসিত করে তোলে। তাঁর চরিত্রের এই ট্র্যাজিক পরিণতিই যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ, অতিপ্রাকৃতের ব্যবহার। তাঁর সঙ্কেতধর্মিতা, নাটকে কাহিনীর তীব্র গতি, কল্পনার মহিমা, ভাষার চমৎকারিত্ব এবং নিপুণ গ্রন্থনা ‘ম্যাকবেথ’ নাটকটিকে মহৎ সৃষ্টির মহিমায় ভূষিত করেছে। রক্তের ঋণ শোধ হয়েছে রকে।
ট্র্যাজেডি নাটক রচনায় শেক্সপিয়রের কৃতিত্ব:
ট্রাজেডি নাটক রচনায় শেক্সপিয়রের কৃতিত্ব সম্পর্কে বলা যায় যে তৃতীয় পর্বে রচিত এই নাটকগুলিতে একটু দুঃখ ও বিষাদের সুর গভীর হয়ে বেজেছে বলে তাঁর নাট্যকার জীবনের এই পর্বটিকে বলা হয় Dark Period শেক্সপিয়রের নাটকগুলি সাধারণভাবে এবং এই নাটক কয়টি বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করলে কতগুলি সাধারণীকৃত বিষয় আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। ঘটনাটি কী ধরনের ঘটবে বা ঘটতে পারে তার একটা আভাস ‘প্রোলোগ’ (Prologue)-এর বর্ণনার মধ্য দিয়েই হোক বা ঝড়ের তাণ্ডবলীলা বা চরিত্রগুলির কথোপকথনের মধ্যে দিয়েই হোক দর্শক বা পাঠকগণ প্রথমেই অনুমান করতে পারেন। ‘জনতা’র দৃশ্য থাকে। সাধারণভাবে প্রেম একটি কেন্দ্রীভূত বিষয়, এর সঙ্গে হয়তো ক্ষমতালিপ্সা বা অন্ধ পিতৃস্নেহ বা ঈর্ষা নাটককে ট্র্যাজিক পরিণামের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এ ছাড়া রয়েছে ষড়যন্ত্র, এলিজাবেথীয় যুগের এটা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ট্র্যাজেডির ঘন গম্ভীর রোমহর্ষক কাহিনীকে মাঝেমধ্যে রসালো করবার জন্য comic relief হিসেবে কিছু কিছু comic scene-ও থাকে। মনে হয় এরকম একটা সাধারণ ছক তৈরি করেই শেক্সপিয়র তাঁর ট্র্যাজেডি নাটক রচনা করেছিলেন। হ্যামলেটের নিস্পৃহতা, ওথেলোর ঈর্ষা, ডেডিমোনার প্রেম, কিং লিয়ারের অন্ধ পিতৃস্নেহ, ম্যাকবেথের উত্তুঙ্গ ক্ষমতালিপ্সা সবই যেন এক বিশেষ পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে গেছে। নাটকে ট্র্যাজেডির তীব্র বেদনার্ত সুর নিখাদে ঝংকৃত হয়েছে।
গ্রিক নাটকে ট্র্যাজেডির নায়ক উচ্চবংশজাত এবং সর্বগুণসম্পন্ন। এ সত্ত্বেও তার চরিত্রের একটা মারাত্মক দুর্বলতা বা ভ্রান্তির জন্য তার পতন ঘটে। নাটকে নিয়তিই এই পতনের জন্য অনিবার্যভাবে দায়ী। শেক্সপিয়রের নাটকে বহিরাগত ঘটনা নয়, চরিত্রই হল নিয়তি (character is destiny)। একটা বিষাদময়তা, একটা প্রচণ্ড হাহাকারের মধ্যে নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে—বিরুদ্ধ শক্তির পরাজয় ঘটে, কল্যাণবোধ শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে। নাটকের এই অন্তিম পরিণতি বা পতন তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে সংঘটিত হয় নায়কের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, নিয়তি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা নাটকে পরিণতির জাল বহন করে চলে। হ্যামলেটের চিত্তের দুর্বলতার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসমর্থতা এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিই চরিত্রটির ট্র্যাজেডি ঘনিয়ে তুলেছে। ওথেলোর চরিত্রে প্রেমের আত্যন্তিকতা ও প্রেমিকা ডেডিমোনা সম্পর্কে সন্দেহ এবং ইয়াগোর ষড়যন্ত্র এবং নিয়তির রূপ ধরে একখানি সামান্য রুমাল ‘ওথেলো’ নাটকে চরম সর্বনাশ ঘনিয়ে তুলল। চরম সর্বনাশের মুহূর্তে ওথেলো বলেছিল, ‘Who can control fate.’ রাজা লিয়ার প্রতিকূল পরিবেশ ও নিয়তির বিষাক্ত অভিশাপে মৃত্যুবরণ করেন। এমনকি কনিষ্ঠা কন্যা কর্ডেলিয়ারও মৃত্যু হয় এডগারের বিলম্বিত উপস্থিতিতে। ম্যাকবেথের মনের উচ্চাশা ডাইনী ও লেডী ম্যাকবেথের প্রভাব, নিয়তির অমোঘ নির্দেশের ফলে ডানকানের আগমন, অপচ্ছায়া দর্শন প্রভৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ম্যাকবেথের ট্র্যাজেডি। এইভাবে চরিত্রগত ত্রুটি বা দুর্বলতা, নিয়তি ও প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতার সাহায্যে শেক্সপিয়র মানব চরিত্রের অতি সাধারণীকৃত অথচ অতি দুর্নিরীক্ষ দিকটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এইভাবেই শেক্সপিয়র তাঁর ট্র্যাজেডি নাটকগুলির মধ্যে বহিরাগত প্রতিকূলতাকে নিয়ে বাইরের দ্বন্দ্ব (outer conflict) এবং চরিত্রগত দোলাচলচিত্ততার দ্বন্দ্ব (inner conflict) সহযোগে অন্তরে ও বাইরে থেকে চরিত্রগুলি দ্বন্দ্বমুখর ও নাটকীয় গভীরতা লাভ করেছে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক পরিবেশ মানবকল্পনার একটা মহাজগতের সঙ্গেই তুলনীয়, যার মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায় জীবনধর্ম বা জীবনবেদের সমগ্রতাকে।
Leave a comment