শেক্সপিয়র রচিত শেষ কমেডি নাটক ‘দ্য টেম্পেস্ট (The Tempest)। এই রোমান্টিক কমেডির রচনাকাল সম্ভবত ১৬১১ খ্রিস্টাব্দ। এই নাটকের মুখ্য আবেদন একদিকে এর কবিতায় এবং অন্যদিকে মিরান্দা চরিত্রে।

মিলানের ডিউক প্রস্পেরো তাঁর ভাই অ্যান্টোনিও-র ষড়যন্ত্রে ভাই কর্তৃক রাজ্যচ্যুত ও বিতাড়িত হন এবং সামান্য কিছু বইপত্র ও শিশুকন্যা মিরান্দা সহ ভাঙা নৌকায় তাঁকে সমুদ্রের বুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তিনি জাদুবিদ্যায় পারঙ্গম ছিলেন। ভেসে ভেসে সভ্য সমাজ থেকে বহুদূরে জনমানবহীন এক দ্বীপে গিয়ে ওঠেন এবং দ্বীপের দৃশ্য ও অদৃশ্য প্রাণীদের জাদুবিদ্যায় বশীভূত করে তাদের করেন আজ্ঞাধীন।

এই দ্বীপে একমাত্র পিতা প্রস্পেরো ভিন্ন আর কোনো জীবন্ত মানুষকে মিরান্দা শিশুকাল থেকে দেখেনি। অন্য মানুষ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা একমাত্র অর্ধ-পশু অর্ধমানুষ ক্যালিবানকে ঘিরে এবং সে অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। পিতা প্রস্পেরো, অর্ধ-পশু ক্যালিবান এবং দ্বীপে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির সীমিত আবেষ্টনীর বাইরে বৃহত্তর সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে শিশুকাল থেকেই সে একেবারে অজ্ঞ।

এই অজ্ঞতা, সরলতা ও বিস্ময়বোধ নিয়ে মিরান্দা ছিল যেন প্রকৃতিরই একটা অঙ্গ। সমাজের নারীসুলভ এবং নর-নারী সম্পর্কে যে জটিলতা তা থেকে ছিল সে বহুদূরে। বাধা নিষেধের কোনো গণ্ডী তার সামনে ছিল না। যা তার মনে সঠিক বলে মনে হত তা সোজাসুজিই সে প্রকাশ করত। ফলে বিভিন্ন ঘটনার সংস্পর্শে তার যে মানসিক প্রতিক্রিয়া তা ছিল প্রাকৃতিক ঘটনার মতোই একান্ত স্বাভাবিক, সহজ ও সরল। হত-কুৎসিত চেহারার ক্যালিবানকে দেখে পিতা প্রস্পেরোকে মিরান্দা বলছে, বাবা এই হতভাগার দিকে তাকাতেও আমার ইচ্ছে করে না। সমুদ্রে জাহাজডুবির ঘটনায় এবং জাহাজের লোকজনের দুঃখ-দুর্দশা ও মৃত্যুর আশঙ্কায় তার হৃদয় উদ্বেলিত। তাদের দুঃখ ও কষ্টকে সে নিজের কষ্ট বলে মনে করেছে। এদের কোন ক্ষতি হবে না,’ এমন সান্ত্বনার বাক্য পিতা বললেও তার দুঃখাহত হৃদয় এতে সান্ত্বনা পাচ্ছে না।

আবার জাহাজডুবির ফলে নিঃসঙ্গ একাকী উদ্ভ্রান্ত সমুদ্রতীরে ভ্রমণরত যুবরাজ ফার্ডিন্যান্ডকে দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই তাকে মিরান্দার খুব ভাল লেগে যাওয়ার কথা যেভাবে সে তার পিতা প্রস্পেরোকে অসঙ্কোচে বলেছে, তা তার মনের সহজ সারল্যের পরিচায়ক। তার এই আনন্দ, উল্লাস, বেদনাবোধ সব কিছুই প্রকৃতির মতোই নির্বাধ ও স্বাভাবিক।

প্রকৃতির কোলে পালিত মিরান্দা প্রকৃতির মতোই সহজ ও সরল। যেন সরল প্রকৃতিরই এক প্রতীক হয়ে উঠেছে এই চরিত্রটি। শিশুকাল থেকে এই প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গেই সে বেড়ে উঠেছে। শহর ও সমাজ থেকে দূরে প্রকৃতির মাপে মাপেই সে গড়ে উঠেছে।

নাটকে ঘটনার শেষে প্রস্পেরোর জাদুবিদ্যায় রক্ষিত জাহাজ, জাহাজের লোকজন এবং সপরিষদ রাজা ও‌ রাজপুত্র ফার্ডিন্যাণ্ডের সঙ্গে পরস্পর দেখা ও মিলন হয়। মিলন হয় রাজার সঙ্গে প্রাক্তন ডিউক প্রস্পেরোর। এবং শেষ পর্যন্ত রাজপুত্র ফার্ডিন্যান্ডের সঙ্গে মিরান্দার মিলন ও বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। সবাই একত্রে ফিরে আসেন মূল ভূ খণ্ডে, আসল রাজ্যে। বনজীবন ছেড়ে বনহরিণী পিতা, রাজা ও রাজপুত্রের হাত ধরে রাজপুত্রবধূ হয়ে নগরজীবনে প্রবেশ করে।

শেক্সপিয়রের অনন্যসৃষ্টি এই মিরান্দা চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যের অনেক সাহিত্যিককেই প্রভাবিত করেছে। অনেকেই এই চরিত্রটিকে সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাসের শকুন্তলা চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘শকুন্তলা, মিরান্দা এবং ডেসডিমোনা’ স্মরণ করা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘’কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপটেও শেক্সপিয়রের ‘টেম্পেষ্ট’ তথা মিরাঙার চরিত্র জিজ্ঞাসা বর্তমান। প্রাচীন সাহিত্যের প্রবন্ধাবলীতে ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধটির আরম্ভেই উপোদঘাত রচিত হয়েছে মিরান্দার কথায়।

শেক্সপিয়র সৃষ্ট এই বনবালা মিরান্দা পরবর্তীকালের সাহিত্যিক ফার্ডিন্যাণ্ডদেরও একইভাবে মুগ্ধ করে চলেছে।