ইংল্যান্ডে ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের অন্তিম দশকে খ্যাত, স্বল্পখ্যাত, অখ্যাত প্রায় সব কবিই কমবেশি চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট রচনা করেছিলেন। শেক্সপিয়রের প্রায় সমকালের কবি সিডনী (Sidney) এবং স্পেনসারের (Spenser) নাম এক্ষেত্রে স্মরণীয়। কিন্তু এঁদের রচিত সনেটের সঙ্গে শেক্সপিয়রের রচিত সনেটের পার্থক্য আছে।

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সনেটের আবির্ভাব ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে ও পর্তুগালে। চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দে ইতালির কবি পের্টার্কার (Petrarch) হাতে সনেট পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। পের্টার্কার আঙ্গিককে মূলত গ্রহণ করে বাংলায় এর প্রথম প্রচলন করেন মধুসূদন দত্ত।

চোদ্দ পক্তি বা পদে রচিত সনেটের আর্থিকগত বৈশিষ্ট্য চরণের অন্তানুপ্রাসগত এবং স্তবকগত। রীতির দিক দিয়ে এর স্তবকে রয়েছে দৃঢ়পিনদ্ধ আঙ্গিক, এবং ভাবের দিক দিয়ে রয়েছে অনুভূতির অসামান্য তীব্রতা ও শীতলতা। আঙ্গিকের দৃঢ়পিনদ্ধতা ও ভাবের দৃঢ় সংহতি নিয়ে চতুর্দশ পদের সীমিত সীমায় সনেটগুলি এক একটি নিটোল মুক্তোর মতো হয়ে ওঠে।

পের্টার্কার সনেটের গঠনরীতি হচ্ছে প্রথম অষ্টক ও শেষ ষষ্টক—এই দুই ভাগে বিন্যস্ত। প্রথম আট পভুক্তির সঙ্গে শেষ ছয় পঙ্ক্তির একটা সুসঙ্গত মিল দেখা যায়। প্রথম অষ্টকে চরণের মিল বিন্যাস ক-খ-খ-ক-ক-খ- খ-ক এবং ষষ্টকে গ-ঘ-গ-ঘ-গ-ঘ, কিংবা গ-ঘ-চ-গ-ঘ-চ।

চতুর্দশ পঙ্ক্তিতে রচিত শেক্সপিয়রের সনেট পের্টার্কার ন্যায় অষ্টক ও ষষ্টকে বিভক্ত নয়। যদিও ষষ্টকে প্রায়ই ভাবের বিরাম দেখা যায়। এর প্রথম দ্বাদশ পক্তিতে থাকে তিনটি চতুষ্পদী (৪× ৩ = ১২)। মিল বা মিত্রাক্ষর সংস্থান এক পদান্তর পর্যায়ে বিন্যস্ত এবং প্রত্যেক চতুষ্পদীতে দুটি বিভিন্ন স্বরাত্মক মিল থাকে।—শেষ দুই পদে মিত্রাক্ষর পয়ার শেক্সপিয়রের সনেটের বিশেষত্ব। ফলে মিল বিন্যাস দাঁড়ায়—ক-খ-ক-খ : গ-ঘ-গ-ঘ; চ-ছ-চ-ছ;জ-জ। এখানেই শেক্সপিয়রের অবলম্বিত রীতির আঙ্গিকগত স্বকীয়তা। ভাবের দিক দিয়েও কবিতাগুলিতে রয়েছে বিশিষ্টতা। অন্যান্য কবিদের রচনায় প্রেম-প্রকৃতি বর্ণনায় যেখানে প্রথাসিদ্ধ বর্ণনাই প্রথানুগত রীতি সেখানে শেক্সপিয়রের সনেটে পাওয়া যায় তাঁর প্রেম কম্পিত নিগূঢ় হৃদয়ের উন্মোচন। প্রেমিক হৃদয়ের আতপ্ত স্পর্শে কবিতাগুলিকে তৎকালীন অন্যান্য সনেটের চেয়ে বিশিষ্ট করে তুলেছে।

রচনাকাল মোটামুটি ১৫৯৪ থেকে ১৫৯৮, মতান্তরে ১৬০২ খ্রিস্টাব্দ। নাটক রচনার ফাঁকে ফাঁকে কবিতাগুলি রচিত। সনেটের সংখ্যা ১৫৪। ১ থেকে ১২৬টি সনেট কোনো উচ্চবংশ মর্যাদা সম্পন্ন বন্ধু, পৃষ্ঠপোষকের উদ্দেশ্যে রচিত। ১২৭ থেকে ১৫২ সংখ্যক কোনো তন্বী শ্যামায় অর্পিত। অবশিষ্ট দুটি অর্থাৎ ১৫৩ ও ১৫৪, প্রণয় দেবতার প্রথানুরূপ বর্ণনা।

প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে এই সনেটগুলি কি সমসাময়িক কালের নিছক প্রথানুগ রচনা বা Literary exercise, না কবির অন্তর্জীবনের কুহেলিকাচ্ছন্ন ইতিহাসের উদ্ঘাটন। সমালোচকগণের সমর্থন অবশ্য দ্বিতীয়টির প্রতিই। শেক্সপিয়রের সনেট সম্পর্কে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন—with this key Skakespeare unlocked his heart। আবার কবি ব্রাউনিং ভিন্নমতধারী। তিনি বলেছেন— Did Shakespeare ? If so the less Shake speare he ! রহস্যময় পুরুষ কবির হৃদয় রহস্যের পরিচয় এই সনেটে কতটুকু পাওয়া যাবে, অথবা আদৌ যাবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আজও মনবসিত। এরপরের প্রশ্ন কবিতায় সম্বোধিত কে এই নর এবং নারী ?

অধিকাংশ সমালোচকের মতে এই ব্যক্তি হচ্ছেন কবির নাট্যকার জীবনের প্রথম দিকে কবির পৃষ্ঠপোষক এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর্ল অব সাউদাম্পটন্ (Earl of Southampton)। কবির সঙ্গে এই গুণমুগ্ধ অভিজাত ব্যক্তিটির প্রগাঢ় বন্ধুত্ব সামাজিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কবিকে যেমন সহায়তা করেছিল, তেমনি অনেকের ঈর্ষারও কারণ হয়েছিল। স্মরণ করা যায়, এই বন্ধুত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রীতিমুগ্ধ কবি তার দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘ভেনাস এন্ড অ্যাডোনিস’ (Venus and Adonis) এবং ‘দ্য রেপ অব লুক্রিস’ (The Rape of Lucrece) পৃষ্ঠপোষক ও বন্ধুবর আর্ল অব সাউদাম্পটনকেই উৎসর্গ করেছিলেন। প্রণয়মূলক এই প্রথম দিকের সনেটগুলির মধ্যে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি গুণমুগ্ধ কবি হৃদয়ের একান্ত নিবিড় ভালোবাসাকে পরপর স্মরণ করেছেন। বন্ধুর প্রতি তাঁর প্রেম ও সখ্যতা, বিবাহে প্রেরণা, সুন্দর জীবনযাপনে উৎসাহ দান এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুর প্রতি অনুরাগে আনন্দ, বিচ্ছেদ বেদনার মর্মযন্ত্রণা, অভিমানের রূঢ় আঘাত প্রভৃতির মধ্য দিয়ে কবি-মানসিকতার নানা ভাব-বিভঙ্গ ধরা পড়েছে। ধরা পড়েছে কবির ব্যক্তি-হৃদয়।

প্রথমদিকের ১২৬টি সনেট বাদ দিয়ে পরবর্তী ২৬টি সনেট আবর্তিত হয়েছে একজন কৃষ্ণাঙ্গী, তন্বী শ্যামাকে নিয়ে। কে সে, মেরি ফিটন না অন্য কেউ? আর প্রণয় প্রতিদ্বন্দ্বী কবিই বা কে–কবি জনসন না চ্যাপম্যান? এই সব প্রশ্নের সমাধান আজও দূরাপহত। তবে এই শ্যামাঙ্গিনী দ্বি-চারিণী প্রেমিকাকে ঘিরেই কবি মনে আবর্তিত হয়েছে আতপ্ত কামনার অপ্রতিরোধ্য আসত্তি, তার যৌবন মদির রসোচ্ছলতা। সনেটের মধ্য দিয়ে রোমান্টিক ইন্দ্রিয় সংবেদনায় সংরক্ত কবি মনের পরিচয় চিরন্তন হয়ে আছে। চিরন্তন হয়ে আছে মিলনের আনন্দ, বিশ্বাসঘাতকতার জ্বালা ও যন্ত্রণা। কবির কবিতার মধ্য দিয়ে আজও অনামা অপরিচিতা শ্যামাঙ্গিনী চির-জীবিতা।

শেষ দুটি কবিতা ১৫৩ এবং ১৫৪ প্রণয়দেবতা কিউপিডের প্রথানুরূপ বর্ণনা। শেক্সপিয়রের সবগুলি সনেটের মূল রাগ প্রণয়। তা সে কোনো অভিজাত বন্ধুর উদ্দেশ্যেই হোক বা হোক কোন তন্বী শ্যামাঙ্গিনী বা প্রণয়-দেবতা কিউপিড। প্রথার বাইরে বা প্রথানুরূপ যৌবন-বনে পথসন্ধানী প্রেম-ভিখারী কবি হৃদয়ের আনন্দ ও ব্যর্থতার যন্ত্রণা বিজড়িত হয়ে পাঠকের হৃদয়-তটে আজও পদস্যাররত। কবিতাগুলি কোন্‌টি অশ্রুতে সিক্ত, বেদনায় নীল বা প্রণয়াবেগে রক্তিম হয়ে, হয়ে উঠেছে মুক্তাসদৃশ মহার্ঘ, কবির ব্যক্তিহৃদয়ের এই নিবিড় স্পর্শেই কবিতাগুলিকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যতায় খণ্ডিত করে তুলেছে।

বাংলা নাটকের ওপর শেক্সপিয়রের প্রভাব সর্বাধিক। মধুসূদন দত্ত থেকেই মোটামুটি নাটকে এই প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই প্রভাব এসেছে সরাসরি শেক্সপিয়রের নাটকের অনুবাদের মাধ্যমে এবং আধুনিক কালের বাংলা নাটকের আঙ্গিক ও ভাষাশৈলীতে।

বাংলা কবিতায় শেক্সপিয়রের প্রভাব:

বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রেও ঊনবিংশ শতক থেকেই কবিদের অন্তঃশ্চেতনায় শেক্সপিয়র বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন বারবার। গভীর বিশ্বষীক্ষা, জন্মমৃত্যুর রহস্যময় উপলখি, মহৎ জীবন জিজ্ঞাসায় কবি মনকে আকুল করে তুলেছে। তবু তার প্রধান মাধ্যম নাটক। আর কবিগণের ভাবনার মানসিকতায়ও শেক্সপিয়রের নাটকের নানা টুকরো চিন্তাই প্রতিফলিত হয়েছে।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যে ক্লান্তি, বিষাদ, মৃত্যুচেতনা প্রধান সুর হয়ে দেখা দিয়েছে। তবু কবি তিমিরবিলাসী না হয়ে তিমিরবিনাশী হওয়ার বলিষ্ঠ বাসনা প্রকাশ করেছেন এবং সেই মানসিকতার সঙ্গে শেক্সপিয়রের ভাবনার অনুরূপতাই প্রকাশ পেয়েছে। সনেটের প্রথমদিকে কোনো কবি-অনুরাগী, পৃষ্ঠপোষক বন্ধু বা পরবর্তী অংশ কোনো তন্বীশ্যামাকে কেন্দ্র করে কবি শেক্সপিয়রের প্রেম-প্রীতি ভালবাসা, তাঁর পাওয়ার আনন্দ ও না-পাওয়ার বেদনা, দ্বি-চারিণী প্রেমিকাকে কেন্দ্র করে কবির মনের ক্ষোভ, জ্বালা ও প্রেম-কম্পিত হৃদয়ের নানা বর্ণ বিচ্ছুরণ পাঠক মনকে মুগ্ধ করে। দুঃখে তিনি ভেঙে পড়েননি। দুঃখকেই বড়ো করে তোলেননি। তাঁর নাটকের মতো সনেটগুলিতেও তিনি দুঃখকে জয় করেছেন, আশা ও প্রত্যাশা দিয়ে। তাই তিনি তিমিরবিলাসী নন, তিনি বলিষ্ঠ জীবনবাদে তিমিরবিনাশী। জীবনানন্দের কবিতাতেও রয়েছে এই সুর।

শেক্সপিয়রের সনেট কবি বিষ্ণু দে-কেও আকৃষ্ট করেছিল। শেক্সপিয়রের কয়েকটি সনেটের তিনি অনুবাদ করেন এবং এই অনুবাদ বাংলা কাব্যে এক মূল্যবান সংযোজন। তাঁর কবিতায় গভীর বোধেও কবি শেক্সপিয়র বর্তমান।

কবি কৃষ্ণধরের কাছে কবি শেক্সপিয়র সর্বদাই অনুপ্রেরণ। ‘সময়’ কবিতায় শিথিল গ্রন্থিকে জোড়া লাগানোর কথা অনেকটাই শেক্সপিয়রীয়। শেক্সপিয়রের কয়েকটি সনেটের চমৎকার অনুবাদ করেছেন কবি।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের রচিত সনেটে যদিও মহাকবি সৃষ্ট চরিত্র ও নাট্যভাবনা তার কল্পনাকে উজ্জীবিত‌ করেছে, কিন্তু সনেট রচনার আঙ্গিকে ছায়া ফেলেছে শেক্সপিয়রের সনেটের রীতি ও আঙ্গিক।

কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত বেশ কিছু শেক্সপিয়রের সনেটের অনুবাদ করেছেন। শেক্সপিয়রের চতুর্থ জন্ম শতবর্ষকে ঘিরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নতুন করে শেক্সপিয়র চর্চা শুরু হয়েছে এবং বাংলার বিভিন্ন প্রকাশন সংস্থা থেকে অনূদিত শেক্সপিয়র রচনা-সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। এই রচনা-সমগ্রের মধ্যে শেক্সপিয়রের সমগ্র সনেটের বাংলা অনুবাদ একটা বিশেষ স্থান জুড়ে আছে।

শেক্সপিয়রের নাটকাবলী এবং তাঁর সমগ্র সনেটগুচ্ছ একই মহাকবির কলমে সৃষ্ট। তাঁর নাটক যে কবিমন সৃষ্টির পশ্চাৎপটে বিদ্যমান, সনেটের মধ্য দিয়ে তা সোজাসুজি পাঠকের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাঠক তাঁর প্রেম ও প্রেমহীনতা, একান্ত করে চাওয়া ও একান্ত ছেড়ে যাওয়া, আশা ও আশঙ্কায় দোদুল্যমান মানসিকতার সহযাত্রী হন। কবির হৃদয় দুয়ার খুলে যায়, পাঠকের সঙ্গে হয় নিবিড় কোলাকুলি। এই প্রসঙ্গে মরমী কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঠিক মূল্যায়ন স্মর্তব্য— with this key Shakespeare unlocked his heart: শেক্সপিয়রের অন্তরকে অনাবৃত করার এই সনেটরূপী কুণ্ঠিকাই বাংলার কবিমনকে বারে বারে আকৃষ্ট করেছে। শেক্সপিয়রের নাটকের ক্ষেত্রে বহু আগে হলেও তাঁর সনেট-চর্চার মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক কালের কবিগণের এই প্রচেষ্টা শুভ ইঙ্গিতবাহী।