পঞ্চদশ শতকের পূর্বে যাজকগণ ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে একশ্রেণির নাটক অভিনয় করতেন। তার কিছুটা হত বাইবেলের কাহিনী নিয়ে, তাকে বলা হত ‘মিষ্টি প্লে’ (Mystery Play), কতকগুলি সাধুসন্তদের অলৌকিক কীর্তিকলাপ নিয়ে, এগুলিকে বলা হত ‘মিরাকল গ্লে’ (Miracle Play), আর নৈতিক আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত নাটকগুলির নাম ছিল ‘মরালিটি প্লে’ (Morality Play)। এই ‘মরালিটি প্লে’ বা নীতি-নাটকেরই অনুষঙ্গরূপে নাটকের মধ্যবর্তী অংশে বা অবকাশ পুরকরূপে অভিনীত এবং অনেকাংশে প্রহসন জাতীয় ছোট্ট নাটিকাকে বলা হত ইন্টারল্যুড (Interlude)। হাস্যপরিহাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে এই নাটিকা রচিত হত।
পঞ্চদশ শতকে বিদ্যানুশীলনের (revival of learning) যুগে (১৪০০-১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) এসে ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের প্রেরণায় ক্লাসিক্যাল নাটক রচনার চেষ্টা শুরু হয়। তবে এঁরা অনুসরণ করেছিলেন গ্রিক নাটক নয়, এঁদের আদর্শ ছিল ল্যাটিন নাটক। ল্যাটিন নাটকের বিধিবিধান নির্দেশ করে গেছেন রোমান মনীষী সেনেকা (Seneca)। এঁরা তাঁরই নির্দেশ অনুসরণের চেষ্টা করেছেন। উড্ল, স্যাক্ভিল প্রমুখ এই নাট্যকারগণ সকলেই ছিলেন পণ্ডিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই এঁদের গোষ্ঠী-পরিচয় ছিল ‘ইউনিভারসিটি উইটস’ (University Wits ) হিসেবে।
এরই পাশাপাশি আর একদল নাট্যকার নাটকে ক্লাসিক নাটকের বিধিবিধান অর্থাৎ স্থান, কাল, ঘটনা ঐক্য নিয়ে ত্রি-ঐক্যসূত্র মেনে চলেননি। জীবনের ও ঘটনার স্বাভাবিক বিকাশ দেখাতে হলে কাহিনী ও চরিত্রকে যে ভাবে উপস্থাপিত করা দরকার তাই তাঁরা করেছেন। এঁরা হলেন লিলি, কিড্, মার্লো প্রভৃতি। শেক্সপিয়রও অল্পাধিক এঁদের দ্বারা প্রভাবিত। এলিজাবেথের যুগের (১৫৫০-১৬২০ খ্রিঃ) প্রথমদিকের নাট্যকার হিসেবে এঁদের চিহ্নিত করা যায়।
এলিজাবেথের যুগকে (১৫৫০-১৬২০ খ্রিঃ) বলা হয় রেনেসাঁস বা নবজাগরণের যুগ। এই যুগের দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র—কাব্যে স্পেন্সার (Spencer) এবং নাটকে শেক্সপিয়র। নাটক ছাড়াও শেক্সপিয়র যে-সব কাব্য-কবিতা লিখেছিলেন তাঁর মধ্যে আছে দু’খানি আখ্যান কাব্য—’ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস’ (Venus and Adonis) এবং ‘দ্য রেপ অব্ লুক্রিস’ (The Rape of Lucrece)। আর রয়েছে ১৪৪টি চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট। এর মধ্যে কতকগুলি সনেট তাঁর কোনো বন্ধুর উদ্দেশ্যে, আর কতকগুলি প্রেম কবিতা, কোনো নারীর উদ্দেশ্যে রচিত।
কাল বিচারে শেক্সপিয়রের নাটকগুলিকে সমালোচকেরা চারটি পর্বে ভাগ করেন। প্রথম পর্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ। সময়কাল ১৫৯১ থেকে ১৫৯৬ খ্রিঃ। এই সময়ে রচিত নাটকের সংখ্যা চৌদ্দ। উচ্ছ্বাস ও কল্পনার উদ্দামতা, ভাষার আড়ম্বর, অমিত্রাক্ষর ছন্দের সঙ্গে মিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ এই পর্বের বৈশিষ্ট্য। তাঁর নাট্যজীবন শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক নাটক দিয়ে। এর সঙ্গে রয়েছে রোমান্সধর্মী নাটক। এই নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখ্য নাটকগুলি হচ্ছে— ‘হেনরি দ্য সিক্সথ’ (Henry VI-Part 1 to 111), ‘রিচার্ড দ্য থার্ড’ (Richard III), ‘রিচার্ড দ্য টু’ (Richard II), ‘কিং জন’ (King John), ‘লাভস্ লেবারস্ লষ্ট’ (Love’s Labour’s Lost), ‘দ্য কমেডি অব এরর্স’ (The Comedy of Errors), ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ (Romeo and Juliet), ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ (The Mer chant of Venice), ‘মিত্সামার নাইটস্ ড্রিম’ (A Midsummer Night’s Dream), ‘দ্য টেমিং অব দ্য শু’ (The Taming of the Shrew) প্রভৃতি।
দ্বিতীয় পর্ব (১৫৯৭-১৬০০ খ্রিঃ) হচ্ছে শেক্সপিয়রের রচনাশক্তির বিকাশ পর্ব। এই পর্বে রচিত নাটকের সংখ্যা আট। এই সময়ের উল্লেখ্য নাটকের মধ্যে দুই খণ্ডে রচিত ‘হেনরী দ্য ফোর্থ” (Henry IV Part I & Part 11), ‘হেনরী দ্য ফিথ’ (Henry V). ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ (As You Like It), ‘জুলিয়াস সীজার’ (Julius Cesar) ইত্যাদি উল্লেখ্য।
তৃতীয় পর্ব (১৬০০-১৬০৮ খ্রিঃ) হচ্ছে শেক্সপিয়রের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ পর্ব। তবে এই সময়ে লেখা তাঁর সব নাটকেই বেজেছে দুঃখের সুর, মানসিকতার দিক থেকে একটা হতাশা ও বিষাদময়তা যেন নাট্যকারের মনকে আচ্ছন্ন করেছিল। শেক্সপিয়রের তথা বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডিগুলি এই পর্বেই লিখিত। এই পর্বে রচিত নাটকের সংখ্যা দশ। এই সময়ের নাটকগুলির মধ্যে ‘হ্যামলেট’ (Hamlet, Prince of Denmark), ‘ওথেলো’ (Othello), ‘কিং লিয়ার’ (King Lear), ‘ম্যাকবেথ’ (Macbeth) এবং টুয়েলথ নাইট’ (Twelfth Night or What You Will), ‘টিমন অব এথেন্স’ (Timon of Athens), ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’ (Antony and Cleopatra) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
চতুর্থ বা অন্তপর্বেও (১৬০৮-১৬১১ খ্রিঃ) শেক্সপিয়রের পরিণত প্রতিভার নিদর্শন পরিস্ফুট। দুঃখের তীব্রতা এই পর্বে প্রশমিত এবং শিল্পী-হৃদয়ের প্রশান্তিও এই অংশে লক্ষ্য করা যায়। এই পর্বের নাটকে রীতি ও আঙ্গিকেও এসেছে পরিবর্তন। এই সময়ের নাটকগুলিকে প্রধানত রোমান্স বলা যায়। তাঁর ট্র্যাজেডির দৃঢ়পিনদ্ধ শিল্পরূপ এই পর্বের কাব্যে অনুপস্থিত। তবে ড. টিলিয়ার্ড প্রমুখ সমালোচকের মতে শেক্সপিয়রের শেষ নাটকসমূহ প্রাণস্পন্দনে, ছন্দোবন্ধে, উপমারুপকের অভিনবত্বে ও কাব্যিক উৎকর্ষে অপরূপ শিল্পসৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। এই পর্বে রচিত নাটকের সংখ্যা পাঁচ। এই নাটকগুলির মধ্যে ‘দ্য উইন্টার্স টেল’ (The Winter’s Tale), দ্য টেম্পেষ্ট’ (The Tempest), ‘কিং হেনরী দ্য এইটুথ’ (King Henry VIII) উল্লেখ্য।
তাঁর রচিত শেষ পর্যায়ের নাটক হচ্ছে ‘টেম্পেষ্ট’। এই নাটকের নায়ক প্রসপেরো যেমন নাটকের অস্তিমে তাঁর জাদু (magic) জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে সবাইকে ক্ষমা করে ও ক্ষমা চেয়ে তাঁর পূর্বের জমিদারী (dukedom) মিলানে ফিরে গেলেন, তেমনি নাটক রচনা ও নাটক জগৎটাকে বিদায় জানিয়ে শেক্সপিয়রও ফিরে গেলেন তাঁর নিজের জন্মস্থান, তাঁর দেশের বাড়ী স্ট্র্যাটফোর্ডে। দেশে ফিরে জীবনের পরবর্তী দিনগুলিতে তিনি আর কোনো নাটক লেখেননি।
উপরোক্ত কালবিভাগ বা পর্ববিভাগ ছাড়াও কোনো কোনো সমালোচক শেক্সপিয়রের নাটকগুলিকে ঐতিহাসিক নাটক, রোমান নাটক বা রোমান প্লে, ক্লাসিক্যাল নাটক, রোমান্টিক নাটক, প্রব্লেম বা সমস্যামূলক নাটক প্রভৃতি ভাগে ভাগ করেছেন।
বিষয়বস্তু বা ভাববস্তুর দিক থেকে আবার কেউ কেউ তাঁর সমগ্র নাটককে তিন ভাগে ভাগ করেছেন—ঐতিহাসিক, ট্র্যাজেডি ও কমেডি।
রসপরিণতি বা ভাবপরিগতির দিক দিয়ে দুটি মোটা দাগেও শেক্সপিয়রের নাটকসমূহকে বিভক্ত করা যায়— ট্র্যাজেডি ও কমেডি। এবং শেক্সপিয়রের নাটকের পরিণতি বা ফলশ্রুতির দিকে তাকিয়ে তাঁর সমস্ত নাট্যসৃষ্টিকেই হয় ট্র্যাজেডি নয় কমেডি নামে আখ্যাত করতে পারা যায়।
Leave a comment