শেক্সপিয়রের জীবনকথা :
শেক্সপিয়রের জীবন তাঁর অমর রচনাবলীর মতোই যুগ যুগ ধরে পাঠকমনে অনন্ত বিস্ময় ও রহস্য সৃষ্টি করে চলেছে। দীর্ঘকালের পথ পেরিয়ে আজও সেই রহস্য উন্মোচনে পাঠকমন ক্লান্তিহীন। রহস্যমণ্ডিত আপন সৃষ্টির মতোই স্রষ্টার নিজের জীবনও রহস্যে ঘেরা। শেক্সপিয়রের নিজের জীবনেরও যেমন অনেক কথাই জানা যায়, তেমনি জানা যায় না আবার অনেক কথাই। তাই এই মানুষটিকে ঘিরেও বিস্ময়ের অন্ত নেই। নাট্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে তাঁর কোথায়, কীভাবে হাতেখড়ি হয়েছিল, তা’ আমাদের কাছে অস্পষ্ট। মাত্র আঠার বৎসর বয়সে বিয়ে করেছিলেন ছাব্বিশ বছরের এক রমণীকে। তাই বা কেন? বিয়ের পর এবং লন্ডনে আসার আগের কয়েকটি বছর তিনি কী করেছিলেন তাও সুস্পষ্ট নয়। লোকটিই বা কেমন ছিলেন? গৃহস্থ না সাধুসন্ত? ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো আত্মস্থ, কোলরিজের মতো স্বপ্নবিলাসী, কীটসের মতো সৌন্দর্যপিয়াসী, শেলীর মতো বিদ্রোহী, অথবা কোনোটাই নয়। সাংসারিক জীবনে তিনি কি ছিলেন বেহিসেবী, না অতি-হিসেবী, না ব্যবসাপত্তর ভালই বুঝতেন? তাঁর সনেটে উল্লেখিত ‘ডার্ক লেডী’ বা শ্যামাঙ্গনার মতোই তাঁর নিজের জীবনের বহু কথাই আজও অলিখিত, রহস্যাবৃত। সৃষ্টির মধ্য দিয়েও স্রষ্টাকে ধরার উপায় নেই। আপন সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টা শেক্সপিয়র নিজেকে প্রকাশ করেছেন এ কথাটা যেমন সত্য, তেমনি আপন সৃষ্টির বাল্মীকিস্তূপে তিনি নিজেকে গোপন রেখেছেন এ কথাটিও তেমনি সত্য।
তবু শেক্সপিয়রের জীবনকথার যে রেখারুপটির পরিচয় পাওয়া যায়, তা হচ্ছে এই—উইলিয়ম শেক্সপিয়র (William Shakespeare)-এর জন্মকাল ২৩শে এপ্রিল, ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ। স্থান, অ্যাভন নদীর ধারে, ওয়ারউইকশায়ারের অন্তর্ভুক্ত স্ট্র্যাফোর্ড-অন-অ্যাডন (Stratford-on-Avon) নামক ছোট্ট শহর। বাবা জন শেক্সপিয়র (John Shakespeare), মায়ের নাম মেরী আর্ডেন (Mary Arden)। বাবা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিছুদিন স্ট্র্যাটফোর্ড শহরের মেয়রও ছিলেন। মা-ও ছিলেন সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে।
সাত বছর বয়সে শেক্সপিয়র তাঁর ছোট ভাই গিলবার্ট (Gilbert)-এর সঙ্গে ওই শহরের পাঠশালাতে (Free Grammar School) ভর্তি হন। সেখানে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় তাঁর হাতেখড়ি হয়। কিন্তু লেখাপড়া তাঁর বেশিদূর এগোল না। ব্যবসায়ে পিতার আর্থিক দুরবস্থার কারণে তাকে বিদ্যালয় ছেড়ে ব্যবসায়ে বাবার সাহায্যে এগিয়ে আসতে হল। শিক্ষাগ্রহণে তাঁর পরবর্তী পাঠশালা হচ্ছে এই বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবজীবন। জীবনের খোলাপাতা থেকেই তিনি তাঁর পাঠগ্রহণ করেন।
আঠার বছর বয়সে তিনি বিবাহ করেন তাঁর চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড়ো এক মহিলাকে। নাম অ্যান হাথাওয়ে (Anne Hathaway)। বিয়েটা হয় বেশ তাড়াহুড়ো করেই। প্রায় এই সময়েই আর একটা ঘটনা ঘটে, যার ফলে তাঁকে পালিয়ে আসতে হয় লন্ডনে। ঘটনাটি হচ্ছে—স্যার টমাস লুসি নামে এক প্রতিবেশী জমিদারের বাগান থেকে হরিণ চুরির অপরাধে তিনি ধরা পড়েন। বিচারে তাঁর প্রতি বেত্রদণ্ড ও কারাবাসের আদেশ হয়। শাস্তি এড়াতে ‘যঃ পলায়তি সঃ জীবতি’ নীতি অনুসরণে পালিয়ে তিনি হাজির হলেন লণ্ডনে। পরবর্তীকালে শেক্সপিয়র তাঁর রচিত ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’ নাটকে জাস্টিস শ্যালো চরিত্রের মধ্য দিয়ে তাঁর মনের পুরানো ঝাল মিটিয়েছেন। কিন্তু শেক্সপিয়রের অমর লেখনীর স্পর্শে সেই চরিত্রটির মধ্যে ওই গ্রাম্য জমিদারটিও অমর হয়ে আছেন।
১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শেক্সপিয়র আসেন লণ্ডনে। প্রায় পরিচয়হীন যুবক কাজ পেলেন, সে কাজ হচ্ছে গ্লোব থিয়েটারে অশ্বরক্ষকের কাজ। থিয়েটারে যেসব ধনী দর্শক এবং অভিনেতারা ঘোড়ায় চড়ে আসতেন, প্রবেশপথের মুখে তাঁদের ঘোড়ার দেখভাল করার কাজ। কিন্তু থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এই সুড়ি-পথই যে তাঁকে একদিন রাজপথে নিয়ে যাবে তা কি তিনি জানতেন? থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থিয়েটার সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল বাড়তে থাকল। ক্রমে ক্রমে তাঁর ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছোটোখাট ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ দিতে লাগলেন। এইভাবেই থিয়েটারের বাইরের অঙ্গন থেকে তিনি ক্রমে ঠাই করে নিলেন থিয়েটারের অন্তঃপুরে। তাঁর কাজে তুষ্ট হয়ে, তাঁর গুণপনার পরিচয় পেয়ে, থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ ক্রমে তাঁকে পুরানো নাটক বা অভিনয়ের জন্য উপস্থাপিত নাটককে কাজ চালানোর উপযোগী পরিমার্জনার (cobbling) কাজেও নিযুক্ত করলেন। এই কাজ করতে গিয়েই নাটকের প্রয়োগকুশলতা সম্পর্কে শেক্সপিয়র অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ লাভ করলেন। এইভাবে নাটক রচনায় প্রাথমিকভাবে তাঁর হাতেখড়ি হল। ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তাঁর স্বকীয় নাট্য রচনার সূত্রপাত। ক্রমে তাঁর নাটক রচনার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এই খ্যাতি সমসাময়িক কোনো কোনো নাট্যকারের ঈর্ষারও কারণ হয়েছিল। সমসাময়িক এক নাট্যকার রবার্ট গ্রীন (Robert Green, ১৫৫৮-৯২ খ্রিস্টাব্দ) তো বলেই বসলেন— “এই ভুঁই-ফোঁড় দাঁড়কাকটি আমাদেরই পালক গুঁজে ময়ূর সেজেছেন।” তিনি মোট সাঁইত্রিশটি নাটক রচনা করেন, এই নাটকগুলি বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
শেক্সপিয়রের খ্যাতি যেমন অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়েছিল, তেমনি তিনি বহুজনের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাও পেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে আর্ল অব সাউদাম্পটন (Earl of Southampton)-এর সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কথা উল্লেখযোগ্য। এই সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের নামেই তিনি তাঁর Venus and Adonis এবং The Rape of Lucrece নামক কবিতা দুটি উৎসর্গ করেন। তাঁর রচিত ১৫৪টি সনেটের মধ্যেও কতকগুলি সনেট তাঁর এই শ্রদ্ধেয় বন্ধুর উদ্দেশ্যে লিখিত। অবশিষ্ট কতকগুলি প্রেমকবিতা কোনো এক শ্যামাঙ্গনার (dark lady) উদ্দেশ্যে লিখিত। তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে তাঁর নিজের উক্তিই উদ্ধৃত করে বলা যায় :
“Nor marble nor the glided monuments
Of Princes shall outline this powerful rhyme.”
শেক্সপিয়রের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র হ্যামনেট (Hamnet) এর মৃত্যু হয়। ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রাসাদোপম বাড়ী ক্রয় করেন। নিজের জন্মস্থান স্ট্র্যাফোর্ড-এও প্রচুর ভূ-সম্পত্তি কেনেন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের অভিনয় জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি তাঁর জন্মস্থানে ফিরে যান। জীবনের শেষ কয়বছর সেখানেই তাঁর অতিবাহিত হয়। খ্যাতি, সমৃদ্ধি ও শান্তির মধ্যেই ২৩শে এপ্রিল ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মহাকবির জন্মদিন এসে মিশে যায় মৃত্যুদিনের সঙ্গে। স্ট্র্যাটফোর্ড চার্চেই দেওয়া হয় মরদেহের সমাধি। তাঁর সমাধি-ফলকে কবির স্বরচিত নিম্নোদ্ধৃত কয়েকটি পক্তি লিখিত আছে :
“Good friend, for Jesus” sake forbear
To dig the dust enclosed here:
Blest be the man that spares the stones.
And crust be he that moves my bones.”
শেক্সপিয়রের নাট্য-সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য:
রানী এলিজাবেথের যুগ ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ। ধর্মে-কর্মে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, সাম্রাজ্য ও সাগরের একাধিপত্যে এই যুগেই ইংল্যান্ড ইউরোপের মধ্যে আপনার বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছে। বহুদিনের নিদ্রার পর জাতি যেন জেগে উঠেছে সহস্রবিধ চরিতার্থতায়। সেই প্রাণের বিচিত্র প্রকাশ ধরা পড়েছে সাহিত্যে কবিতায় নাটকে। নতুন নাট্যজাগরণের ও নাট্যশালার উদ্ভবের পিছনেও ছিল এই আত্মপ্রকাশের প্রয়াস।
পূর্ববর্তী কালের নাট্যরচনায় ক্লাসিক্যাল নাটকের রীতি পুরোপুরি মেনে চলা হত। এক্ষেত্রে গ্রিক ও ল্যাটিন নাটকের স্থান, কাল ও ঘটনাগত ঐক্য নিয়ে ত্রি-ঐক্য (Three unity) সূত্র ট্যকারগণ মেনে চলতেন। এলিজাবেথের যুগেই নাটক রচনার ক্ষেত্রে ইংরেজ নাট্যকারদের স্বকীয় ভাবনার অঙ্কুর দেখা গেল। শেক্সপিয়রের পূর্বসুরী হিসেবে নাট্যকার জন লিলি, টমাস কিড্, জর্জ পীল, রবার্ট গ্রীন, ক্রিস্টোফার মার্লো প্রমুখ নাট্যকারগণ ক্লাসিক্যাল নাটকের ‘ত্রি-ঐক্য সূত্র’ না মেনে নাটকে নতুন রীতির প্রবর্তন করলেন। কাহিনীর চরিত্রের স্বাভাবিক বিকাশ দেখাতে গিয়ে, যেভাবে তাকে উপস্থিত করা দরকার, সেই প্রয়োজনের পদ্ধতিকেই নাটকে উপস্থাপিত করলেন। গ্রিক বা রোমান নাটকের ক্ল্যাসিক্যাল পদ্ধতির একেবারে অনুকরণ নয়, গড়ে উঠল রেনেসাঁস ভাবনা-চিন্তাসম্পন্ন ইংরেজি নাটক।
পূর্বসুরী নাট্যকারগণ যার সূচনা করে গেলেন তার পরিশীলিত ও পূর্ণাঙ্গ রূপ দিলেন শেক্সপিয়র। ইংরেজি নাটকে এই নতুন রীতির তিনি প্রবর্তক না হলেও তিনি এই রীতির পরিণত তথা সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী।
পূর্বতন ক্লাসিক্যাল পদ্ধতি অনুযায়ী ট্র্যাজেডি ও কমেডির স্পষ্ট পার্থক্য তিনি মানেননি। তাঁর ট্র্যাজেডি ও কমেডি অপূর্ব। কমেডির হাসির কলরোলের মধ্যেই কোথাও বা বিষাদের সুর, আবার ট্র্যাজেডির চরম বেদনাবোধের পাশেই রয়েছে হাসির শুভ্র অশ্রুপাত। পাপীকে নিয়ে ট্র্যাজেডির নায়ক রচনা অ্যারিস্টটল মেনে নেননি অথচ পাপী যখন পাপকে মহত্তর আর্টের বিশালতায় নিয়ে যায়, তখন তার মধ্যে চরিত্রের আভিজাত্য দেখা যায়। একথা মেনে নিয়ে শেক্সপিয়র সৃষ্টি করেছেন তৃতীয় রিচার্ডকে। ফরাসি ক্লাসিক্যাল নাটকে আছে চরম সরলতা—কমেডির মধ্যে ট্র্যাজেডির ছায়া মাত্র নেই, আবার ট্র্যাজেডির মধ্যে হাস্যরসের অবতারণা নিষিদ্ধ। কিন্তু শেক্সপিয়রের নাটকে দেখি অপূর্ব জীবনপ্রীতি—সেখানে হাসি ও অশ্রু যেমন নির্বিচারে মিশেছে, তেমনি মিশেছে ইতিহাসের গম্ভীর পরিবেশের মধ্যে অপূর্ব হাস্যরস।
দ্বিতীয়ত, কাহিনী উপস্থাপনার দিক থেকে দেখা যায় ক্লাসিক্যাল নাটকে (গ্রিক নাট্যকলায়) কাহিনীর যেখানে আরম্ভ হয়েছে সেখানেই ঘটনা অনেকখানি অগ্রসর হয়ে গেছে। গ্রিক নাটকে প্রায়শ দৈবনিগ্রহ বা কোনো মহাপাপের ফলে নায়কের পতনটুকুই দেখানো হয়। সেখানে গল্পের উপস্থাপনার মধ্যে যা চমৎকারিত্ব, তা হল, এক বিশেষ ধরনের Dramatic Irony প্রয়োগে। আসন্ন সর্বনাশ সম্পর্কে নায়ক অচেতন থাকলেও দর্শকেরা নিয়তির নেপথ্য খেলাটিকে বুঝে নায়কের নিশ্চিত সর্বনাশ জানে এবং নায়কের জন্য দর্শক দুঃখবোধ করে। কিন্তু শেক্সপিয়রের নাটকে কোনো কাহিনীর অংশমাত্র নাট্যবিষয়রূপে গৃহীত হয় না। সম্পূর্ণ নাট্যকাহিনীই প্রথম থেকে বিবৃত ও ব্যাখ্যাত হয়। কাহিনীর মধ্যে বিরোধের বীজ বপন প্রথম থেকেই করা হয় এবং নাটকের প্রায় মধ্য অংশে তাকে তীব্রতম পর্যায়ে (climax) নিয়ে গিয়ে অবশেষে নাটকের কাহিনী পরিণামের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। পূর্বতন ধারা থেকে এখানেই শেক্সপিয়রের স্বকীয়তা।
তৃতীয়ত, চরিত্রসৃষ্টির কৃতিত্বই শেক্সপিয়রের নাট্যপ্রতিভার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মানব-মনের বৈচিত্র্যময় গভীর রহস্যকে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলার মধ্যেই ছিল তাঁর নাট্য রচনার কৃতিত্ব। তাঁর অঙ্কিত চরিত্রগুলির সকলের সঙ্গেই ছিল তাঁর গভীর সহমর্মিতা। কাউকেই তিনি তুচ্ছ বা হেয় বলে দূরে সরিয়ে রাখতেন না, কাউকেই তিনি ঘৃণা করতেন না। ফলে সমস্ত শ্রেণির মানুষ সম্পর্কেই একটা ব্যাপক অভিজ্ঞতা তিনি সঞ্জয় করেছিলেন। আর এই অভিজ্ঞতাই তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলিকে, তাঁর ঘটনাগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলতো। নাটকে অবলম্বিত ঘটনাগুলিকে তাঁর চরিত্রগুলির ক্রম পরিণতি দেখাবার জন্যই তিনি গ্রহণ করতেন।
চতুর্থত, ভাষা প্রয়োগে শেক্সপিয়রের অনন্যসাধারণ কুশলতা দেখা যায়। নাটকে তাঁর ব্যবহৃত সংলাপের ভাষা গদ্য ও পদ্য। শেক্সপিয়রের ভাষা সম্পর্কে সমালোচক বলেছেন, এ ভাষায় রয়েছে ‘spirit of aggression’ এবং ‘disturbing to his own generation’। শেক্সপিয়রের ভাষার এই aggression-ই পাঠক ও দর্শককে তাঁর রচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যায় এবং ভয়ানকভাবে পাঠকমনকে disturb করে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ নৌকার মতো আমাদের মনকে উথাল-পাতাল করে দেয়, দুমড়ে মুচড়ে দেয় বুকের মধ্যেকার সবটা। তাঁর নাটকে ব্যবহৃত গদ্য ও পদ্য উভয় সম্পর্কেই এ কথাটা সত্য। তিনি তাঁর প্রধান প্রধান চরিত্রগুলির মুখে নাটকের এক একটি চরম মুহূর্তে যে অপূর্ব চিন্তা সমৃদ্ধ ও আবেগময় উক্তি দিয়েছেন তা দর্শক ও পাঠককে সম্মোহিত করে। তাঁর ব্যবহৃত গদ্য পদ্য, এর গ্রাম্যতা, শহুরেপনা, এই শালীনতা অশ্লীলতা, বেদনার আনন্দের ভাষা, ঠাট্টা ইয়ারকি পাগলামির ভাষা, দুরন্ত প্রেমের ভাষা, প্রথম যৌবনের উচ্ছ্বাস বা বার্ধক্যের অভিজ্ঞতার মর্মকথা—সব রয়েছে এই নাটক কয়টিতে। শেক্সপিয়রের নাটকের গদ্য প্রবন্ধ বা উপন্যাসের গদ্য নয়। তা হল নাটকীয় গদ্য। গদ্য সংলাপের মধ্য দিয়ে একদিকে পরিবেশ এবং বক্তার চরিত্র উভয়ই ফুটে ওঠে। আবার এই গদ্যও দুরকমভাবে ব্যবহৃত হয়েছে—কমেডিতে একরকম, ট্র্যাজেডিতে অন্যরকম। শেক্সপিয়র ব্যবহৃত পদ্যে রয়েছে অমিলাপদ্য ও ব্ল্যাঙ্ক ভার্স। তাঁর এই পদ্যময় ভাষাও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই পদ্যও নাটকীয় পদ্য। তাঁর বিখ্যাত স্বগতোক্তিগুলির মধ্য দিয়ে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নাট্যকার অমূল্য সব কবিতা উপহার দিয়েছেন। এখানে নাট্যকার শেক্সপিয়র কবি ও দার্শনিক শেক্সপিয়রের সঙ্গে একাসনে বসেছেন।
পঞ্চমত, নাটকের বিষয় বৈচিত্র্য সম্পাদনেও শেক্সপিয়রের প্রতিষ্ঠা স্মরণীয়। বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে ভিন্নমুখী বিষয়সমূহ গ্রহণ করেও পরিবেশনে সমান পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। জাতীয় ইতিহাস, ট্র্যাজেডি, কমেডি, রোমান্টিক কাহিনী, রূপকথার গল্প—যে বিভাগই তিনি স্পর্শ করুন তাঁর প্রতিভার স্পর্শে সেই মৃন্ময় বিষয়ও হয়ে উঠেছে চিন্ময়। শুধু ভিন্ন ভিন্নমুখী নাটক রচনাতেই নয়, একই নাটকের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন গুণের সমাবেশও ঘটিয়েছেন। তাঁর কোনো দুইটি চরিত্রই একরকম হয়ে ওঠেনি এবং সেইদিক দিয়ে ‘পুনরুক্তিবদাভাস’ তাঁর নাটকে নেই। এই কথাটাও কম কথা নয়।
ষষ্ঠত, নাটকের আঙ্গিক রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর বৈচিত্র্যময় প্রতিভার ফলে নাটকগুলি কোথাও গতানুগতিক বা একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি। গ্রিক নাট্যকারদের নাট্যরচনায় স্বাধীনতা বিশেষ ছিল না। বাঁধাধরা নিয়মের মধ্য দিয়েই তাঁদের নাটক রচনা করতে হত। কিন্তু শেক্সপিয়র বাঁধাধরা কোনো কৃত্রিম নিয়মের বন্ধন মেনে, তাঁর রচনাকে নীরস ও প্রাণহীন করেননি। আঙ্গিকের প্রয়োজনে নাটক নয় নাটকের প্রয়োজনেই আঙ্গিককে তিনি ব্যবহার করেছেন। নাটকে ঘটনা ও চরিত্রের চরম পরিণতি সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে তিনি স্বাধীনভাবে আঙ্গিকের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।
নাটকের ক্ষেত্রে শেক্সপিয়রের এই বৈশিষ্ট্যগুলি শুধু তাঁকেই বিশিষ্ট করেনি, পরবর্তীকালের নাট্যকারদের কাছে এই বৈশিষ্ট্যগুলি দিক্দর্শকেরও কাজ করেছে এবং নাট্যজগতে ক্লাসিক্যাল ধারার পাশাপাশি নতুন ধারারও প্রবর্তন করেছে। ধীরে ধীরে রেনেসাঁস যুগে শেক্সপিয়র অনুশীলিত এই ধারাই পরবর্তীকালে ইংরেজি তথা বিশ্বের নাট্যরচনার ইতিহাসে প্রধান ধারা হয়ে দেখা দিয়েছে।
Leave a comment