ইংরেজি সাহিত্যে রেনেসাঁস (Renaissance) কোন্ যুগে হয়েছিল? এই যুগলক্ষণের পরিচয় দাও।

ইংরেজি সাহিত্যে রেনেসাঁস বা নবযুগ বলা হয় রানী এলিজাবেথের যুগকে। এই যুগকাল ১৫৫০ থেকে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। এলিজাবেথীয় যুগ এককথায় ইংরেজি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ রূপে চিহ্নিত। এই যুগের দুই উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হলেন এডমন্ড স্পেন্সার (Edmund Spencer) এবং উইলিয়াম শেক্সপিয়র (William Shake speare)।

ইংরেজি সাহিত্য রেনেসাঁস পর্বে এসে প্রাচীন সংস্কারকে দূরে ফেলে মানুষের জয়গানে মুখর হল। অধ্যাত্ম চেতনার আলোকে জীবনকে প্রতিভাত করার চেয়ে বাস্তব সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সুন্দর-অসুন্দর, প্রাপ্তি-বিনষ্টির কথা বলা শুরু করল। গোষ্ঠী-নির্ভরতা অতিক্রম করে একক ব্যক্তিত্বের ছায়াপাত ঘটল। মধ্যযুগীয় সংস্কারের বিরোধিতা, জীবনমুখীনতা, বাস্তববোধ এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এই যুগের অন্যতম লক্ষণ রূপে স্বীকৃত হল। সুদূরের প্রতি, দুর্গমের প্রতি আকর্ষণ, দুঃসাহসিক অভিযান, নাবিকদের সমুদ্রযাত্রা, অজানাকে জানার অদম্য স্পৃহা, জীবনের প্রতি অপ্রমেয় ভালোবাসাই হল এই যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

এডমন্ড স্পেন্সারকে রেনেসাঁস যুগের অন্যতম কবি বলা হয় কেন?

এলিজাবেথীয় যুগের কাব্য ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হলেন কবি এডমন্ড স্পেন্সার (১৫৫২-৯৯ খ্রিঃ)। তাঁর কাব্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মানবতা। বিশ্বকে জানার অদম্য তৃষ্ণা। তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘ফেয়ারী কুঈন’ (Faerie Queene) -এ নীতিহীনতার বিরুদ্ধে নাইটদের অভিযান, সংগ্রাম ও মানবতা প্রতিষ্ঠা কল্পে অজস্র চিত্র তুলে ধরেছেন। চসারের ‘ক্যান্টারবেরী টেলস’-এর সঙ্গে এর পার্থক্য হল এখানে অনুপুঙ্খভাবে মানবজীবনচর্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে কাব্যশৈলীর অপূর্ব কল্পনাবিলাসে। কিন্তু কল্পনা থেকে জাত হলেও এর মধ্যে দিয়ে জীবনমুখীনতা, বাস্তববোধ, ঈশ্বরের কৃপালিপ্সুতার চেয়ে মানুষের কর্ম ও শ্রমলব্ধ ফলের দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করানো হয়েছে। মধ্যযুগের সংস্কারাচ্ছন্নতার পর তার কাব্য পার্থিব আশা-নিরাশার কথা বলেছে কালজয়ী ভঙ্গিতে। এইজন্যে তাঁকে রেনেসাঁস যুগের অন্যতম কবি বলা হয়ে থাকে। তাঁর রচিত কাব্যগুলির মধ্যে ‘শেফার্ডস্ ক্যালেন্ডার’ (Shepheard’s Calen dar), ‘ফেয়ারী কুঈন’ (Fuerie Queene), ‘অ্যামোরেটি’ (Amoretti) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

উইলিয়াম শেক্সপিয়র নাট্যজগতে প্রবেশ করলেন কীভাবে?

আর্থিক ও পারিপার্শিক ঘটনার চাপে, বাইশ-তেইশ বছরের যুবক শেক্সপিয়র চলে আসেন লন্ডনে (১৫৮৭)। লন্ডনে এসে শুরু হয় আত্মপ্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রাম। প্রায় ছ’বছর ধরে অনেক শ্রমসাধ্য কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। এই সময়েই তিনি কাজ পেয়েছিলেন গ্লোব থিয়েটারে অশ্বরক্ষকের। থিয়েটার দেখতে আসা ধনী দর্শকের ঘোড়া সামলাতে হত তাঁকে। থিয়েটারের কাছাকাছি অবস্থান করে থিয়েটার সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল বাড়তে থাকে। ক্রমে তার প্রতিভার পরিচয় ব্যক্ত হয়, থিয়েটার কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছোটোখাট ভূমিকায় সুযোগ দিতে থাকেন। এভাবে থিয়েটারের অন্দরমহলে প্রবেশ করে তিনি তাঁর গুণপনার পরিচয় দিতে থাকেন। ক্রমে ক্রমে পুরানো মঞ্চস্থ নাটক পরিমার্জনার (Cobbling) কাজে নিযুক্ত হলেন তিনি। এই কাজ করতে করতেই তিনি নাটকের প্রয়োগকুশলতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। এভাবেই ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে রচনা করলেন স্বকীয় নাটক ‘ষষ্ঠ হেনরী’ (Henry VI)। এই ছিল তাঁর নাট্যজগতে প্রবেশের পথ পরিক্রমা।

শেক্সপিয়রের কমেডি নাটকের বৈশিষ্ট্য কী?

শেক্সপিয়রের কমেডি নাটক তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। এর প্রথম স্তরে রয়েছে তাঁর শিক্ষানবিশীর ছাপ। এই পর্বে প্রাচীন ধ্রুপদী কমেডির নির্মাণ-নীতিকে অনুসরণ করে হালকা হাসির নাটক রচনা করেছেন তিনি। প্রেমে মাদকতা, যৌবনের দুঃসাহস এবং অনাবিল হাসির উৎসারই এই পর্যায়ের নাটকের বৈশিষ্ট্য। এই পর্যায়ের নাটকগুলির মধ্যে ‘লাভস্ লেবার্স লস্ট’, ‘দি কমেডি অব এররস’, ‘টেমিং অব দ্য শু’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মধ্যপর্বের কমেডি নাটকের মধ্যে প্রেম, প্রকৃতি, রোমান্স ও মানবজীবনের বিচিত্র ভাবনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মিলনান্তক নাটক। এই পর্যায়ের নাটকগুলির প্রায় প্রত্যেকটির মধ্যেই দুজন যুবতী সবিশেষ সক্রিয় হয়েছে। এখানে পুরুষ চরিত্র অনেকটা নিষ্প্রভ। নাটকের ঘটনাস্থলও ভৌগোলিক বাস্তবতার বাইরে। বাকযুদ্ধে বীরত্বে, জীবনবোধের বিচিত্র চেতনার ঔজ্জ্বল্য এই পর্যায়ের নাটকগুলির মধ্যে উদ্ভাসিত।

অস্তিমপর্বের কমেডি নাটকগুলিকে বলা যায় ‘ট্র্যাজি-কমেডি’। কোনো কোনো সমালোচক এ পর্যায়ের নাটকগুলিকে ‘ড্রামাটিক রোমান্স’ আখ্যা দিয়ে থাকেন। এই পর্যায়ের নাটকগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বিপদ-বিপর্যয়, সংশয় অশান্তির মধ্যে দিয়ে অবশেষে মধুর মিলন সূচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘দ্য টেমপেস্ট’, ‘পেরিক্লিস’, ‘সিমবেলিন’ প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। প্রথাগত কমেডির ছকের বাইরে এসে এই নাটকগুলি শেষ পর্যন্ত হারানো ও ফিরে পাওয়া মৃত্যু ও নবজীবন লাভের রূপকে পরিণত হয়েছে।

শেক্সপিয়রের কমেডি নাটকে নারীর স্থান আলোচনা করো।

শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি নাটকে যেমন দেখা যায় পুরুষ চরিত্রের প্রাধান্য, কমেডি নাটকে বিশেষ করে মধ্য পর্বের কমেডি নাটকে তেমনি পাওয়া যায় স্ত্রী চরিত্রের। কমেডির নারী চরিত্ররা তাঁর বাকচাতুর্য, উদ্দীপনা, সৌন্দর্য, শক্তি ও সাহসে পুরুষদের থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। পোর্শিয়া, রোজালিণ্ড, ভায়োলা, অলিভিয়া প্রভৃতি চরিত্র প্রেম ও রোমান্সের জগতে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেছে। এদের বুদ্ধিমত্তা, প্রাণ প্রাচুর্য, রোমান্টিক প্রেম ও প্রথম দর্শনে প্রেমাভিসারী। ‘টুয়েলফথ নাইট’, ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’, ‘ম্যাচ অ্যাডো এবাউট নাথিং’ প্রভৃতি কমেডিগুলির মধ্যে নারীরা প্রাধান্য লাভ করেছে। এইসব নাটকের মূল কাহিনীর পাশাপাশি উপকাহিনীগুলিতেও প্রেম, কাম, উচ্ছলতা, মাধুর্য, কল্পনা ও বাস্তবে প্রধান আলম্বন বিভাব রূপে নারী চরিত্রগুলিই সর্বাগ্রে দৃষ্টিগোচর হয়। ট্র্যাজেডি নাটকের মধ্যে ‘ম্যাকবেথ’ বা ‘ওথেলোর’ প্রসঙ্গে যেমন সর্বপ্রথম মনে আসে লেডি ম্যাকবেথ বা ডেসডিমোনার নাম, ঠিক তেমন ‘টুয়েলফথ নাইট’- এর নাম করলেই উঠে আসে অলিভিয়া কিংবা ভায়োলার নাম, ‘দি মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ প্রসঙ্গে পোর্শিয়া, ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ প্রসঙ্গে রোজালিন্ড প্রভৃতি স্ত্রী চরিত্রগুলির নাম সর্বাগ্রে স্মরণে আসে। তাই বলতে দ্বিধা নেই যে শেক্সপিয়রের কমেডি নাটকগুলিতে স্ত্রী চরিত্র তথা নারীরা সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে।

গ্রিক ট্র্যাজেডি ও শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডির তফাৎ কোথায়—সংক্ষেপে আলোচনা করো।

আলংকারিক অ্যারিস্টটলের মতে অপ্রতিরোধ্য নিয়তির বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ে অবতীর্ণ কোনো বীর বা খ্যাতনামা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বময় জীবন কাহিনী ও তার ধ্বংসাত্মক পরিণতিই হল ট্র্যাজেডির স্বরূপ। গ্রিক নাটকে সাধারণত এইভাবেই ট্র্যাজেডি আস্বাদ্য হয়েছে। ফলত এর নায়কেরা উচ্চবংশজাত এবং সর্বগুণসম্পন্ন। কোনো না কোনো ভাবে সেই সব চরিত্র নিয়তির হাতের ক্রীড়নক হয়ে অনিবার্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি লাভ করে। এই হল গ্রিক নাটকে ট্র্যাজেডির স্বরূপ। শেক্সপিয়র গ্রিক নাট্যশাস্ত্রের আদলে নায়কদের সম্ভ্রান্তবংশীয় বীর ব্যক্তিত্বময় রূপে চিহ্নিত করলেও তাদের পরিণতি ঘটিয়েছেন চারিত্রিক দুর্বলতা দিয়ে। বস্তুত তাঁর নাটকে নিয়তি কোনো বহিরাগত ঘটনা নয়—আলম্বন বিভাবের চারিত্রিক দুর্বলতা বা ভ্রান্তি। তাই সমালোচকগণ ‘Character is destiny’ এই মন্তব্য করে থাকেন। তাঁর নাটকের পরিণতি প্রধানত তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে সাধিত হয়—চরিত্রের দুর্বলতা, সংশয়, ঈর্ষা, নিয়তি তথা ভাগ্য বিড়ম্বনা এবং বাইরে ও অন্তরে দ্বন্দ্ব মুখরতা। যেমন, ‘Who can control fate’- ওথেলোর এই উক্তি তার অন্তরের সংশয় ও ঈর্ষা থেকে জাত হয়েছে। এখানেই গ্রিক নাটকের সঙ্গে ‘শেক্সপিয়রের নাটকের প্রধান তফাৎটি চোখে পড়ে।