মানবজীবনের বহু বিচিত্র দিক নিয়ে লেখা শেক্সপিয়রের নাটকের সংখ্যা ৩৬, মতান্তরে ৩৭। এই নাটকগুলিকে বিভিন্ন সমালোচক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তবে অধিকাংশ সমালোচকই শেক্সপিয়রের নাটকগুলিতে তিন ভাগে ভাগ করার পক্ষপাতী—কমেডি, ট্র্যাজেডি ও ঐতিহাসিক। ঐতিহাসিক, রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হলেও এবং ট্র্যাজেডি নাটক রচনায় তাঁর প্রতিভা খ্যাতির উত্তুঙ্গ সীমা স্পর্শ করলেও তিনি ঐতিহাসিক ও ট্র্যাজেডি নাটক রচনার ফাঁকে ফাঁকেই মানবজীবনের খুশীর উচ্ছল মুহূর্তগুলিকে নিয়ে কমেডি নাটক রচনা করেছেন। শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি নাটকে সৃষ্ট comic relief-এর মতোই এই নাটকগুলি যেন তাঁর নাট্যজীবনেরও comic relief। শেক্সপিয়রের লিখিত কমেডি নাটকের সংখ্যা ১৪।

শেক্সপিয়রের প্রথম পর্বে লিখিত কমেডি নাটকগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় ‘দ্য কমেডি অব এরস’ (The Comedy of Errors)। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই নাটকের একটি ভাবানুবাদ করেন, নাম ‘ভ্রান্তিবিলাস’ প্লুটাসের কাহিনী অবলম্বনে নাটকটি রচিত। প্রথম অভিনয়কাল ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ। চরিত্র চিত্রণ দুর্বল কিন্তু মজাদার প্লট এবং ঘটনার দ্রুতগতি নাটকটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। নাটকটি কৌতুকময় ফার্স জাতীয়। কাহিনী হচ্ছে, যমজ ভাই, দু’ভায়েরই নাম অ্যান্টিফোলাস। দুজনেই দেখতে একরকম, তাদের ভৃত্যও যমজ, তাদেরও দু’জনের নাম ড্রোমিও। যমজেরা দেখতেও একরকম, জাহাজডুবির ফলে তারা বিচ্ছিন্ন। তাদের নিয়ে মজার মজার ভুল হতে থাকে। পরিশেষে এই ভুল ভাঙে, শেষে মিলন হয়।

এরপর দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কমেডি হচ্ছে ‘লাভস লেবারস লস্ট’ (Love’s Labour’s Lost)। রচনাকাল ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ, অভিজাত সমাজের লর্ডস্ ও লেডীদের নিয়ে মজাদার লঘু-চপল কাহিনী। নাটকটি বিদ্রুপাত্মক (Satire) জাতীয় রচনা। তবে নাটকের প্লট এখানে অনেক স্পষ্ট এবং লিরিক কবিতার আবির্ভাব দেখা যাচ্ছে। কাহিনী হচ্ছে, স্পেনের অন্তর্গত নাভারার রাজা ও তাঁর তিন সভাসদ্ প্রতিজ্ঞা করলেন, তিন বছর তাঁরা জ্ঞানচর্চা করবেন এবং কোনো নারীর মুখ দেখবেন না। রাজসভাতেও নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু রাজকার্যে দূত হিসেবে এলেন ফরাসী রাজকন্যা। বাধ্য হয়ে রাজসভায় তাঁকে স্বাগত জানাতে হল। রাজা রাজকন্যার প্রেমে পড়লেন। সভাসদেরা পড়লেন রাজকন্যার সহচরীদের প্রেমে। অবশ্য ফরাসী রাজার মৃত্যুতে এঁদের মিলন এক বছর পিছিয়ে গেল।

তৃতীয় উল্লেখ্য কমেডি নাটক ‘দ্য টেমিং অব দ্য শু’ (The Taming of the Shrew)। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে রচিত নাটক হিসেবে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। নাটকে একটি কাহিনীর মধ্য দিয়ে আর একটি কাহিনী বলা হয়েছে। প্রথম কাহিনীটি পরবর্তী কাহিনীর ভূমিকা স্বরূপ ব্যবহৃত হয়েছে। এই পদ্ধতি শেক্সপিয়র নাটকে একবারই ব্যবহার করেছেন, পরে কাহিনী পরিবেশনের এই রীতি পরিত্যক্ত হয়েছে। এই নাটকের কাব্যধর্মিতা, ইউনিভারসিটি উইটস্ দের রচনাকে স্মরণ করায়। নাটকটি ফার্স জাতীয়। কাহিনী হচ্ছে, ক্রিস্টোফার শ্লাই নামে এক অচেতন মদ্যপকে একজন লর্ড শিকার থেকে ঘরে ফেরার পথে দেখতে পেয়ে মজা করার জন্য সঙ্গের লোকজনের সাহায্যে তাঁর দুর্গপ্রাসাদে তুলে নিয়ে আসেন এবং সেই মদ্যপই যেন দুর্গাধিপতি এমনভাবে তার সঙ্গে ব্যবহার করতে আজ্ঞা দেওয়া হয়। জ্ঞান ফেরার পর পরিবর্তিত অবস্থায় সে প্রথমে বিভ্রান্ত হলেও, পরে সে ভাবতে আরম্ভ করে যে সে সত্যই দুর্গাধিপতি লর্ড। তার বিনোদনের নানা আয়োজন করা হয়। অভিনেতাদের দিয়ে তার জন্য একটা নাটকও মঞ্চস্থ করা হয়। সেই নাটকের কাহিনী হচ্ছে, অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ ভেরোনাবাসী যুবক পেট্রুসিও এক ধনী পিতার আদুরে দজ্জাল মেয়ে ক্যাথারিনাকে বিয়ে করলেন। মেয়েটির নানা খেয়ালীপনা ও জেদকে কঠোরতর জেদ ও ভালবাসার দ্বারা প্রতিহত করার মধ্য দিয়েই ক্যাথারিনার নবজন্ম ঘটল। এইভাবেই বদমেজাজী (schrewd) মহিলা হয়ে উঠল স্বামী-অনুগতা (tamed) সুশীলা গৃহবধূ। নাটকটির আনন্দময় পরিণতি ঘটল।

চতুর্থ কমেডি নাটক ‘দ্য টু জেন্টলমেন অব ভেরোনা’ (The Two Gentlemen of Verona)। শেক্সপিয়র রচিত প্রথম রোমান্টিক কমেডি হিসেবে উল্লেখ্য। রচনাকাল সম্ভবত ১৫৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দ। প্রথম প্রচেষ্টায় অবশ্যই প্রতিভার পরিণত রূপ আশা করা যায় না। মণ্টেমেয়োর (Montemayor)-এর ‘ডায়না’ কাহিনীসূত্র থেকে নেওয়া সমসাময়িক কালের নানা কৌতুককর কাহিনী ও ঘটনা এখানে নাট্যকার উপভোগ্যভাবে সন্নিবেশিত করেছেন। ভেরোনার দুই বন্ধু প্রোটিয়াস ও ভ্যালেন্টাইন। দুই বন্ধুর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। প্রোটিয়াস ভালোবাসেন জুলিয়াকে। মিলানে গিয়ে ভ্যালেন্টাইন ভালোবাসেন রাজকন্যা সিলভিয়াকে। পরে প্রোটিয়াসও মিলানে গিয়ে সিলভিয়ার প্রেমে পড়লেন। নানা কৌতুককর ঘটনা ও বিপদ-আপদের মধ্য দিয়ে প্রোটিয়াসের মোহমুক্তি হল। তিনি পেলেন জুলিয়াকে আর ভ্যালেন্টাইন সিলভিয়াকে।

পঞ্চম কমেডি নাটক ‘এ মিডসামার নাইট্স ড্রিম’ (A Midsummer Night’s Dream)। রচনাকাল সম্ভবত ১৫৯৭ বা ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ। কাহিনীর সূত্র হয়তো ওভিড বা চসারে পাওয়া যাবে। কিন্তু নতুন প্রাণ দিয়ে তাকে সাজিয়েছেন শেক্সপিয়র। এই নাটকের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে interlude-এর চরিত্রগুলির সংযোজন। যাদুবিদ্যা বা ম্যাজিকের প্রভাব নাটকটিতে সবচেয়ে বেশি। ফুল, প্রণয়ী-প্রণয়িনী, স্বপ্ন ও পরীদের নিয়েই কাহিনী গড়ে উঠেছে। চাঁদনী রাত হচ্ছে ঘটনার সময়। পরীদের রাজা ওবেরন, বটম বা পাক এরাও নাটকের রাজা-রানী প্রভৃতি মানব মানবী চরিত্রের চেয়ে কম উল্লেখ্য নয়। এথেন্সে নিয়ম ছিল, পিতার অমতে বিয়ে করলে কন্যার প্রাণদণ্ড হত। হার্মিয়া ভালোবাসত লিয়াণ্ডারকে। কিন্তু হার্মিয়ার পিতা তাঁকে বললেন এথেন্সের যুবক ডেমেট্রিয়ুসকে বিয়ে করতে।

ষষ্ঠ কমেডি নাটক ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ (The Merchant of Venice)। ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই রচিত। এখানে নাট্যকার অনেক পরিণত। দুটি কাহিনী সমান্তরালভাবে এগিয়ে এসে পরিণামে একত্রে মিশে গেছে। রোমান্টিক কমেডি, কিন্তু দুঃখবহ ট্র্যাজিক ঘটনাও এর সঙ্গে শেক্সপিয়র সুন্দরভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন। এইখানেই তাঁর পরিণত দক্ষতার পরিচয়। কাহিনী, ভেনিসের হৃদয়বান ধনী ব্যবসায়ী অ্যান্টোনিও। তাঁর বন্ধু ব্যাসানিওর বেশ কিছু টাকার জরুরী দরকার হয়ে পড়ল। উপস্থিত মতো অ্যান্টেনিরও হাতেও টাকা ছিল না। বন্ধুর প্রয়োজনে তাঁর বিপক্ষীয় ইহুদী মহাজন শাইলকের কাছে তিনি টাকা ধার করেন। নির্দিষ্ট দিন ও ক্ষণের মধ্যে টাকা শোধ করতে না। পারলে তাঁর গায়ের এক পাউণ্ড মাংস দিতে হবে এই ছিল শর্ত। নির্দিষ্ট দিন পেরিয়ে যাবার পর শাইলক শর্তমতো অ্যান্টোনিওর কাছে এক পাউণ্ড মাংস দাবী করেন। ব্যাসানিওর স্ত্রী পোর্শিয়ার বুদ্ধিবলে শেষ পর্যন্ত অ্যান্টোনিও মুক্তিলাভ করেন। বিষাদ ও দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে যাওয়ার পর আনন্দ ও উচ্ছলতায় নাটক শেষ হয়।

শেক্সপিয়রের নাটক রচনার দ্বিতীয় পর্বে (১৫৯৭-১৬০০ খ্রিঃ) আমরা তিনখানি কমেডি নাটকের উল্লেখ পাই। (১) ‘দ্য মেরী ওয়াইস্ অব উইন্ডসর’, (২) ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ এবং (৩) ‘মাচ অ্যাডু অ্যাবাউট নাথিং’।

দ্বিতীয় পর্বের প্রথম নাটক ‘দ্য মেরী ওয়াইস্ অব উইণ্ডসর’ (The Merry Wives of Windsor) সম্ভবত ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে রচিত। সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজকে নিয়ে লেখা শেক্সপিয়রের একমাত্র পারিবারিক কমেডি। ‘হেনরী দ্য ফোথ’, ঐতিহাসিক নাটকের দুই খণ্ডে ফলস্টাফ চরিত্র দেখে, ফলস্টাফকে নিয়ে আর একখানি নাটক রচনা করতে রানী এলিজাবেথ শেক্সপিয়রকে নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ মেনেই এই কমেডি নাটকটি রচিত। তবে এখানে ফলস্টাফ খুব উজ্জ্বল চরিত্র নয়, একজন ভাঁড় মাত্র। কাহিনীর রেখারূপে রয়েছে উইন্ডসরে আগত স্যার জন ফলস্টাফ মিসেস্ ফোর্ড ও মিসেস্ পেজকে প্রেমপত্র লিখে নানাভাবে নাকাল হন।

দ্বিতীয় পর্বে দ্বিতীয় কমেডি নাটক ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ (As You Like It) ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে রচিত। শেক্সপিয়র খুশীর মেজাজ এখানে উজাড় করে দিয়েছেন। রৌদ্রালোকিত আকাশ, প্রচণ্ড সবুজ গাছপালার মিষ্টি পরিবেশ আর গান। দর্শকদের যেন বলছেন যার যেমন ইচ্ছে দেখে নাও, সাজিয়ে নাও, তাতেই মন ভরে উঠবে। এই ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’, ‘মাচ অ্যাডু অ্যাবাউট নাথিং’ এবং পরবর্তী ‘টুয়েলথ্ নাইট’ নাটক তিনটি একত্রে রোমান্টিক কমেডির একটা বিশেষ গ্রুপ (group) বলা হয়ে থাকে। অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ Pastoral বা আনন্দময় অরণ্য পরিবেশে উপস্থাপিত একটি রোমান্টিক নাটক। ফ্রান্সের এক জনপ্রিয় ডিউকের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর ছোটো ভাই ডিউক ফ্রেডারিক ষড়যন্ত্র করে বড়ো ভাইকে তাঁর রাজ্য থেকে বঞ্চিত ও নির্বাসিত করেন। সেই সঙ্গে জ্যেষ্ঠ ডিউকের সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও জনপ্রিয় কন্যা রোজালিণ্ডও নির্বাসিত হয়। সকন্যা জ্যেষ্ঠ ডিউক আর্ডেনের বনে (Forest of Arden) আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানেই সংসার পাতেন। প্রকৃতির মনোরম পরিবেশ আর্ডেনের বনে বৃক্ষলতার সৌন্দর্য বয়োবৃদ্ধ ডিউকের মনে আনে প্রশান্তি। জনতার অরণ্য থেকে দূরে সরে এসে গাছপালা, ছোট্ট নির্ঝরিণী, প্রস্তরখণ্ড প্রভৃতির মধ্য থেকেই জীবনের পাঠ ও শান্তিলাভ করেন। এই আর্ডেনের বনমাঝে রোজালিণ্ডের সঙ্গী হয়ে আসে ফ্রেডারিকের মেয়ে, রোজালিণ্ডের প্রাণের সঙ্গী সিলিয়া। এদের সঙ্গী হয় বিদষক টাচ্‌ষ্টোন। এদের সবাইকে নিয়েই জমে ওঠে অরণ্যে আনন্দের আসর। এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির ছোটো ছেলে অরল্যাণ্ডোর সঙ্গে আগেই রোজালিণ্ডের পরিচয় হয় এবং তারা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই অরল্যান্ডোও তার বড়ো ভাইয়ের বিদ্বেষের ফলে থাকতে না পেরে আর্ডেনের অরণ্যে আশ্রয় নেয়, দেখা হয় ছদ্মবেশী রোজালিণ্ডের সঙ্গে। পূর্ব পরিচিত হলেও রোজালিণ্ডকে সে চিনতে পারে না। শেষ পর্যন্ত মিলনের মধ্যে আনন্দময় পরিস্থিতিতে জটিলতার অবসান ঘটে। অরল্যান্ডো তার বড়ো ভাইকে এক সিংহের আক্রমণ থেকে বাঁচালে, ভাইয়ের হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে। অনুতাপদগ্ধ ভাই অরল্যান্ডোকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। রোজালিণ্ড ও অরল্যান্ডোর মিলন হয়। অরল্যাণ্ডোর ভাই কামনা করে ফ্রেডারিক কন্যা সিলিয়াকে। বিদষক টাচস্টোন—সেই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? টাচ্‌স্টোন এক গ্রাম্য মেয়ে অভ্রের অনুরাগী হয়। সকলের মিলনের মধ্যে আনন্দময় পটভূমিতে আর্ডেনের কানন হয়ে ওঠে নন্দন কানন। শুধু এই-ই নয়। আর একটা সুখবর আসে—ডিউকের ছোটোভাই ফ্রেডারিক নিজের ব্যবহারে অনুতপ্ত হয়ে ডিউককে সাদর ও আন্তরিক আমন্ত্রণ জানায়। সব ভাল যার শেষ ভাল হিসেবে বৃদ্ধ ডিউক ফিরে পান তাঁর হারানো রাজ্য এবং তাঁর মর্যাদা।

তৃতীয় কমেডি নাটক ‘মাচ অ্যাডু অ্যাবাউট নাথিং’ (Much Ado About Nothing)। ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দের কিছু পরে রচিত। এর কাহিনী কিছুটা পরবর্তী অ্যারিয়োষ্টো ও বন্দেল্লোর কাছ থেকে নেওয়া। নাটকটি মূলত পাণি প্রার্থনা ও পরিণয় নিয়ে একখানি কমেডি নাটক। ঘটনাস্থল সিসিলির মিসিনা। মিসিনার শাসনকর্তার ভাইঝি বিয়াত্রিক এবং আরগোন-এর যুবরাজের সঙ্গী যুবক বীরযোদ্ধা বেনেডিক আপাত বিরোধিতার মধ্য দিয়ে প্রেমিক যুগলে রূপান্তরিত হলেন, অপর সঙ্গী ক্লডিওকে ভালোবাসেন শাসনকর্তার মেয়ে হীরো। হল ভুল বোঝাবুঝি, যুবরাজ নিজে দৌত্য নিয়ে এগিয়ে এলেন। অবশেষে মিলন ঘটল। প্রভাতের মেঘগর্জনের অন্তে সমস্ত বাদ-বিসম্বাদ মধুর মিলনে সমাপ্ত হল।

শেক্সপিয়রের তৃতীয় পর্বের (১৬০১-১৬০৮ খ্রিঃ) কমেডি নাটক হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি (১) ‘টুয়েলথ্ নাইট’, (২) ‘অলস্ ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল’ এবং (৩) ‘মেজার ফর মেজার’। এই নাটক তিনটি বাদ দিলে শেক্সপিয়রের জীবনে এই পর্ব হচ্ছে Grim Tragedy-র পর্ব। ঘন মেঘে আবৃত আকাশে এই কমেডিগুলি যেন প্রভাতী আলোর বিচ্ছুরণ বা comic relief।

রোমান্টিক কমেডি নাটক ‘টুয়েলথ্ নাইট’ অর ‘হোয়াট ইউ উইল’ (Twelfth Night or What You will) প্রথম অভিনীত হয় ১৬০১ বা ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে। অনেক নাটকের মতো এরও উৎস বন্দেল্লোর কাহিনী। প্রকৃতপক্ষে Purest Comedy বলতে যা বোঝায় ‘টুয়েলথ্ নাইট’ তাই। খ্রিস্ট জন্মোৎসবের দ্বাদশ রাত্রে নাটকখানির প্রথম অভিনয় হয়েছিল, তাই নাম ‘টুয়েলথ নাইট’। ইলিরিয়ার ডিউক ভালোবাসেন সুন্দরী অলিভিয়াকে। অলিভিয়া বিমুখ। এমন সময় সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়ে সেবাস্টিয়ান ও ভায়োলা, একইরকম দেখতে যমজ ভাই-বোন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ইলিরিয়ার সমুদ্রতটে এসে আশ্রয় পান সুন্দরী ভায়োলা। ভায়োলা যুবক-বেশে সিজেরিও নামে ইলিরিয়ার ডিউক অর্সিনোর ভৃত্য নিযুক্ত হন। অলিভিয়ার মন জয় করার জন্য অর্সিনো সিজোরিও নামক ছদ্মবেশী ভায়োলাকে দিয়ে তাঁর কাছে প্রেমপত্র পাঠান। এই দৌতকার্যে অলিভিয়ার সঙ্গে পরিচয় ঘটে ছদ্মবেশী ভায়োলা তথা সিজেরিওর। অলিভিয়া সিজেরিওকে ভালবেসে ফেলেন। এর মধ্যে জাহাজডুবি থেকে রক্ষা পেয়ে ভায়োলার ভাই সেবাস্টিয়ানও ইলিরিয়ায় এসে হাজির হল। শেষ পর্যন্ত সব জানাজানি হল। ডিউক ভায়োলাকেই বিয়ে করলেন।

কমেডি নাটক ‘অলস্ ওয়েল দ্যাট এণ্ডস ওয়েল’ (Alls Well that Ends Well) রচনাকাল অনেকের মতে প্রথম যুগের এবং ‘লাভ লেবারস ওন’ (Love Labours Wonne) নামেও পরিচিত। নাটকটি কমেডি হলেও প্লট দুঃখের। চিকিৎসক কন্যা হেলেনা কাউণ্ট বাট্রামকে ভালোবাসেন। বাট্রাম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেলেনা কৌশলে ও বুদ্ধিবলে তাঁকে লাভ করেন।

‘মেজার ফর মেজার’ (Measure for Measure) কমেডি নাটকের অভিনয়কাল সম্ভবত ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ। নাটকটি কমেডি, কিন্তু সমালোচকদের মতে difficult play। নাটকের হাসি কষ্টসাধ্য হাসি। নাটকের পরিণতি মিলনান্তক বলেই নাটকটি হয়েছে কমেডি। কবিতা ও জীবন অভিজ্ঞতা এখানে শেক্সপিয়রের লেখনীতে একসঙ্গে মিশেছে। শান্ত ও দয়াবান ভিয়েনার ডিউক রাজ্যে অনাচারের প্রাবল্য দেখে দুই সহকারী, বৃদ্ধ একেলাস এবং যুবক এজোলোর উপর রাজ্যভার দিয়ে নিরুদ্দেশ হলেন। সাধু বলে এনজোলোর খ্যাতি ছিল। সন্ন্যাসীবেশে ডিউক রইলেন লুকিয়ে। ভিয়েনার এক যুবক ক্লডিয়ো তাঁর প্রণয়িনীকে বিয়ে করতে চান, দেশের আইন মোতাবেক কড়া আইনরক্ষক এনজেলো বাধা দিলেন। কিন্তু নিজে ক্লডিয়োর বোন ইসাবেলার রূপে আকৃষ্ট হলেন। ডিউক জানতে পেরে ক্লডিয়োর বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। রাজ্যভার ফিরিয়ে নিলেন। নিজে ইসাবেলাকে বিবাহ করলেন এবং এন্‌জোলোকে তাঁর বিচারের নামে অবিচারের জন্য শাস্তি দিলেন।

আমরা শেক্সপিয়রের নাট্যজীবনের শেষ পর্বে পৌঁছে গেছি। শেষ পর্বের নাটকগুলির মধ্যে দু’খানি কমেডি নাটককে চিহ্নিত করা হয়; (১) ‘দ্য উইণ্টারস টেল’ এবং (২) ‘দ্য টেম্পেস্ট’। ট্র্যাজেডির বিষাদময়তার যুগ পেরিয়ে এই নাট্য-জীবনের শেষ পর্বে নাট্যকার শান্ত প্রসন্নতার কোলে আবার ফিরে এলেন। মানুষের দুঃখ-বেদনা, অপরিমিত উচ্চাশা, অদমনীয় প্রবৃত্তি, হিংসা-প্রতিহিংসা, লোভ-লালসার ভয়াবহ রূপ তিনি দেখেছেন। কিন্তু সেই ডার্ক ট্র্যাজেডির যুগ পেরিয়ে জীবনের পড়ন্ত বেলায় আবার সূর্যের প্রসন্ন রৌদ্রের দেখা পাওয়া গেছে এই শেষ পর্বের রোমান্স নাটকে।

‘দ্য উইন্টার’স টেল’ (The Winter’s Tale) রোমান্টিক কমেডি নাটক। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে অভিনীত হয়। সমালোচকদের মতে, more romantic that dramatic। নাটকে সিসিলির দৃশ্যাবলী, প্যাষ্টোরাল চিত্র, ট্র্যাজি কমেডির আভাস সব আছে। নাটকের প্রথম ভাগ শীতপ্রধান দেশের মতোই কঠোর, শেষভাগ শীত শেষে প্রথম বসন্তের মতোই মিষ্টি। সিসিলির রাজা লেওন্‌টিস্। স্বামীপ্রাণা রানী হার্মিওনি। বোহেমিয়ার রাজা পলিক্সেনিস আসেন দেখা করতে। তাঁর সঙ্গে রানীর কথাবার্তায় রাজা লেওনটিসের মনে সন্দেহ জাগে। তিনি রানীকে পাঠান কারাগারে। কারাগারে রানীর এক কন্যা হয়। বহু দুঃখ ও দুর্গতি অস্তে শেষে রাজা ও রানীর মিলন হয়। মেয়েটির বিয়ে হয় পলিক্সেনিসের ছেলের সঙ্গে।

শেষ কমেডি নাটক ‘দ্য টেম্পেস্ট’ (The Tempest)। এই রোমান্টিক কমেডির রচনাকাল সম্ভবত ১৬১১ খ্রিস্টাব্দ। এই নাটকের মুখ্য আবেদন একদিকে এর কবিতায় এবং অন্যদিকে মিরাঙা চরিত্রে। পিতা প্রস্পেরোও কম উল্লেখ্য নয়। নাটকীয় দীপ্তিতে ক্যালিবান এবং অ্যারিয়েলও সমান উজ্জ্বল। এই নাটকের পরিশিষ্ট এপিলোগ্ (Epiloge) অংশে প্রস্পেরোর বিদায়বাণীর মধ্য দিয়ে নাট্যজগৎ থেকে শেক্সপিয়রের বিদায়বাণী বিঘোষিত হয়েছে। প্রস্পেরোর কথা যেন হয়ে উঠেছে শেক্সপিয়রেরও কথা।

মিলানের ডিউক প্রস্পেরো তাঁর ভাই অ্যান্টোনিও-র ষড়যন্ত্রে রাজ্যচ্যুত ও বিতাড়িত হন এবং সামান্য কিছু বইপত্তর ও কন্যাসহ ভাঙা নৌকায় তাঁকে সমুদ্রের বুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তিনি জাদুবিদ্যায় পারঙ্গম ছিলেন। ভেসে ভেসে এক দ্বীপে গিয়ে ওঠেন এবং দ্বীপের দৃশ্য ও অদৃশ্য প্রাণীদের জাদুবিদ্যায় বশীভূত করে তাদের করেন আজ্ঞাধীন। দ্বীপের ডাইনীর ছেলে কদাকার ক্যালিবান তাঁর আজ্ঞাধীন। আকাশচারী আজ্ঞাধীন এরিয়েল অদৃশ্যে তাঁদের সবাইকে দেখাশুনা করেন। সেই দ্বীপের কাছে জাহাজডুবির ফলে দ্বীপে এসে পড়লেন নেপলসের রাজা তৎসহ যুবরাজ ফার্ডিনান্ড এবং তাঁর সহচরগণ। প্রস্পেরোর ভাই অ্যান্টোনিও নিজেও এই দলে ছিলেন। এই নির্জন দ্বীপে মিরাণ্ডার সঙ্গে ফার্ডিনান্ডের দেখা হল, উভয়ে পরস্পরকে ভালোবাসলেন এবং শেষে প্রস্পেরোর সম্মতিক্রমে তাঁদের বিয়ে হল। অবশেষে প্রস্পেরোও তাঁর রাজ্য ফিরে পেলেন। পারস্পরিক ক্ষমা, সকলের মিলন ও ভালোবাসার মধ্যে নাটকের সমাপ্তি ঘটে। প্রস্পেরো, মিরান্ডা ও ফার্ডিনাল্ডের আনন্দময় বিবাহের আয়োজন করেন, ওই দ্বীপেই তাঁর অলৌকিক যাদুবিদ্যার সাহায্যে। তারপর ওই দ্বীপের দৃশ্য-অদৃশ্য সমস্ত প্রাণী ও আত্মাকে মুক্তি দিয়ে জাদুজগৎ, জাদুবিদ্যা এবং নির্জন দ্বীপ থেকে বিদায় নিয়ে সদলবলে আবার মিলানে ফিরে এলেন। নাটকের অন্তে প্রস্পেরো যে সমাপ্তিবাণী উচ্চারণ করেন তাতে শুধু প্রস্পেরো নয়, নাটকের এবং রঙ্গমঞ্চের মায়ালোক থেকে নাট্যকার শেক্সপিয়রের বিদায়বাণীও বিঘোষিত হয়েছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে নাট্যকারের মহৎ জীবনদর্শন—

“Our revels are now ended. These our actors, 

As I foretold you, were all spirits, and 

Are melted into air. into thin air:

••••••

And, like this insubstantial pageant faded,

Leaves not a rack behind. We are such staff 

As dreams are made on; and our little life.

Is rounded with a sleep.”

শেক্সপিয়র রচিত প্রথম পর্যায়ের কমেডিসমূহে রয়েছে যৌবন স্বপ্নের মদির বিকাশ, প্রাণের অপরূপ উজ্জ্বল উদ্ভাসন। এই বাস্তবের মাটির উপরেই তিনি সৃষ্টি করেছেন কল্পনার রঙিন পুষ্প। তাঁর কমেডির প্রধান উপজীব্য প্রেম। এই প্রেমের স্পর্শেই জীবন হয় সুন্দর, সহনীয়। সুন্দর কাল্পনিক রাজ্যে কাহিনীর ঘটনাস্থলে যেখানে সেখানে স্বর্গীয় পরীগণ মানবস্বভাবযুক্ত। হাল্কা খণ্ড মেঘের মতো জীবনের সমস্যা স্বচ্ছন্দ ও প্রবহমান। এই কমেডিগুলিতে প্রাধান্য নায়িকাদের। এই নায়িকারা বুদ্ধিমতী, রসিকা, রূপবতী এবং প্রেমে দীপ্যমান।

শেক্সপিয়রের শেষ পর্যায়ের কমেডি নাটকে মিলনে নাটক শেষ হলেও নাটকগুলির আরম্ভ হয়েছে একটা ট্র্যাজিক পরিবেশের দিয়ে। ‘ওথেলো’র ডেসডিমোনার মতো ‘উইন্টার’স টেল’-এর হার্মিওন স্বামীর নিষ্ঠুর অত্যাচার সহ্য করেছে। “কিং লিয়ারে’র মতো মিলানের ডিউক প্রস্পেরো রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। তবু এই দুঃখের কথাতেই নাটক শেষ হয়নি। মিলন, পারস্পরিক ক্ষমা, প্রসন্নতা ও শান্তির মধ্যে নাটকের কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটেছে। পাপবোধ পরাজিত হয়েছে, ধর্মবোধ ও মঙ্গল-চেতনা জয়লাভ করেছে। নাটকের পরিণতিতে প্রকাশিত এই ক্ষমাসুন্দর প্রশান্তি ও সুখচেতনা কবির সুগভীর জীবনদর্শনের ফলে। শেক্সপিয়রের শেষ নাটক ‘দ্য টেম্পেস্ট’ আমাদের মায়াময় এক কল্পলোকে নিয়ে যায়। প্রস্পেরোর ইন্দ্রজাল, মিরান্ডার স্বর্গীয় প্রেম, এরিয়েলের সৌন্দর্য সংগীত, অর্ধমানবশিশু ক্যালিবানের রূপমুগ্ধতা—সব মিলিয়ে কল্পনাময় মায়ালোক সৃষ্টি করেছে, যেখানে সবকিছুই সম্ভব। এবং শেষ পর্যন্ত নাটকের প্রাথমিক যে দুঃখ ও বিষাদময় পরিবেশ তা অতিক্রম করে ক্ষমা, স্বস্তি, শান্তির এক শুভ মিলনমন্ত্র ব্যঞ্জিত হয়েছে নাটকের মধ্যে।

এই হচ্ছে শেক্সপিয়রের কমেডি নাটকগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয়। তাঁর ট্র্যাজেডি ও ঐতিহাসিক নাটকগুলির মতো কমেডি নাটকের ক্ষেত্রেও কাহিনীর দিক থেকে তিনি বিশেষ মৌলিকত্বের দাবী করতে পারেননি। প্রায় সব কাহিনীর সূত্রই হচ্ছে পূর্ববর্তী কোনো কাহিনী। আবার গোড়ার দিকের অনেক রচনায় অন্য নাট্যকারদের সহায়তা ছিল, একথাও অবিশ্বাস্য নয়। কিন্তু তাই বলে বিশ্বসাহিত্যে দ্বিতীয় কোনো শেক্সপিয়রকে আমরা আজও পাইনি। পুরানো মালমশলা এবং কোথাও কোথাও সহকারী মিস্ত্রীর সাহায্য নিয়েই তিনি তাঁর নতুন নাট্যধর্ম নির্মাণ করেছেন, মৃন্ময় দেহে চিন্ময় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিভার জাদুস্পর্শে সাধারণ ধাতুপিণ্ডকে রূপান্তরিত করেছেন স্বর্ণপিণ্ডে।