ঐতিহাসিক নাটক দিয়েই শেক্সপিয়রের নাট্যজীবনের হাতেখড়ি। তাঁর সর্বশেষ নাটকটিও ঐতিহাসিক নাটক অর্থাৎ তিনি নাট্যজীবন শেষ করেন ঐতিহাসিক নাটক দিয়েই। অবশ্য এই সর্বশেষ নাটকটি তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি।

তাঁর প্রথমদিকের নাটক ‘হেনরী দ্য সিক’ (তিন খণ্ড)-এর (Henry Vl. Part I, II, and III) রচনাকাল মোটামুটি ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর পরের বছর রচিত হয় ‘রিচার্ড দ্য থার্ড’ (Richard III)। এর দুবছর পরে ‘রিচার্ড দ্য সেকেণ্ড (Richard II)। এর পরের নাটক হচ্ছে ‘কিং জন’ (King John)। তারপর ১৫৯৭ থেকে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হেনরী দ্য ফোর্থ—পার্ট ওয়ান, পার্ট টু (Henry IV. Part 1 and Part II) এবং ‘হেনরী দ্য সিক্সথ’ রচিত হল। শেক্সপিয়রের সর্বশেষ অসমাপ্ত ঐতিহাসিক নাটক ‘হেনরী দ্য এইট্‌থ্’ (Henry VIII) ১৬১০-১১ টাব্দ রচিত।

‘হেনরী দ্য সিক্‌সথ’ তিন খণ্ড ও ‘হেনরী দ্য ফোর্থ’ দুই খণ্ড সহ শেক্সপিয়র রচিত ঐতিহাসিক নাটকের সংখ্যা মোট দশ। ইতিহাসের ধারাক্রম রক্ষা করে তিনি পর পর নাটক রচনা করেননি। সময়ের দিক থেকে ‘কিং জন’ প্রথমে রচিত হওয়া উচিত ছিল। ‘হেনরী দ্য ফোর্থ’-এর পরে স্থান পাওয়া উচিত ‘হেনরী দ্য সিক্সথ’। বিক্ষিপ্তভাবে হলেও মোটামুটি সাড়ে তিনশ বছরের ইংল্যান্ডের রাজকাহিনী এই ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে বিধৃত। শুধু ‘কিং জন’-এর শাসনকাল ১১৯৯-১২১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ‘হেনরী দ্য এইটথ্’ বা অষ্টম হেনরীর শাসনকাল ১৫০৯-১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই ঐতিহাসিক নাটকগুলি ছাড়া শেক্সপিয়রের এই ইতিহাস চেতনা তাঁর কিছু ট্র্যাজেডি এবং রোমান্স নাটকগুলির মধ্যেও কাজ করেছে।

রানী এলিজাবেথের রাজত্বকালে, ইংল্যান্ডের রেনেসাঁস যুগে ঐতিহাসিক নাটক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নবজাগ্রত জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার কালে যে আত্মবিস্তার শুরু হল—ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যের বিস্তার অপরাজেয় স্প্যানিশ আর্মাডার শোচনীয় পরাজয় ইংল্যান্ডের মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস ও যে নব জাতীয়তাবোধের গোড়াপত্তন করল, তারই ফলে দেশাত্মবোধের রঙে রঞ্জিত হয়ে এলিজাবেথের যুগে ঐতিহাসিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে অনেকেই এগিয়ে এলেন। জন লিলি, ক্রিস্টোফার মার্লো প্রভৃতি অনেকেই ঐতিহাসিক নাটক লিখেছিলেন।

শেক্সপিয়রের ক্ষেত্রেও ইতিহাস-আশ্রিত এই নাটক রচনার মূল প্রেরণা তাঁর স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ এবং রাজতন্ত্রে গভীর বিশ্বাস। ইংল্যান্ডকে ভালবাসা থেকেই ইংল্যান্ড-কেন্দ্রিক ঐতিহাসিক নাটকের সূত্রপাত। সেই সময়ের ঐতিহাসিক নাটক সম্বন্ধে অধ্যাপক চার্লটনের (H. B. Charlton) বক্তব্য স্মরণীয়। তিনি বলেছেন, “Comedy and tragedy are concerned with the eternal or ephemeral fate of individual men. The history play is concerned with nations. The real hero of the English play is England.”। শেক্সপিয়রের ঐতিহাসিক নাটকগুলি সম্পর্কেও এই কথাটা প্রযোজ্য। অবশ্য একথা স্বীকার্য যে প্রকৃত শিল্পী হিসেবে এবং সর্বকালের একজন দক্ষ শিল্পী হিসেবে তিনি কোনো সমসাময়িক ঘটনাকেই তাঁর নাটকীয় তাৎপর্য ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে বেশি গুরুত্ব দেননি। তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলির তথ্য-উৎস হচ্ছে প্রধানত ‘হলের তথ্যপঞ্জী’ (Hall’s Chroni cles) এবং ‘হলিনসেডের তথ্যপঞ্জী’ (Holinshed’s Chronicles) । এই সাধারণ তথ্য সহযোগেই রচিত হয়েছিল তাঁর অসাধারণ সাহিত্যকর্ম। অতিসাধারণ ধাতুপিণ্ড তাঁর প্রতিভার স্পর্শে রূপান্তরিত হয়েছিল স্বর্ণপিণ্ডে।

‘হেনরী দ্য সিক্‌সথ’ (রাজত্বকাল ১৪২২-১৪৬১ খ্রিঃ) নাটকের প্রথম খণ্ডে ষষ্ঠ হেনরীর রাজত্বের প্রথম ভাগ—ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের যুদ্ধ, জোয়ান অব আর্কের নেতৃত্বে ফ্রান্স থেকে ইংরেজদের পশ্চাদপসরণ : ইংরেজ পক্ষে বীর টবট, ইয়র্ক ও ল্যাঙ্কাস্টারের বিরোধ বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে হেনরী ও মার্গারেটের বিবাহ ; ইয়র্কের ষড়যন্ত্র ; সেণ্ট আলবাসের যুদ্ধ বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে হেনরী কর্তৃক ডিউক অব ইয়র্ককে উত্তরাধিকার দান; পুত্র বঞ্চিত হওয়ায় মার্গারেটের বিদ্রোহ, অবশেষে গ্লস্টারের ডিউক রিচার্ডের হাতে ষষ্ঠ হেনরীর …মৃত্যুতে নাটক শেষ হয়েছে। এখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও বিবেক-বর্জিত যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত রিচার্ড সম্পর্কে করা হয়েছে, তা শেক্সপিয়রের পরবর্তী নাটক ‘রিচার্ড দ্য থার্ড’-এ পরিস্ফুটিত। তিনটি খণ্ড মিলে নাটকটি আয়তনে মহাকাব্যোচিত বিশাল। ভাষা অলঙ্কারবহুল, চরিত্রাঙ্কন দুর্বল। আঙ্গিকের দিক থেকেও সাদামাঠা। সমালোচকদের মতে সম্ভবত স্টীল, গ্রীন, মার্লো এই নাটক রচনায় শেক্সপিয়রকে সাহায্য করেছিলেন।

পরবর্তী ঐতিহাসিক নাটক ‘রিচার্ড দ্য থার্ড’ (শাসনকাল ১৪৮৩-৮৫ খ্রিঃ) তুলনায় অনেক পরিণত রচনা। ডিউক অব গ্লস্টার তৃতীয় রিচার্ড নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন। তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা, বীরত্ব, ষড়যন্ত্র ও মৃত্যু এই নাটকের বিষয়। নাটক রচনায় মার্লোর প্রভাব রয়েছে। রয়েছে মেকিয়াভেলির প্রভাব। সেনেকার নাটকের মতো এই নাটকেও প্রতিহিংসা, নিষ্ঠুরতা, অলৌকিকতা ও চাঞ্চল্যকর ঘটনার সমাবেশ রয়েছে। যে-কোনো উপায়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ়তা, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও নিষ্ঠুর কিন্তু নাটকীয় আকর্ষণ-যুক্ত এই রিচার্ড চরিত্র মানবরূপী দানব। নাটকের দৃশ্যগুলি সুসংবদ্ধ। পরিণতির দিক দিয়ে নাটকটি একটি ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি।

এরপর ঐতিহাসিক নাটক ‘কিং জন’ (শাসনকাল ১১৯৯-১২১৬ খ্রিঃ)। নাটকটি প্রথম যুগের শেষ সময়ে লেখা। রাজা জনের রাজত্বকালে আর্থারের শোচনীয় মৃত্যু ও নানা রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে এই নাটকটি রচিত। নাটকীয় উপস্থাপনা ঘাতপ্রতিঘাত, দৃশ্যাবলী ইত্যাদি বিষয়ে শেক্সপিয়র এখানে অনেক সচেতন।

দ্বিতীয় পর্বের নাটকগুলির মধ্যে প্রথম উল্লেখ্য ‘রিচার্ড দ্য টু’ (শাসনকাল ১৩৭৭-৯৯ খ্রিঃ)। নাটকটির রচনাকাল সম্ভবত ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দ। নাটকের দ্বিতীয় রিচার্ড চরিত্রটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও কবিজনোচিত। নাটকটিতে রিচার্ড কর্তৃক বোলিংব্রোকের হেনরী (পরে হেনরী দ্য ফোর্থ) নরফোকের ডিউককে রাজ্য থেকে বহিষ্কার, জন অব গণ্টের মৃত্যু ও তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ এবং পরিশেষে বোলিংব্রোক কর্তৃক পরাজিত এবং দ্বিতীয় রিচার্ডের মৃত্যু নাটকের বর্ণিত বিষয়। পরিণতির দিক দিয়ে নাটকটিতে নির্ভেজাল ট্র্যাজিক পরিণতি দেখানো হয়েছে।

‘হেনরী দ্য ফোর্থ’ (শাসনকাল ১৩৯৯-১৪১৩ খ্রিঃ) দুই খণ্ডে প্রকাশিত। রচনাকাল ১৫৯৮-১৬০০ খ্রিস্টাব্দ। দ্বিতীয় রিচার্ডকে হত্যা করে হেনরী বোলিংব্লোক হেনরী দ্য ফোর্স নাম নিয়ে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসলেন। প্রথম খণ্ডে রাজা কর্তৃক বিদ্রোহ দমন, সুসব্যারি (Shrewsbury) যুদ্ধ পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। এই খণ্ডেই শেক্সপিয়রের বিখ্যাত চরিত্র ফলস্টাফ্ (Falstaff) কে আমরা পেয়েছি। দ্বিতীয় খণ্ডে আর একটি বিদ্রোহের কাহিনী; ফলস্টাফের কাণ্ডকারখানা ; চতুর্থ হেনরীর মৃত্যু ; ফলস্টাফের কারাদণ্ড। দুটি খণ্ডেরই গ্রন্থনা শিথিল। এই নাটকের আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল শেক্সপিয়রের প্রথম জীবনে ওয়ারউইকশায়ারের (Warwickshire) অনেক টুকরো স্মৃতি নাটকটির মধ্যে বুনে দেওয়া হয়েছে।

‘হেনরী দ্য ফিথ’ (শাসনকাল ১৪১৩-১৪২১ খ্রিঃ) রচনাকাল ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ।‘হেনরী দ্য ফোর্থ’ এবং তাঁর পুত্র ‘হেনরী দ্য ফিফথ্’-এর নাটকীয় উপাদান একই জায়গা থেকে সংগৃহীত। ‘হেনরী দ্য ফোর্থ’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে যুবরাজের শিক্ষাদীক্ষার প্রস্তুতি পর্বের কথা বলা হয়েছে। ‘হেনরী দ্য ফিফথ্’ নাটকে তারই জীবনকথা বিবৃত। শেক্সপিয়রের চোখে এই পঞ্চম হেনরী আদর্শ রাজা। এখানে ফলস্টাফের মৃত্যুসংবাদ আছে। হাসিকান্না মিশিয়ে নাটকটি হয়ে উঠেছে উপভোগ্য।

‘হেনরী দ্য এইট্‌থ্’ (শাসনকাল ১৫০৯-১৫৪৭ খ্রিঃ) রচনাকাল ১৬১০-১১ খ্রিস্টাব্দ। শেক্সপিয়রের সর্বশেষ রচনা এবং সর্বশেষ ঐতিহাসিক নাটক। রাজা অষ্টম হেনরীর সময়ের কথা নিয়েই নাটকটি রচিত। বাকিংহামের ডিউকের বিচার ও প্রাণদণ্ড; রাজকীয় বিবাহবিচ্ছেদ ; কার্ডিনাল উল্সলির এই বিবাহবিচ্ছেদে বাধাদান প্রচেষ্টা অবশেষে পরাজয় ও মৃত্যুবরণ; যুবরাজ্ঞী পদে এলিজাবেথের অভিষেক প্রভৃতি নাটকে বর্ণিত হয়েছে। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে নাটকটি অভিনীত হবার খবর পাওয়া যায়। এই নাটকের অভিনয় আর এক কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে। নাটকের প্রথম অঙ্কের শেষে যে কামান দাগার কথা আছে, অভিনয়কালে সেই কামান দাগতে গিয়ে ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে আগুন ধরে ‘গ্লোব থিয়েটার’ ভস্মীভূত হয়ে যায়।

ইতিহাসের কালপরম্পরার সঙ্গে মিলিত ধারাবাহিকভাবে তিনি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেননি। ‘কিং জন কে নিয়ে তিনি নাটক লিখেছেন পরে। কিন্তু রাজা হিসেবে তিনিই আসবেন আগে। ইংল্যাণ্ডের ইতিহাসে কিং জনের রাজত্বকাল ১১৯৯-১২১৬ খ্রিস্টাব্দ। তারপর দীর্ঘকাল পরে ‘রিচার্ড দি সেকেণ্ড’ ১৩৭৭-১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দ। এরপর দুখণ্ডে রচিত চতুর্থ হেনরী (রাজত্বকাল ১৩৯৯-১৪১৩ খ্রিঃ)। এরপর এলেন পঞ্চম হেনরী (১৪১৩–১৪২২ খ্রিঃ), তিন খণ্ডে ষষ্ঠ হেনরী (১৪২২-৬১ খ্রিঃ)। এই তিন হেনরীকে নিয়ে লেখা ছ’খণ্ড নাটককে একটি Triology বলা হয়ে থাকে। এরপর তৃতীয় রিচার্ড ১৪৮৩-৮৫ এবং অষ্টম হেনরীর রাজত্বকাল ১৫০৯-৪৭ খ্রিস্টাব্দ। এঁদের সবার রাজত্বকালের সময়সীমা ১২০ বছর হলেও মোটামুটিভাবে ইংল্যান্ডের সাড়ে তিনশ বছর প্রক্ষিপ্তভাবে এই রাজকাহিনীতে বিধৃত। অষ্টম হেনরী হচ্ছেন রানী এলিজাবেথের পিতা। রাজ-বংশাবলীর ইতিহাস শেক্সপিয়র এখানেই শেষ। করেছেন। এই নাটকগুলি রচনায় ইতিহাস প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করলেও নাটকে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিই হয়ে উঠেছে প্রধান আকর্ষণ।

শেক্সপিয়রের আগে থেকে ঐতিহাসিক নাটক লেখা আরম্ভ হয়েছিল, একথা আমরা জানি। নাটক রচনার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর দিক থেকেও তিনি পূর্বসুরীদের প্রদত্ত তথ্যের উপরেই প্রধানত নির্ভর করেছিলেন, তা বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে কোনো অভিনবত্ব না থাকলেও পরিচিত বিষয়বস্তু নিয়েই তিনি তাঁর অভিনব নাট্যজগৎ সৃষ্টি করে গিয়েছেন, এইখানেই তাঁর প্রতিভার বৈশিষ্ট্য। ঘটনাগত তথ্যগুলি তাঁর হাতে রূপান্তরিত হয়েছে সাহিত্য সত্যে। ঘটনাপঞ্জীর মধ্য থেকে চরিত্রগুলি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। হাসি-কান্নায় দু’কূল ভরিয়ে ইতিহাস হয়েছে ঐতিহাসিক নাটক এবং এইখানেই শেক্সপিয়র অনন্য।