শৃঙ্গার রস : রতিভাবের রূপান্তরের পরিণতিতে যে রস—তাকে শৃঙ্গার রস বলে। এই শৃঙ্গার রসের আর একটি নাম হল আদি রস। আদি বা শৃঙ্গার রস দু’রকমের-সম্ভোগ এবং বিপ্রলম্ভ। নায়ক-নায়িকার মিলনের কথায় এই সম্ভোগ রস থাকে।

‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবারে’—ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটিতে সম্ভোগ রসের সন্ধান মেলে। চণ্ডীদাসের একটি কবিতাংশেরও উল্লেখ করা চলে—যেখানে সম্ভোগ রসের দেখা মেলে—

রতন পালঙ্ক পর   বৈঠল দুহু জন

দুহু মুখ হেরই আনন্দে।

হরিষ সলিল ভরে    হেরই না পারই

অনিমেষে রহল ধন্দে।

শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধার অনুরাগ সম্বলিত এই সম্ভোগ রসেরেই পরিচয় দিচ্ছে।

মিলনের আগে বা পরে নায়ক-নায়িকার বিরহ বর্ণনা থেকে যে রসের সৃষ্টি—তাকেই বিপ্রলম্ভ বলে। নায়ক-নায়িকার মধ্যে অনুরাগ প্রবল—তবু তারা মিলিত হতে পারছে না—এই অবস্থায় বিপ্রলম্ভ-শৃঙ্গার ঘটে। যেমন—

এ সখি হামারি দুখক নাহি ওর।

ই ভরা বাদর     মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর ৷৷

ঝাম্পি ঘন    গরজন্তি সন্ততি

ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।

কান্ত পাহন    কাম দারুণ

সঘনে খর সরহস্তিয়া।

হাস্যরস : হাসিকে যে রচনা উদ্দীপ্ত করে, তাতেই হাস্যরস থাকে। বিকৃত চেহারার বর্ণনা, আজগুবি কাণ্ডকারখানা নিয়ে লেখাকে কেন্দ্র করে হাস্যরসের উদ্ভব ঘটে। হাস্যরসের স্থায়ী ভাব হাস। উদাহরণ—

রামহরি মোত্তার, অতিবড়ো শোক তার

ট্রেনের হারিয়ে গেছে কৌটাটি দোত্তার।

বুড়ী তার গিন্নি—মানিয়াছে সিন্নি

পতির বিপদে দেখে বড়ো গেছে রোখ তার।

কিংবা,

সব লিখছে, কেবল দেখ পাচ্ছিনাকো লেখা কোথায়

পাগল ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন করে ঠেকাব তায়।

করুণ রস : শোকের স্থায়ীভাবকে কেন্দ্র করে করুণ রস জাত নয়। প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যু বা অনিষ্টকর কিছু ঘটনাকে আশ্রয় করেই করুণ রসের স্থিতি।

মুহূর্তের তরে

ফুটন্ত তরঙ্গ মাঝে মেলি আর্তচোখ

‘মাসি’ বলি ফুকারিয়া মিলানো বালক 

অনন্ত তিমির তলে। শুধু ক্ষীণ মুঠি

বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্বপানে উঠি

আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।

‘ফিরায়ে আনিব তোরে’ কহি উর্ধ্বশ্বাসে

ব্রাহ্মণ মুহূর্ত-মাঝে ঝাঁপ দিল জলে।

আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।

রৌদ্র রস : ক্রোধ ভাবকে কেন্দ্র করেই রৌদ্র রসের উদ্ভব। নিচে একটি উদাহরণ দেওয়া হল—

অধীর হইলা শূলী কৈলাস-আলয়।

নাড়িল মস্তকে জটা, ভীষণ গর্জনে।

গর্জিল ভূজঙ্গবৃন্দ, ধক ধক ধকে 

জ্বলিল অনল ভালে; ভৈরব কল্লোলে

কল্লোলিলা ত্রিপথগা।

বীররস : দয়া ধর্ম, দান, দেশভক্তি, যুদ্ধ প্রভৃতিতে উৎসাহ দেওয়ার ভাবকে যে রস উদ্দীপিত করে—তাকে বীর রস বলে। উৎসাহ হল এই রসের স্থায়ী ভাব। যথা—

সাজ হে বীরেন্দ্রবৃন্দ, লঙ্কার ভূষণ। 

দেখিব কী গুণ ধরে রঘুকুলমণি!

অরাবণ অরাম বা হবে ভব আজি !

ভয়ানক রস : ভয়কে আশ্রয় করে যে রস—তার নাম ভয়ানক রস। যথা—

সম্মুখে চলে মোগল সৈন্য উড়ায়ে পথের ধূলি 

ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া বর্শা ফলকে তুলি।

শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে, বাজে শৃঙ্খলগুলি। 

রাজপথ ‘পরে লোক নাহি ধরে, বাতায়ন যায় খুলি।

বীভৎস রস : মনের ঘৃণাকে ব্যঞ্জিত করে যে রস—তাকেই বীভৎস রস বলে। জুগুপ্সা হল স্থায়ীভাব। যেমন—

তার পাশে বসি যক্ষ্মা শোনিত উগরে 

কাসি কাসি দিবানিশি, হাঁপায় হাঁপানি 

মহাপীড়! বিসুচিকা, গতজ্যোতিঃ আঁখি ;

মুখ মলদ্বারে বহে, লোভের লহরী

শুভ্রজল রয় রূপে!

অদ্ভুত রস : স্থায়ীভাব বিস্ময় থেকেই অদ্ভুত রসের জন্ম। যে ভাব মনে বিস্ময়ে আনে, আর সেই বিস্ময়ে মনপ্রাণ একেবারে অভিভূত হয়ে যায়, সেই ভাব থেকেই জন্ম নেয় অদ্ভুত রস। যেমন—

আলোয় ঢাকা অন্ধকার, ঘণ্টা বাজে গন্ধে তার।

গোপন প্রাণে স্বপনদূত, মঞ্চে নাচেন পঞ্চভূত।

হ্যাংলা হাতি চ্যাং দোলা, শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা।

মক্ষিরাণী পক্ষিরাজ, দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ।

আদিম কালের চাঁদিম হীম, তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।

শান্তি রস : এই সংসারের, এই জগৎ-জীবনের অনিত্যতা আর আত্মদর্শন ও তত্ত্বজ্ঞানের জন্যে মনে যে শান্তির ভাব জাগে—তা থেকে যে রসের উদ্ভব, তাকেই শান্তরস বলে। শম হচ্ছে স্থায়ী ভাব। যেমন—

একটি নমস্কারে প্রভু, একটি নমস্কারে 

সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে ;

ঘন শ্রাবণ মেঘের মতো রসের ভারে নম্র নত,-

একটি নমস্কারে প্রভু, একটি নমস্কারে 

সমস্ত মন পড়িয়া থাক তবে ভবন-দ্বারে।

(আমাদের মনে রাখতে হবে যে বৈষ্ণব সাহিত্যের রসবিচার সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৈয়ব কবিরা শুধু ‘প্রেমভক্তি’কেই স্থায়ীভাবে বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সংস্কৃত আলংকারিকদের অনেকেই মানব মনের প্রীতিভাব ও বৎসলতাকে স্থায়ীভাব বলে গণ্য করে থাকেন। তাই তাঁরা বাৎসল্যকে দশম রস বলে গণ্য করেছেন। বৎসলতা হচ্ছে স্থায়ী রস। শাক্ত পদাবলির আগমনী-বিজয়া-পর্যায়ের বেশ কিছু গানে বাৎসল্য রসের পরিচয় আছে )