আধুনিক যুগে কাহিনী কেন্দ্রিক রচনায় চরিত্র প্রাধান্য প্রধান লক্ষণ। প্রার চারশত বৎসর পূর্বে আবির্ভূত কবিকঙ্কণের রচনাশৈলীতে এই আধুনিকতার স্পর্শ পাওয়া যায়। দেবী অপেক্ষা মর্ত্যের মানব চরিত্রাঙ্কনে তিনি যে সহানুভূতি, বাস্তবজ্ঞান ও তাঁর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন তার জন্যেই তাঁকে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কবিকুল চূড়ামণির দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। চরিত্র-চিত্রণে দক্ষতা কবি দেখিয়েছেন ফুল্লরার চরিত্রের মধ্যদিয়ে। তাই সমালোচকগণ তাঁকে সার্থক জীবনী শিল্পী রূপে আখ্যাত করেছেন।

সমগ্র মধ্যযুগীয় সাহিত্যে ফুল্লরা একটি অনন্য ও ব্যতিক্রমী নারী চরিত্র। ফুল্লরার প্রধান গুণ তার গৃহিণীপনা। কাব্যে ফুল্লরাকে আমরা প্রথম দেখতে পাই মা হীরাবতীর সঙ্গে গোলহাটে মাংস পশারিনী হিসেবে। দৈবযোগে নিদয়ার সাথে দেখা এবং তার পুত্র কালকেতুর সাথে বিবাহ। শাশুরবাড়িতে এসে সে শাশুড়ির হৃদয় জয় করে ফেলে। শাশুড়িও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারণ এই বধূ গৃহকর্মে পটু। শুধু তাই নয়-

“যেদিন যতেক পায়   সেদিন তাহাই খায়

দেড়ি অন্ন নাহি থাকে ঘরে। 

তিনবার শরাসন   বিনা আর নাহি ধন 

বন্ধা দিতে পারে না উধারে।।”

নিরন্ন সম্বলহীন পরিবারে এরচেয়ে আর কোন্ গুণ বধূর কাছে আশা করা যায়।

প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহার্য জিনিস ছাড়া এমন অন্যকিছু নেই বন্ধক দিয়ে শাশুড়ি-স্বামী শ্বশুরের মুখে অন্ন তুলে দেবে। ফুল্লরা শাশুড়ির নির্দেশে সংসার কর্মে দীক্ষা নিচ্ছে—

“নিদয়া বইসে ঘাটে   মাংস নিয়া গিয়া হাটে

অনুদিন বেচয়ে ফুল্লরা।

শাশুড়ি যেমন ভনে   তেমন বেচেন কেনে 

শিরে কাঁখে মাংসের পশরা।।”

স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে ফুল্লরার ভাগ্যে অন্নজোটে না, কিন্তু তাতে তার কোনও অনুযোগ নেই—

“নিদয়া আজ্ঞা ধরে   ফুল্লরা রন্ধন করে

আগে ধর্মকেতুর ভোজন।”

এরপর কালকেতুর সুবিপুল ভোজন। তারপর আর কিছু অবশিষ্ট থাকার আশা করা বৃথা। স্বামী পুত্রের ভোজন-তৃপ্তিতে নিদয়ার তৃপ্তি, বধূ ফুল্লরা ইতিমধ্যে সংসারের সাথে একাত্ম হয়েছে। তার কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না। এমন গুণের মেয়ে পেয়ে নিদয়া সুখী।

সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো ফুল্লরার জীবন। গৃহকর্মে সে নিপুণা। তার গৃহকর্ম কেবল গৃহাঙ্গনে আবদ্ধ নয়। কালকেতু শিকার করে আনলে সেই মাংস নিয়ে পসরা করতে যায় গোলহাটে, কখনও যায় গ্রামের গৃহস্থালিতে। চিৎকার করে পসরা করে যে নারীর পথচলা তার চরিত্রে সহনশীলতা, নম্রতা, লজ্জাবোধ থাকা অবিশ্বাস্য। তাই স্বামীর অপদার্থতার জন্য সংসারে যদি অনটন আসে সে তাকে ভর্ৎসনা করতে দ্বিধাবোধ করে না—

‘বিধাতা আমারে দণ্ডী   জিয়ন্তে স্বামী তে রান্ডী

কইল দেব দুঃখের ভাজন।

স্বামীর কর্তব্য ও প্রেমের প্রতি একটা তীব্র অধিকার বোধ ফুল্লরার সর্বকর্ম ও সহনশীলতাকে ভরিয়ে রেখেছে। ধর্মকেতু ও নিদয়া কাশীবাসে যাবার পর ফুল্লরা ও কালকেতুর উপর সংসারের সব ভার পড়ল। ফুল্লরা সংসার একাই সামলাত। তার রান্নার প্রশংসায় কালকেতু বলে—

‘রন্ধন কর্যাছ ভালো আর কিছু আছে।

যা কিছু রান্না করেছে সব কালকেতুর পাতে তুলে দেয়। তাকে উপবাস করেই কাটাতে হত।

যৌথ দায়িত্ব পালনে দাম্পত্য জীবনের শান্তি নিহিত। নিজের দায়িত্ব পূর্ণভাবে বহন করে বলেই স্বামীর প্রতি তার পূর্ণ বিশ্বাস। তাই ছদ্মবেশিনী চণ্ডীকে সে পরামর্শ দেয়—

“সতীনী কোন্দল করে   দ্বিগুণ বলিবে তারে

অভিমানে ঘর ছাড় কেনি।

যদি কর বিষপান   আপনি ত্যজিবে প্রাণ

সতীনের কিবা হবে হানি।।”

ফুল্লরার মধ্যে বাঙালী নারী চরিত্রের পূর্ণ বিকাশ প্রকাশিত। বাঙালী বধূরা সব জিনিস অন্যকে দিতে পারে, কিন্তু স্বামীর ভাগ কাউকে দেয় না। ফুল্লরার সব পরামর্শ যখন দেবী আগ্রাহ্য করেন তখন সপত্নী শঙ্কাতুরা ব্যাধ রমণী তার নিজ জীবনের প্রাত্যহিক দুঃখের কথা বলে তাঁকে বিমুখ করতে চায়। তাতেও যখন কোনও লাভ হয় না তখন সে শাস্ত্রীয় বচন আওড়ায়—

“স্বামী যে পরম ধন    স্বামী বিনে অন্যজন

কেহ নহে সুখ মোক্ষদাতা।”

তাছাড়া ছলনার আশ্রয় নিতেও দ্বিধাবোধ করেনি ফুল্লরা—

“অভাগ্য মনে গুণি, অভাগ্য মনে গুণি।

কত শত খায় জোঁক, নাহি খায় ফণী।।”

ফুল্লরা স্বামী সোহাগিনী নারী। ছদ্মবেশিনী চণ্ডীকে দেখে এতই সতীন ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছিল যে পরে দেবী আত্মপ্রকাশ করলেও সে আশঙ্কা দূর হয়নি। তাই দেবী কালকেতুকে সাত কোটি দামের আংটি দিতে চাইলে সে তা নিতে বাধা দেয়—

“একটি অঙ্গুরী নিলে হবে কোন কাম। 

সারিতে নারিবে প্রভু ধনের দুর্নাম।।”

অশিক্ষিত গ্রাম্য ব্যাধনারীর ধনের প্রকৃত মুল্যবোধের মূর্খতা অবিশ্বাস্য হলেও স্বাভাবিক। কালকেতু ফুল্লরার এই বাধা মানে নি। দেবী প্রদত্ত ধন নিয়ে গুজরাটনগর স্থাপন করেছে। পসরা বিক্রির সঙ্গে রাণী ফুল্লরার আর কোনও যোগ ছিল না, সে অন্দর মহলে আবদ্ধ হয়েছিল।

অবশ্য ফুল্লরাকে বিশেষ ভুমিকায় দেখা যায় কলিঙ্গরাজের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কালকেতুকে ধান্য ঘরে লুকিয়ে থাকতে পরামর্শ দেয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এলে ফুল্লরা। আবার তারই নির্বুদ্ধিতায় ভাঁড়ু দত্ত কালকেতুর গোপন অবস্থান জানতে পেরেছে। তাই ফুল্লরাকে কবি অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে চিত্রিত করলেও তার মধ্যে বুদ্ধির অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।