শিল্প গড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ বা কারণগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—প্রাকৃতিক কারণ এবং অর্থনৈতিক কারণ। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণও কোনাে অলে শিল্পস্থাপনে যথেষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে।

(ক) প্রাকৃতিক কারণ বা পরিবেশ :

জমি : যে-কোনাে শিল্পের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জমির প্রয়ােজন। বিশেষত বৃহদায়তন শিল্পে কারখানার শেড, অফিস-ঘর, কর্মচারীদের থাকার জন্য ঘর প্রভৃতি নির্মাণের জন্য প্রচুর জমি চাই। যেখানে জমি সস্তায় ও সহজে পাওয়া যায় সেখানে শিল্প গড়ে উঠতে পারে। তবে পার্বত্য এলাকা অপেক্ষা সমভূমি শিল্প স্থাপনের অনুকূল। যেমন— হলদিয়া শিল্পাঞ্চল সমভূমিতে গড়ে উঠেছে।

জলবায়ু : একই প্রকার জলবায়ুতে সব ধরনের শিল্প গড়ে ওঠে না। আর্দ্র জলবায়ু বয়নশিল্পের, শুষ্ক ও রােদ ঝলমলে জলবায়ু সিনেমা শিল্পের পক্ষে অনুকূল। কলকারখানার শ্রমিকরা নাতিশীতােয় জলবায়ুতে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারে। পৃথিবীবিখ্যাত হলিউডের (ক্যালিফোর্নিয়া) সিনেমা শিল্প ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে (শুষ্ক ও রােদ ঝলমলে প্রকৃতির) গড়ে উঠেছে।

জলের প্রাচুর্য : অধিকাংশ শিল্পতেই প্রচুর পরিমাণ জলের প্রয়ােজন হয়। কাগজ, লৌহ-ইস্পাত, রাসায়নিক ইত্যাদি শিল্পকেন্দ্রগুলি জল প্রাপ্তির সুবিধার জন্য সাধারণত নদী বা হ্রদের। তীরবর্তী স্থানে। গড়ে ওঠে। যেমন দুর্গাপুর-আসানসােল শিল্পাঞ্চল দামােদর নদের জল ব্যবহার করে। একই কারণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হ্রদ অঞ্চলকে ঘিরে বিভিন্ন শিল্পের সমাবেশ ঘটেছে।

কাঁচামাল : যে-কোনাে শিল্পের প্রধান উপকরণ হল কাঁচামাল। কাঁচামালের বণ্টন ও প্রকৃতি শিল্পস্থাপনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। যেমন—(i) কাঁচামাল অবিশুদ্ধ বা ওজন হ্রাসকারী হলে কাঁচামাল প্রাপ্তিকেন্দ্রের নিকট শিল্পকেন্দ্র গড়ে ওঠে। উদাহরণ চা শিল্প, চিনি শিল্প, তামা শিল্প ইত্যাদি। (ii) কাঁচামাল বিশুদ্ধ হলে শিল্পকেন্দ্র বাজার, কাঁচামালের উৎস স্থল কিংবা অন্য যে-কোনাে জায়গায় গড়ে উঠতে পারে। উদাহরণ—কার্পাস বয়ন শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, ইলেকট্রনিক্স শিল্প ইত্যাদি। (iii) পচনশীল কাঁচামালের কার্যকারিতা দ্রুত নষ্ট হয় বলে কাঁচামাল উৎপাদক অঞ্চলে শিল্প গড়ে ওঠে। উদাহরণ- খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প (জ্যাম, জেলি, স্কোয়াশ, মদ ইত্যাদি)। (iv) অনুসারী শিল্পগুলি সাধারণত শিল্প সমাবেশ অঞ্চলে কিংবা বাজারে গড়ে ওঠে। কারণ এদের জন্য প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল ওইসব এলাকায় পাওয়া যায়। উদাহরণ—হলদিয়ায় পেট্রো রাসায়নিক শিল্পকে কেন্দ্র করে বহু অনুসারী শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।

(খ) অর্থনৈতিক কারণ বা গরিবেশ :

শক্তির সহজলভ্যতা : কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, তাপবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ ও আণবিক শক্তির সহজলভ্যতার ওপর নির্ভর করে শিল্প গড়ে ওঠে। গন্ডোয়ানা কয়লাক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে পূর্ব ভারতের লৌহ-ইস্পাত শিল্পের কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। অসমের চা শিল্পকেন্দ্রগুলিতে ডিব্রুগড়ের তাপবিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়।

সুলভ ও দক্ষ শ্রমিক : সস্তায় দক্ষ শ্রমিকের সহজলভ্যতা শিল্প স্থাপনে প্রভাব ফেলে। ভারী শিল্পের বিকাশ সাধারণত জনবহুল এলাকার কাছাকাছিই ঘটে। যেমন-তুগলি নদীর দুই তীরের পাটকলগুলিতে বিহার ও ওডিশা রাজ্যের প্রচুর শ্রমিক কাজ করে।

বন্দরের অবস্থান এবং উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা : উন্নত যােগাযােগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা এবং বন্দরের অবস্থান শিল্প স্থাপনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। কারণ বন্দর ও উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা থাকলে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি আমদানি করতে ও উৎপাদিত দ্রব্য সস্তায় ও সহজে বাজারে পাঠাতে সুবিধা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের সুবিধা থাকায় জামশেদপুর ও রাউরকেলা ইস্পাতনগরী গড়ে উঠেছে। হলদিয়া বন্দরকে কেন্দ্র করে তেল শােধন শিল্প ও পেট্রোরসায়ন শিল্প গড়ে ওঠেছে।

চাহিদা বা বাজার : উৎপাদিত পণ্যের স্থানীয় বা অভ্যন্তরীণ চাহিদা অথবা আন্তর্জাতিক বাজার থাকা দরকার। না হলে কোনাে শিল্পের বিকাশ ঘটবে না। ভারতের চা ও সুতিবস্ত্রের আন্তর্জাতিক বাজার আছে। সেজন্য ভারতে এই দুটি শিল্পের প্রভূত বিকাশ ঘটেছে।

মূলধন : শিল্পের সমস্ত রকমের পরিকাঠামােগত উন্নতিতে স্থায়ী মূলধন এবং শিল্পকার্য চালানাের জন্য চলতি মূলধন দরকার। সেজন্য যে-কোনাে শিল্প গড়ে তুলতে প্রচুর মূলধন লাগে। বর্তমানে ভারতে শিল্প বিকাশে প্রচুর বিদেশি পুঁজির বিনিয়ােগ ঘটছে।

(গ) রাজনৈতিক কারণ :

সরকারি নীতি : সরকারের উদারীকরণ নীতি, শুল্ক ছাড়, সহজে লাইসেন্স প্রদান, শিল্প আইনের শিথিলতা প্রভৃতি বিষয় শিল্প স্থাপনকে তরান্বিত করে।

রাজনৈতিক স্থিরতা : দেশে সুদৃঢ় সরকার থাকলে শিল্পের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণ দ্রুত করা যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে অথবা সরকার যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকলে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। শিল্পস্থাপনে সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব পরিলক্ষিত হয়।