শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজ বলতে কী বুঝ? শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর |
প্রশ্নঃ শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজ বলতে কী বুঝ? শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
অথবা, শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজ কী? শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ বিপ্লব বলতে মানবসমাজের চিরাচরিত অবস্থানসমূহের ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী মৌলিক পরিবর্তন ও নবরূপায়ণকেই বুঝিয়ে থাকে। বিপ্লবের প্রকাশ আকস্মিক হলেও তা মানবসমাজের কোনো ভূঁইফোড় ঘটনা নয়। প্রত্যেক বিপ্লবের পেছনে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি লোকচক্ষুর অন্তরালে সক্রিয় থাকে। মাটির নীচে যুগ-যুগান্তরের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলে যেমন গলিত পদার্থসমূহ বিস্ফোরক হয়ে আগ্নেয়গিরির উদগীরণ বা ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়। তেমনি প্রতিটি বিপ্লবের পশ্চাতে থাকে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়া । প্রত্যেক মানুষের প্রকাশভঙ্গি যেমন এক প্রকার নয়, তেমনি প্রতিটি বিপ্লবের বহিঃপ্রকাশ, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি ভিন্ন প্রকারের হয়। এ জন্য বিপ্লবকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। যেমনঃ শিল্পবিপ্লব, রুশবিপ্লব, কৃষিবিপ্লব ইত্যাদি। বিপ্লবের অর্থই পরিবর্তন, তাই বিপ্লবের ফলে যে সমাজ গড়ে উঠবে তাতে নতুন বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে বিপ্লবোত্তর সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। বিপ্লবোত্তর সমাজ বলতে কি বুঝি এই প্রশ্নের উত্তর জানতে বিপ্লব সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে।
শিল্প বিপ্লবঃ শিল্পবিপ্লবের স্বরূপ উপলব্ধির জন্য বিপ্লব প্রত্যয়টির পটভূমির প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। জীবনের কোনো ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন অংশের পরিবর্তনের নাম বিপ্লব নয়। কোনো এক বিশেষ সরকারের পতন এবং নতুন সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়া বিপ্লব নামের অযোগ্য। বিপ্লবের যুক্তিসঙ্গত অর্থ হলো এক আকস্মিক ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন যা সমাজের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে এক মহান ব্যতিক্রম। আধুনিক সমাজতত্ত্ববিদের মতে, সমাজজীবনের বিভিন্ন দিককে পুনর্গঠিত করার নামই বিপ্লব।
শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজঃ শিল্পবিপ্লবের সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মানুষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও চিন্তাধারার জগতে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে। এর প্রভাবে বদলে গেছে পৃথিবীর মৌলকাঠামো এবং ভিন্নতা। শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয় তা মানবসভ্যতা ও সামাজিক জীবনের রূপ বদলে দেয়। শিল্পবিপ্লবের পর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও চিন্তাধারায় যে পরিবর্তন হয়ে সমাজ নতুন বৈশিষ্ট্যে আবির্ভূত হয়, তাকেই শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজ বলে।
শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের বৈশিষ্ট্যঃ প্রাক-শিল্পসমাজ এবং শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে, শিল্পবিপ্লবের সুদূরপ্রসারী বৈপ্লবিক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিল্পবিপ্লবের এই প্রভাবের ফলে শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ-শিল্পবিপ্লবের ফলে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও চিন্তাধারায় পরিবর্তন হয়ে সমাজের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় যাকে শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের বৈশিষ্ট্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। নিম্নে শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো-
মানবকল্যাণে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধিঃ প্রাক-শিল্পযুগে দীর্ঘদিন যাবৎ গাছ-পালা, পশু-পাখি, কৃষিদ্রব্য মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আহার ও শক্তি যোগাতে শিল্পবিপ্লব মানুষের সামনে বিরাট এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। মনুষ্য ও পশু শক্তির পরিবর্তে কয়লা, তেল, বিদ্যুৎ পরমাণু ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তিকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মানুষ নিজেদের উন্নয়ন ও কল্যাণে লাগাবার কৌশল আবিষ্কার করে। এ জন্য বলা হয়, শিল্পবিপ্লব মানুষের বিরাট প্রাকৃতিক শক্তিভাণ্ডারকে আয়ত্ত করার এবং তা নিশ্চিতভাবে ব্যবহার করার একটি সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক ঘটনা। বহুদিন যাবৎ প্রাকৃতিক নির্মমতার বিরুদ্ধে মানুষ বেঁচে থাকার যে লড়াইয়ে নিমগ্ন ছিল, শিল্পবিপ্লবের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
বৃহৎ আকারের যান্ত্রিক উৎপাদনঃ শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বৃহৎ আকারের যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়া। শিল্পবিপ্লব উৎপাদন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে। প্রাকৃতিক শক্তিচালিত যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে গৃহকেন্দ্রিক ক্ষুদ্রাকৃতির উৎপাদনের পরিবর্তে বৃহদাকার উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হয়। যার ফলে বিপ্লবোত্তর সমাজে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যথাঃ (১) উৎপাদন বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি পায় (২) উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় (৩) উৎপাদনের অনিশ্চয়তা দূর হয়। (৪) উৎপাদিত দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।
পেশার পরিবর্তন ও নতুন নতুন সামাজিক শ্রেণির উদ্ভবঃ শিল্পবিপ্লবের ফলে বংশানুক্রমে আরোপিত পেশার পরিবর্তন ঘটে । শিল্পভিত্তিক সমাজে মানুষ সহজেই পেশা পরিবর্তনের সুযোগ পায় । এতে মানুষের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দেয়া হয়ে থাকে। শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে নতুন শ্রেণিসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভূ-স্বামীদের স্থান দখল করে পুঁজিপতিদের আবির্ভাব ঘটে। পুঁজিপতিদের শোষণের ফলে শ্রেণিবৈষম্যের উদ্ভব হয় যা শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নঃ শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থাকে। ফলে ভৌগোলিক দূরত্ব হ্রাস পায়। জনজীবন সহজ, দ্রুততর ও আরামপদ হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত এবং শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
গণতন্ত্রের বিকাশ ও শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজঃ শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে গণতন্ত্র পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। একে শিল্পবিপ্লবের রাজনৈতিক প্রভাব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। শিল্পবিপ্লবের সবচেয়ে বড় সামাজিক ও রাজনৈতিক ফসল হচ্ছে গণতন্ত্র যা শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রকাশ পায়। সারা বিশ্বের সমাজব্যবস্থায় এবং চিন্তাধারার পরিবর্তনে গণতন্ত্রের আবির্ভাবকে নিশ্চিত করেছে। ১৮৩২ সালের পর থেকেই সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ের পর। তাই শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রবর্তন।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশঃ শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থাকে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় রূপান্তরিত করে। শিল্পবিপ্লবের ফলে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে শিল্প উৎপাদন পদ্ধতি গড়ে ওঠে। সামান্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ক ও ভূমিদাসের স্থলে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক এবং শিল্পমালিক ও শ্রমিক সম্পর্কের উদ্ভব ঘটায়।
শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নঃ শিল্পবিপ্লবের ফলে সৃষ্ট শ্রম বিভাগ শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতা এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে। ১৮৭০ সালে দুজন শ্রমিক একটি ক্রেনের সাহায্যে যে পরিমাণ পাথর ওঠাতে পারত, ঠিক সে পরিমাণ পাথর ওঠাতে যন্ত্রের প্রয়োগের পূর্বে ৩৬০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হত। পুরনো পদ্ধতিতে একজন কারিগর দিনে তিন জোড়া জুতো বানাতে পারত। আর নতুন পদ্ধতিতে একই কারিগর ৩০০ জোড়া জুতো বানাতে পারে। একটি শিল্পসমৃদ্ধ সমাজের একজন শ্রমিক তার দু’মাসের আয় দিয়ে সারাবছর আহার ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে।
শ্রমিক ইউনিয়নঃ শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমিক ইউনিয়ন। শ্রমিকদের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য শ্রমিক ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এর ফলে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত হয়।
নগরায়ণঃ বিশ্ববিপ্লবোত্তর সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য নগরায়ণ। প্রযুক্তি উন্নতির ফলে নগর বিকাশ লাভ করে। শিল্পের স্থানীয়করণের প্রভাবে নগরায়ণ প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। গ্রামীণ জনগণ ক্রমান্বয়ে শহরে স্থানান্তরিত হয়। এতে নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটে।
শিল্পায়ণঃ শিল্পবিপ্লবের ফলশ্রুতিই হচ্ছে শিল্পায়ণ। শিল্পায়ণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, বিজ্ঞানভিত্তিক যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বৃহদাকারের উৎপাদন পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রক্রিয়াকেই শিল্পায়ণ বলা হয়। শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
(১) শিল্পবিপ্লব মানবসভ্যতাকে সরাসরি সীমারেখা টেনে প্রাক-শিল্প যুগ এবং শিল্পবিপ্লবোত্তর যুগ এ দু’ভাগে ভাগ করে দেয়। অর্থাৎ শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে নতুন যুগের সূচনালগ্ন।
(২) অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা পরিলক্ষিত হয় কুটির শিল্পের স্থানে বৃহৎ শিল্পের উপস্থিতির ফলে।
(৩) সামাজিক সম্পর্কের অবনতি।
(৪) পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তন হয়ে যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারের প্রবর্তন।
(৫) সামাজিক সমস্যার বহুমুখিতা।
পরিশেষঃ শিল্পবিপ্লবের ফলেই শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের উৎপত্তি। আর শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজব্যবস্থায় বিশেষ করে শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সময়ে সমাজের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও চিন্তাধারায় যে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তাকে শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের বৈশিষ্ট্য বলা হয়ে থাকে। তবে শিল্পবি প্লবোত্তর সমাজের বৈশিষ্ট্য যে অবিমিশ্র আশির্বাদ নয় তা উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
Leave a comment