শিখন ও পরিণমন দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে শিখন পরিণমনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বয়ংনির্ভর শিখনের দ্বারা পরিণমনকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেও পরিণমন দ্বারা শিখনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। শিখন হল আচরণধারার এমন এক স্থায়ী পরিবর্তন যা অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের দ্বারা অর্জন করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির আচরণের পরিবর্তন ঘটিয়ে অভিযােজন ক্ষমতা অর্জন করা যায়।


অন্যদিকে, পরিণমন হল এমন এক প্রক্রিয়া যা অনুশীলন বা শিখন নিরপেক্ষ এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ব্যক্তির মধ্যে এটি সংঘটিত হয়ে ব্যক্তির বিকাশ ঘটায়। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক উপায়ে সুনির্দিষ্টভাবে বিকশিত হতে থাকে। অর্থাৎ পরিণমন হল পরিপক্কতা বা স্বাভাবিক পরিণতি।

শিক্ষাক্ষেত্রে পরিণমনের গুরুত্ব

(১) দৈহিক ও মানসিক প্রক্রিয়া: শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশের দ্বারা তার পরিণমনের প্রকাশ ঘটে। এর ফলে শিশুর ভাষার বিকাশ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকাশ ঘটে। শিশু পাঠগ্রহণে সক্ষম হয়।

(২) শিখনের গতি ও সীমা নির্ধারণ: শিখনের গতি ও সীমা নির্ধারণে পরিণমনের ভূমিকা লক্ষ করা যায়। নির্দিষ্ট পরিণমনের পর শিশুর শিখন শুরু হয় এবং তা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে থাকে। পরিণমনই ঠিক করে দেয় কোন সময়ে কোন ধরনের শিখন সার্থক ও সফল হবে।

(৩) ভাষাবিকাশ: শিক্ষার্থীর ভাষাবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পরিণমন। উপযুক্ত পরিণমন ছাড়া কখনােই শিক্ষার্থীর ভাষাবিকাশ সম্ভব নয়। 

(৪) জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের সমন্বয়: শিক্ষার্থীর সার্থক বিকাশের উপর নির্ভর করে জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের সমন্বয়সাধন, যা শিক্ষার্থীকে যে-কোনাে বিষয় শিখতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

(৫) শিখনের পরিণমনের ধরন নির্ধারণ: অনেকক্ষেত্রে শিখন পরিণমনের ধরন নির্ধারণ করে। যেমন- কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাঠ্যের বিষয় অনুশীলনের মধ্য দিয়ে শিশুদের ইন্দ্রিয়সমূহকে পরিমার্জনের শিক্ষা দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে পরিণমন শিখন দ্বারা নির্ধারিত হয়।

(৬) জীবনবিকাশ: শিক্ষার্থীদের জীবনবিকাশে শিখন গুরুত্বপূর্ণ। আর শিখনকে ফলপ্রসূ করতে পরিণমনের বিকাশ আবশ্যক।

(৭) পাঠ পরিকল্পনা: শিক্ষার্থীর জীবনবিকাশে যেহেতু পরিণমন গুরুত্বপূর্ণ সেহেতু পরিণমনের উপর নির্ভর করে শিশুর পাঠক্রম নির্বাচন করা হয়।

(৮) পরিকল্পনামাফিক শিক্ষা পরিকল্পনা: পরিণমন যদি সঠিকভাবে না হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের পাঠগ্রহণে সমস্যা দেখা যেতে পারে। তাই পরিণমন শিক্ষা পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(৯) পরিণমনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা: শৈশব, বয়ঃসন্ধি এসব পর্যায়ে সঠিক পাঠক্রম রচনার জন্য পরিণমনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়ােজন।

(১০) শিখন ত্বরান্বিতকরণ: পরিণমন শিখনকে ত্বরান্বিত করে। শিক্ষার্থীর উপযুক্ত পরিণমন হলে যে-কোনাে বিষয় অতি দ্রুত আয়ত্ত করতে পারে।

(১১) আত্মপ্রত্যয় বৃদ্ধি: উপযুক্ত পরিণমন যথাযথ পাঠগ্রহণের সহায়ক। পরিণমনের পর্যায়ের প্রতি লক্ষ রেখে শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করলে সেই শিক্ষা অধিক ফলপ্রসূ হয় এবং আত্মপ্রত্যয় (Self confidence) বৃদ্ধি পায়।

(১২) শিখন প্রচেষ্টার কার্যকারিতা বৃদ্ধি: ব্যক্তির শিখন প্রচেষ্টাকে অধিক কার্যকরী করতে পরিণমন প্রক্রিয়ার বিশেষ প্রয়ােজন। পরিণমনজনিত ফল পরবর্তী শিখনে শিক্ষার্থীকে আগ্রহী করে।

(১৩) অল্প শ্রমে অধিক সুফল: পরিণমন শিক্ষা প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। শিক্ষার্থীর যথােপযুক্ত পরিণমন তাকে যে-কোনাে কর্মপদ্ধতি আয়ত্ত করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট বয়সে নির্ধারিত বিষয়ে শিক্ষারম্ভ করলে কম শ্রমে অধিক সুফল পাওয়া যায়।

(১৪) জটিল ও উন্নত আচরণ সম্পাদন: উন্নত ও জটিল আচরণগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে সক্রিয় করে তােলে। ফলে শিক্ষার্থী যে-কোনাে জটিল সমস্যার সমাধান সহজে করতে পারে। 


আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, পরিণমন শিশুর শিক্ষার সূচনা থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিণমনের বিভিন্ন স্তরে বিচারবিবেচনা করে শিক্ষার আয়ােজন করলে সেই শিক্ষা শিশু অতি সহজে গ্রহণ করতে পারবে এবং শিক্ষা সার্থক হবে।