ভূমিকা: বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসে, বিশেষত শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অশিক্ষার অন্ধকার দূর করে স্বদেশবাসীকে শিক্ষিত ও জ্ঞানের আলােয় আলােকিত করতে বিদ্যাসাগর সনাতন শিক্ষার সঙ্গে যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন।
[1] স্ত্রীশিক্ষার প্রসার: শিক্ষার অভাবে নারীজাতি পিছিয়ে রয়েছে, শিক্ষা ছাড়া নারীসমাজের মুক্তি নেই বলে বিদ্যাসাগর মনে করতেন। নারীশিক্ষার পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের সাহায্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৪৯ খ্রি.) হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় (এখনকার বেথুন স্কুল)। তিনি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় বাংলার বিভিন্ন জেলায় (হুগলিতে ২৩টি, বর্ধমানে ১১টি, মেদিনীপুরে ৩টি, নদিয়ায় ১টি) মােট ৩৮টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যেগুলিতে প্রায় ১৩০০ ছাত্রী পড়াশুনার সুযােগ পেয়েছিল। তিনি মায়ের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশে নিজের জন্মস্থানে বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৯০ খ্রি.)। তিনি নারীকে শিক্ষিত করে তাদেরকে সম্মানের আসনে বসাতে চেয়েছিলেন।
[2] উচ্চশিক্ষার সুযােগ বৃদ্ধি: বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পদ গ্রহণ (১৮৫০ খ্রিঃ ডিসেম্বর) করার পর দেখেন এই কলেজে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য শ্রেণীভুক্ত ছাত্ররাই পড়ার সুযােগ পেত। তাই এই কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে (১৮৫১ খ্রি., ২২ জানুযারি) প্রথমেই তিনি সংস্কৃত কলেজের দরজা সকলের জন্য খুলে দেন। উচ্চশিক্ষার সুযােগ বাড়ানাের লক্ষ্যে তিনি নিজের খরচে প্রতিষ্ঠা করেন। (১৮৭০ খ্রি.) মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন (এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ)। এ ছাড়াও তিনি হিন্দু পঞ্জিকা নিদের্শিত তিথি-নক্ষত্র মেনে ছুটি দেওয়ার রীতি বাতিল করে রবিবারকে ছুটির দিন হিসেবে ধার্য করেন ও কলেজে অধ্যাপকদের নিয়মিত আসার নিয়ম চালু করেন।
[3] আধুনিক পাঠক্রম প্রণয়ন: বিদ্যাসাগর ‘বর্ণমালা’, ‘কথামালা’, ‘বােধােদয়’ প্রভৃতি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। বিদ্যাসাগর শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়গুলির পাঠক্রম পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে পাটিগণিত, জ্যামিতি, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়কে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন।
[4] বিদ্যালয় পরিদর্শক: বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসি ও ছােটোলাট হ্যালিডের অনুমােদনের ফলশ্রুতিরূপে হুগলি, মেদিনীপুর, বর্ধমান ও নদিয়া জেলায় Circle School’ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে বিদ্যাসাগর মাসিক পাঁচশত টাকা বেতনের বিনিময়ে দক্ষিণ বাংলার ওই চার জেলায় ৫টি করে ২০টি বাংলা স্কুল স্থাপিত হয়। বিদ্যালয় পরিদর্শকরূপে বিদ্যাসাগর তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীবিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলিতে একজন প্রধান পণ্ডিত এবং দুজন সহকারী পণ্ডিতের মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিচালনার পরিকল্পনা নেন। এ সময়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে ৫টি মডেল স্কুলের (নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর) শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সংস্কৃত কলেজের মধ্যে নর্মাল স্কুল (১৮৫৫ খ্রি. ১৭ জুলাই) গড়ে ওঠে। এই স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব পান অক্ষয়কুমার দত্ত ও মধুসূদন বাচস্পতি।
[5] বাংলা গদ্যের স্রষ্টা: সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত হলেও বিদ্যাসাগর এটা বুঝেছিলেন যে, বাংলা ভাষাই হল শিক্ষার গণমুখী প্রচেষ্টার প্রধান মাধ্যম। অলংকারসর্বস্ব ও সংস্কৃতঘেঁষা বাংলা ভাষা বিদ্যাসাগরের হাতের ছোঁয়ায় আগের থেকে অনেক সাবলীল ও গতিশীল হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষাকে আধুনিক রূপদান করা ও তাতে এক নতুন শব্দবিন্যাস রীতির প্রচলন ঘটানাে বিদ্যাসাগরের অসামান্য কীর্তি। যতিচিহ্নের যুক্তিসম্মত ব্যবহার ও বড়াে বাক্যকে কয়েকটি ছােটো বাক্যে ভেঙে ব্যবহার রীতির তিনিই প্রচলন ঘটান। তাঁর এই রীতিকে পরবর্তী সময়ে অনুকরণ করেছিলেন মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেকেই।
[6] লেখক: অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী বিদ্যাসাগর নিছক শিল্পসৃষ্টির তাগিদে সাহিত্য রচনা করেননি, তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থই জনশিক্ষার প্রয়ােজনে রচিত। ‘বর্ণপরিচয়’ ১ম ও ২য় ভাগ (১৮৫৫ খ্রি.), বােধােদয় (১৮৫১ খ্রি.), ‘কথামালা’ (১৮৫৬ খ্রি.), ‘নীতিবােধ’, ‘চরিতাবলি’ (১৮৫৬ খ্রি.) ইত্যাদি রচনার পাশাপাশি সহজে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য তিনি রচনা করেন ‘উপক্রমণিকা’ (১৮৫১ খ্রি.), ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ (১৮৫৩ খ্রি.) প্রভৃতি গ্রন্থ। তিনি ‘আখ্যানমঞ্জরী’ (১৮৬৩ খ্রি.) ‘শব্দ মঞ্জরী’ (বাংলা ভাষা অভিধান ১৮৬৪ খ্রি.), ‘শ্লোক মঞ্জরী’ (১৮৯০ খ্রি.) সংকলন করেন। তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩ খ্রি.), ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৪ খ্রি.), ‘রত্নপরীক্ষা’ (১৮৮৬ খ্রি.) প্রভৃতি।
[7] অনুবাদ: অনুবাদকরূপে বিদ্যাসাগর অসাধারণ মুনশিয়ানার পরিচয় দেন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত, হিন্দি, ইংরেজি বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থ অনুবাদ করেন। হিন্দি ‘বেতাল পচ্চিশির’ বঙ্গানুবাদ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭ খ্রি.), কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ অনুসরণে ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪ খ্রি.) ভবভূতির উত্তর রামচরিত’ অবলম্বনে ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০ খ্রি.), শেকসপিয়র রচিত ‘কমেডি অব এররস’-এর ভাবানুবাদ ‘ভ্রান্তিবিলাস’, মার্শম্যানের ‘History of Bengal’ গ্রন্থটির অনুবাদ ‘বাংলার ইতিহাস’ ছিল তাঁর উল্লেখযােগ্য অনুবাদ সাহিত্য। ঈশপের ‘ফেবলস’-এর অবলম্বনে তিনি রচনা করেন ‘কথামালা’।
উপসংহার: বিদ্যাসাগর শিক্ষাকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম বলে মানতেন না। তার কাছে শিক্ষা ছিল মনুষ্যত্বে উত্তরণের সিঁড়ি।
Leave a comment