লেখক একজন শ্রুতকীর্তি বৈজ্ঞানিক ও কীর্তিমান শিক্ষক। বছরের পর বছর অসংখ্য ছাত্রদের সংস্পর্শে এসে লেখক ছাত্রসমাজের ব্যর্থতা ও অপচয়, শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিকে নিকট থেকেই লক্ষ করেছেন। এই বিষয়ে লোক-অভিজ্ঞতানির্ভর, কেবলমাত্র তথ্যনির্ভর নয়। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক দেখিয়েছেন ছাত্রদের মধ্যে কোনো উপাদানগত তারতম্যের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় তাদের ব্যর্থতা আসে না। লেখক মনে করেন কৃতী শিক্ষকদের মেধাবী পরিচালনায় ছাত্রদের গুণগত উৎকর্ষ সম্ভব। কিন্তু তার সঙ্গেও প্রয়োজন পদ্ধতিগত পরিবর্তনের। এদেশে ইংরেজ আসার পর থেকে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার পদ্ধতি ও ব্যবস্থা নির্ণীত হয়ে এসেছে। দীর্ঘকালীন এই ব্যবস্থার ফলে এদেশে শিক্ষা ও ছাত্ররা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই ব্যবস্থার ফলে শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে ব্যবধান শুরু হয়। শিক্ষক বিষয়কে ছাত্রদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন কি না, সে সম্বন্ধে আশ্বস্ত হতে পারেন না। কারণ বিদেশি ভাষার ওপর ছাত্রদের অধিকার যৎসামান্যই থাকে। এই অবস্থায় লক্ষ করা যায় ছাত্রদের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না, এবং পরবর্তীকালের নানা পরীক্ষায় তাদের অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতা এই সত্যকেই প্রমাণিত করে। কথাবার্তায় ও শিক্ষার বাহনে সব সময় ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে হলে তরুণ শিক্ষার্থী সব সময় নিজের ভাষায় মনের ভাবকে প্রকাশ করতে পারেন না। শিক্ষকও কৃতনিশ্চয় না তাঁর কর্তব্যের সম্পূর্ণতা সম্পর্কে। এই ব্যাপারে একটা ব্যবধান ও অসম্পূর্ণতা থেকেই যায়।

অনেকেই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার মতের পরিপন্থী ধারণায় বিশ্বাস করেন। বিরুদ্ধবাদীদের মতে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজিকে ব্যবহার কোনোমতেই শিক্ষাস্বার্থের অনুকূল নয়। কারণ নানাদেশের নানা প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তরঙ্গ যোগসূত্র অক্ষুণ্ণ থাকে না। শিক্ষার academic mobility নষ্ট হয়। এঁরা বলেন, উগ্র প্রাদেশিকতার প্রতিষেধক চিন্তা হিসেবে এই মত গ্রহণযোগ্য। এ ছাড়াও বিচিত্র ভাবাদর্শের অবাধ লেনদেন হতে পারে। এঁদের মধ্যে অনেকেই সাহসে ভর করে বলবেন যে ইংরেজের দাসত্বশৃঙ্খল থেকে মুক্তি নিয়েও তার শেষ স্বর্ণসূত্র ইংরেজি ভাষার ইতিবাচক গুরুত্ব যথেষ্ট। এই সব মতাবলম্বীরা ইংরেজি ভাষার অপরিহার্যতার কথা তো অকপটে বলে চলে এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ধারণার পরিপন্থী কথা বলেন। তিনি বলেছেন, “এইসব লোক এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় আদর্শে বিশ্বাসী।” কারণ এই সব মতাবলম্বীরা মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃষ্ঠপট হিসেবে ক্লাসিক্স চর্চা বিশেষ প্রয়োজনীয়। বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্বকে একটা সীমার বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া অর্থহীন।

এঁরা বিশ্বাস করেন, কল্যাণরাষ্ট্র (Welfare State) প্রতিষ্ঠার উপযোগী হাতিয়ার হিসেবে ক্লাসিকস বা প্রাচীন দর্শনের উপযোগিতা বিরাট। এই যুক্তিধারার বিরুদ্ধে লেখক প্রাচীন দর্শনের পর্যালোচনা করেছেন। গণতান্ত্রিক দেশে ইতিহাসের শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে বহু মতামত প্রচলিত আছে। এই মত প্রকাশের স্বাধীনতাও বিভিন্ন ভাবুকের মধ্যে আছে। “কিন্তু ভারতীয় সভ্যতার অবনতির কারণ সম্বন্ধে একাধিক ব্যাখ্যার অবকাশ আছে।” লেখক এই প্রসঙ্গে নালন্দা ও তক্ষশিলার শিক্ষাব্যবস্থায় পারলৌকিকতা সম্পর্কে যে পোষকতা করা হত, তার উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, পারলৌকিকতা ও ব্যক্তি মুক্তির আদর্শ মানুষকে ইহ-বিমুখ করে তোলে। তাঁর মতে অধিকাংশ মানুষ এই ভারতীয় ভাবাদর্শের দ্বারা লালিত হয়ে দেশের ও দশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারে না। এদেশের একদল দার্শনিক এই ধরনের মনন, ভাবাদর্শের উৎকর্ষ সম্পর্কে আস্থাবান। কিন্তু ‘জগৎ দু’দিনের পান্থশালা’ এই উক্তি মানুষকে পার্থিব জীবন সম্পর্কে উদাসীন করে তুলেছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ফলে নিজেদের সংগ্রামীশক্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে ও দেশ বিদেশি হানাদারদের ক্ষেত্রভুক্ত হয়ে চলেছে। আচার্য বসুর মতে, এই ধরনের চিন্তা জীবনের গুরুত্ব বোঝাতে সাহায্য করে না। পারলৌকিকতার সঙ্গে পার্থিব দায়িত্ববোধ শিক্ষার প্রধান বিষয় হওয়া উচিত।

‘মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার’ প্রকল্পটি লেখক কেবল তত্ত্ব হিসেবে দেখেননি, জাপানে গিয়ে জাপানি ছাত্র-গবেষকদের সঙ্গে মিশে তিনি এই সত্যের অভিজ্ঞতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জাপানে বিজ্ঞান-বিষয়ক Seminar-এ যোগদান করে লেখক সেখানে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্বকে প্রত্যক্ষ করেছেন। আলোচনাচক্রে জাপানি বৈজ্ঞানিকরা কীভাবে দোভাষীর মাধ্যমে তাঁদের চিন্তাকে বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের প্রতিবাদ বা অনুমোদনের সংবাদ গ্রহণ করেছেন, তার উল্লেখ করেছেন। জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছেন কীভাবে মাতৃভাষার মাধ্যমে দুরূহ গ্রন্থ পাঠ করে তাঁরা দেশবিদেশের গবেষণার সুফলকে কাজে লাগিয়েছেন। “বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা নিজেদের মধ্যে বিভাগের আলোচনা করেন মাতৃভাষায়।” তাঁদের শব্দভাণ্ডারে বহু Loan words থাকে কিন্তু তার জন্য তাঁরা কুণ্ঠিত বা দ্বিধান্বিত নন। পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল জানার জন্য জাপানি ছাত্ররা উৎকণ্ঠিত থাকেন, এবং এ ব্যাপারে ভারতীয় মতামতকে নিরপেক্ষ বলে মনে করেন। তবু এদেশে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা ইংরেজিতে লেখেন। ভাষার দূরত্বের জন্য দেশবাসীরা বিষয়টির প্রসঙ্গে অজ্ঞ থাকেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রচেষ্টা যদি সফল হত, তাহলে হয়তো এই সমস্যা এত প্রকট হয়ে উঠত না। সাধারণ মানুষ, ছাত্র ও কৌতূহলী বা জিজ্ঞাসু জন এ-সব নিয়ে বিজ্ঞানশিক্ষার সুফল থেকে বঞ্চিত হত না।

লেখক মনে করেন, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ইংরেজি থেকে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা গেলে মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানশিক্ষার বাধা দূরীভূত হত। শিক্ষক ও ছাত্ররা কোনো বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনার সময় ইংরেজি শব্দের তর্জমা করার পন্ডশ্রম এড়িয়ে তাকে অনায়াসে গ্রহণ করে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারেন। শিক্ষকের দায়িত্ব হবে ভাষা প্রয়োগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে মনোযোগের সঙ্গে দেখা। এর ফলে জনমানসে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হবে।

লেখকের প্রস্তাব এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হোক যার বিশেষ ঝোঁক থাকবে বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের ওপর। এই বিশ্ববিদ্যালয় চালানো হবে কোনো ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে। এইভাবে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সার্থকতা সফল হবে।