প্রতি বৎসর ভারতবর্ষ থেকে বহু ছাত্র বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিল্প-প্রতিষ্ঠানে ও কারখানায় পঠনপাঠনের উদ্দেশ্যে যায়। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার অভাবে আধুনিক কর্মপদ্ধতি দ্রুত আয়ত্ত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আধুনিক ইঞ্জিন ও যন্ত্রপাতি চালাতে বললে ভারতীয় ছাত্ররা শঙ্কিত হয়ে পড়ে—এ অভিমত আমেরিকান শিক্ষাবিদদের। প্রবন্ধকার এই ঘটনাকে শিক্ষাসমস্যা হিসেবে লক্ষ করেছেন এবং ছাত্রদের প্রাথমিক প্রস্তুতির অভাবকে তাদের ব্যর্থতা ও দেশের জাতীয় অপচয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই উপলব্ধি শিক্ষাবিদ হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বিশিষ্ট উপলব্ধি। আধুনিককালে শিক্ষাসমস্যা আলোচনা করতে গিয়ে এই মৌল তত্ত্বটিকে লেখক তুলে ধরেছেন। এই প্রাথমিক ত্রুটির কারণ খুঁজতে গিয়ে লোক প্রচলিত পথে কেবল ছাত্রদের দোষ দেখেননি, তাদের পরিচালকদের পরিচালন ব্যবস্থার অসম্পূর্ণতার কথাও উল্লেখ করেছেন।
এই প্রাথমিক ত্রুটি-সঞ্জাত ‘সময় ও প্রয়াসের এই অপচয়’ এড়ানো যায় কি না সে সম্পর্কে লেখক আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের শিক্ষণব্যবস্থার অসম্পূর্ণতার সন্ধান ও বিশ্লেষণ আলোচ্য প্রবন্ধে করা হয়েছে। লেখকের ভাষায়, “আমার বোধহয় সময় ও প্রয়াসে এই অপচয় এড়ানো সম্ভব। একমাত্র যদি আমরা আমাদের শিক্ষণপদ্ধতির অসম্পূর্ণতার সন্ধান ও বিশ্লেষণ করি এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে তা অপসারণের কাজে দৃঢ়ভাবে ব্রতী হই।” এই প্রয়াস থেকে উদ্ভূত হয়েছে তাঁর সমাধান সূত্র। এই সমাধান সূত্রের মধ্যে লেখকের প্রস্তাব, “কিছুদিন আগে এই প্রস্তাব আমি এনেছিলাম যে, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তনের এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরেই শিক্ষার বাহন হিসাবে মাতৃভাষা ব্যবহারের সময় এসে গেছে।” মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ফলে শিক্ষণীয় বিষয়গুলি শিক্ষকের কাছে অস্পষ্ট থাকে না। শিক্ষার্থীর মধ্যে বিষয়ের প্রতি অগভীর অনুপ্রবেশ দেখা দেয়। শিক্ষক আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ হন এই কথা ভেবে যে তিনি ছাত্র-মানসে আলোচ্য-বিষয়ের সবটুকু বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু এই সহজ-সত্যকে বুঝবার মধ্যে ধৈর্য্য ও সুমতি সকলের থাকে না। ফলে প্রায় স্বতঃসিদ্ধ বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয়। বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তি এই যে ইংরেজি ভাষা থাকার ফলে academic mobility অর্থাৎ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দান-প্রতিদান সহজ হয়ে ওঠে। অনেকেই মনে করেন যে পরাধীনতার দাসত্বশৃঙ্খল ঘুচে গেলেও ইংরেজি ভাষার স্বর্ণশৃঙ্খল এখনও হিতকারী বস্তু, কারণ সংহতির সূত্রটি এখানেই নিহিত। লেখক মনে করেন “এই সব লোক এখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় আদর্শেই বিশ্বাসী”। এই সব জ্ঞানাবলম্বীরা ঐতিহ্যপন্থী। তাঁরা পাঠ্যবিষয়ে ক্লাসিক্স পাঠ গ্রহণের পক্ষে। এদের মতে, পুরোনো আদর্শের স্থান নিতে পারে বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে এমন কিছুই নেই। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে সংস্কৃতি ও উদ্দেশ্যমুখীন জীবন গড়ে তোলা সম্ভব শুধু প্রাচীন দর্শনের ভিত্তিতে। এই দর্শন হল অহিংসা দর্শন।
কিন্তু ভারতীয় সভ্যতার অবনতির একাধিক কারণ সম্পর্কে অনেক ব্যাখ্যা আছে। নালন্দা ও তক্ষশিলার মতো শিক্ষাকেন্দ্রে পারলৌকিকতার আদর্শ পোষকতা করা হত। এই আদর্শ ছিল প্রাচীন সংস্কৃতির মেরুদণ্ডস্বরূপ। এর ফলে ব্যক্তিবিশেষের আত্মজ্ঞান লাভ ও পৃথিবীকে ‘দুদিনের পান্থশালা’ বলে মনে করা হত। এই জীবন-বৈরাগী দর্শন মানুষকে ইহবিমুখ করে তুলত এবং জগৎ ক্ষণিকের এই প্রকারে মানুষ পার্থিব ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ত। ভারতীয়রা এই ব্যাপারেই ক্রমশ জাগতিক ব্যাপারে আধিপত্য হারাল। এই ভাবাদর্শ সম্পর্কে লেখকের ধারণা এই যে পার্থিব ব্যাপারে ঐতিহ্য অপেক্ষা মানুষের প্রগতি, “জাতীয় পতাকার অগ্রগতি” বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেসব প্রয়াস দুঃখদারিদ্র্য-ব্যাধি ও মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে, সেই সব প্রয়াস চর্চা করলে মানুষের ও মানবসমাজের কল্যাণ হতে পারে। বস্তুবাদী দার্শনিকের মতে, এই পারলৌকিকতা আসলে জড়ত্ব ও স্বার্থপরতার নামান্তর। ব্যক্তির মুক্তির সাধনার জন্য মানুষ লোকালয় ছেড়ে গিরিগুহায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু সমাজের মানুষদের জন্য পড়ে থাকে অশুভ শক্তির সঙ্গে সংঘাত। এই দর্শনের প্রাধান্যের সময় এদেশের প্রথমসারির চিন্তাবিদরা জীবনের মূল্যবত্তা সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলত। দর্শনের প্রতি মৌখিক আনুগত্য জানালেও নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ বা হানাহানি লেগেই থাকত। সেই সুযোগে বিদেশি আক্রমণকারীরা এদেশে এসে হানা দিত। ভারতবর্ষে এইভাবে এল শতাব্দীব্যাপী দাসত্ব। এইভাবে লেখক ইতিহাসের ধারা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং এই আলোচনা যে বস্তুনিষ্ঠ ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, সেই মত পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। এ-সবের সমাধানসূত্রের অন্যতম হল স্বামী বিবেকানন্দের কর্মবাদ বা দুর্গত মানুষের সেবাব্রত।
মাতৃভাষা যে শিক্ষার বাহন হওয়া প্রয়োজন জাপান গিয়ে লেখক এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেখানে বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনাচক্রে যোগ দিয়ে লেখক দেখেন যে দোভাষীর মাধ্যমে বিজ্ঞানের কত জটিল আলোচনা সুসম্পন্ন হয়েছে। সব বিদেশি বৈজ্ঞানিক তাদের নিজ নিজ ভাষায় বিজ্ঞানের জটিল ও বিমূর্ত ভাবনা পৌঁছে দিত দোভাষীরা। জাপানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার আধুনিকতম দিক পড়ানো হচ্ছে জাপানি ভাষায়, জাপানি ছাত্ররা বহু দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন জাপানি ভাষায় পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল সম্পর্কে দুজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর ইংরেজিতে লেখা বইয়ের তর্জমা হয়েছে জাপানি ভাষায়। বইটি বিক্রি হয়েছে ভালোই, সকলেই গ্রহণ করেছেন কিন্তু আমাদের দেশে ওই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ইংরেজিতেই লিখে চলেছেন ও তার ফলে তাদের দেশবাসীর অধিকাংশ পারমাণবিক ভস্মপাত সম্পর্কে অজ্ঞ থেকেছেন। অনেকে মনে করেন পরিভাষার অভাব বিজ্ঞানচর্চায় বাধাস্বরূপ হয়েছে। কিন্তু লেখক মনে করেন বিজ্ঞানশিক্ষার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বহু শব্দ যাকে বলা চলে ধার-করা শব্দ তাকে কাজে লাগানো যাবে। এদেশে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার খুবই প্রয়োজন যেখানে বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব চর্চার ওপর জোর থাকবে এবং যেটি চালানো হবে ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে।
লেখকের এই অভিমত একালের বিজ্ঞানশিক্ষা ও ভাষাসমস্যার সঙ্গে যুক্ত। এদেশে বিজ্ঞানশিক্ষার উন্নতির জন্য মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা যে গুরুত্বপূর্ণ তা এই প্রবন্ধে লেখক বার বার তুলে ধরেছেন। বিষয়ের ভিতরে প্রবেশ গভীর হয় না যদি না বিষয়টি মাতৃভাষায় সম্ভব হয়। কারণ মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ যত সহজেই পরাবিদ্যাকে স্বকীয় করে তুলতে পারে এমন আর কোনো ভাবেই পারে না। লেখকের এই মতের সপক্ষে তাঁর জাপান যাত্রার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রবন্ধের বিষয় আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক। কারণ শিক্ষাসংকটের এক বিশিষ্ট দিক এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। স্বদেশে-বিদেশে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বিজ্ঞান শাখায় পরীক্ষা দিয়ে সাফল্য অর্জন করতে পারে না, এগুলি যে জাতীয় অপচয় একথা অস্বীকার করা যায় না। সেই অপচয় নিরোধে লেখকের প্রস্তাব যুক্তিগ্রাহ্য ও বুদ্ধিনিষ্ঠ। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য স্বদেশের প্রগতি, বিজ্ঞানের উন্নতি ও জাতীয় পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রেরণা। শিক্ষা যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে পারে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত না হলে দেশের বা ইতিহাসের সঠিক অগ্রগতির সন্ধান করা চলে না। মানবতা শিক্ষার প্রধান কথা। জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে মানুষের মহিমাকে স্বীকৃতি দেওয়াই শিক্ষার লক্ষ্য। উপলব্ধি করতে হবে যে সব মানুষ মূলত এক। “এই শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রচার করতে হবে।”—এটি আদর্শ প্রবন্ধটির সদর্থক দিক। লেখকের চিন্তা যে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক, এখানে সেই আলোচনা প্রাঞ্জল ভাষায় করা হয়েছে। শিক্ষাসমস্যা সম্পর্কে যে ভাবনা চিন্তাশীল বৈজ্ঞানিক আচার্য বসু এখানে উপস্থাপন করেন, সেই ভাবনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। ‘শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা’—এই সূত্রকে বিমূর্ত তত্ত্ব হিসেবে লেখক দেখেননি। তাকে অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখেছেন। এই প্রবন্ধে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচিত হয়েছে তাহল, ভারতীয় শাশ্বত মোক্ষদর্শন সম্পর্কে প্রাচীন শাস্ত্রের নির্দেশ সম্পর্কে লেখকের অভিমত। এই অভিমতের চর্চার ফলে মানুষ ব্যক্তি মুক্তিকে বড়ো করে দেখেছে। সমষ্টির উন্নতি ও জাতীয় পতাকার সম্মানের কথা গৌণ হয়ে গেছে। দেশের ও দশের উন্নতি, ‘জীবে সেবা, বিবেকানন্দের কর্মবাদের মহত্ত্বে এই বাস্তব চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে। লেখক এই দিকটাকে প্রতিষ্ঠা করে তাঁর বস্তুবাদী মননকে সারার্থ বলে তুলে ধরেছেন।
Leave a comment