পাঠক্রমের উদ্দেশ্যই শিক্ষার লক্ষ্য বাস্তবায়িত করা। আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে শিক্ষার বহুমুখী লক্ষ্যের উল্লেখ করা হয় বিকাশমূলক লক্ষ্য, জ্ঞানার্জনের লক্ষ্য, সামাজিক লক্ষ্য, কৃষ্টিমূলক লক্ষ্য, বৃত্তিমূলক লক্ষ্য ইত্যাদি। শিক্ষার এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পাঠক্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে নীচে আলােচনা করা হল一

(১) বিকাশমূলক লক্ষ্য ও পাঠক্রমের উপযােগিতা : শিক্ষার বিকাশমূলক লক্ষ্য বলতে বােঝায় শিশুর বিভিন্ন দিকের বিকাশে (যেমন শারীরিক, বৌদ্ধিক, সামাজিক এবং প্রাক্ষোভিক বিকাশ) সাহায্য করা।

  • শারীরিক বিকাশের লক্ষ্য হল দৈহিক ও সালনমূলক কাজগুলিকে উৎকৃষ্টভাবে সম্পন্ন করা। এর জন্য বিষয়গত পাঠক্রম হিসেবে যেমন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তেমনি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি হিসেবে খেলাধুলাে, জিমনাস্টিক, ড্রিল ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়।

  • সামাজিক বিকাশের লক্ষ্য হল পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তােলা, বিভিন্ন আর্থসামাজিক পটভূমি থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তােলা, দুঃখ ও আনন্দকে ভাগ করতে শেখা, পারস্পরিক সহযােগিতা ইত্যাদি। এজন্য পাঠ্যবিষয় হিসেবে ইতিহাস, ভূগােল, অর্থনীতি ইত্যাদি পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সমাজসেবা, দলগতভাবে বিদ্যালয়ের নানা অনুষ্ঠান পরিচালনা করা ইত্যাদি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

  • প্রাক্ষোভিক বিকাশের লক্ষ্য হল একদিকে দুশ্চিন্তা, ক্রোধ, ভয় ইত্যাদি অর্থাৎ শিখনের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করা; অন্যদিকে শ্রদ্ধা, ভালােবাসা, বিনয় প্রভৃতি অর্থাৎ শিখনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রক্ষোভ অনুশীলন করা। প্রাক্ষোভিক বিকাশকে বাস্তবরূপ। দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে যাতে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে তার ব্যবস্থাকে পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে সুনিশ্চিত করা।

  • বৌদ্ধিক বিকাশ বলতে বােঝায় ভাষার বিকাশ, যুক্তি, ক্ষমতা, বিমূর্ত চিন্তনের ক্ষমতা, কল্পনার ক্ষমতা, বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান অর্জনের প্রস্তুতি, শিখন ক্ষমতার বিকাশ ইত্যাদি। বৌদ্ধিক বিকাশের জন্যে বিষয়গত পাঠক্রমে গণিত, ভৌতবিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং সহপাঠক্রমিক কর্মসূচি হিসেবে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, বিতর্ক, আলােচনা ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়।

(২) জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্য ও পাঠক্রমের উপযােগিতা : শিক্ষায় জ্ঞানার্জনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য অর্জিত জ্ঞানকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ করে পাঠক্রমভুক্ত পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

(৩) সামাজিক ও কৃষ্টিমূলক লক্ষ্য ও পাঠক্রমের উপত্রোগিতা : সামাজিক ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, মূল্যবােধ, বিশ্বাস, সামাজিক আদর্শ, প্রথা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সমাজবাঞ্ছিত আচরণ ইত্যাদি সংরক্ষণ ও পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সঞ্চালন করাই শিক্ষার সামাজিক লক্ষ্য। সামাজিক ও কৃষ্টিমূলক লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্য পাঠক্রমে বিভিন্ন বিষয় ও কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

(৪) বৃত্তিমূলক লক্ষ্য ও পাঠক্রমের উপযোগিতা : শিশু যাতে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে আগ্রহ ও প্রবণতা অনুযায়ী কোনাে বৃত্তিগ্রহণ করে নিজের পরিবারের ভরণপােষণে সক্ষম হয়, পাশাপাশি সমাজ ও জাতির অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিতেও সার্থকভাবে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয় তা দেখাই শিক্ষার বৃত্তিমুখী লক্ষ্য। শিক্ষার বৃত্তিমূলক লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য পাঠক্রমে কর্মশিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

(৫) নৈতিক লক্ষ্য ও পাঠক্রমের উপযােগিতা : শিশুর মধ্যে সততা, বাধ্যতা, জীবে দয়া, আত্মসংযম, বয়স্কদের প্রতি সম্মানবােধ, আদর্শ নিষ্ঠা ইত্যাদি গড়ে তােলাই হল শিক্ষার নৈতিক লক্ষ্য। শিক্ষার এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য পাঠক্রমে বিশেষ বিষয় এবং বিভিন্ন কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে ছােটো ছােটো গল্প, উপাখ্যান যার মধ্যে আত্মত্যাগ, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, দয়া, পরােপকার প্রভৃতি প্রতিফলিত হয় এমন সব বিষয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ওপরের আলােচনা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, শিক্ষার বিভিন্ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার হল উপযুক্ত এবং সুচিন্তিত পাঠক্রম প্রণয়ন। এটাই হল শিক্ষার লক্ষ্য বাস্তবায়নে পাঠক্রমের উপযােগিতা।