প্রাচীন যুগ থেকে শিক্ষার উপাদানগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিক্ষার মূল উপাদান হল চারটি। যথা-

  • শিক্ষক,

  • শিক্ষার্থী, ও পাঠক্রম এবং

  • শিক্ষালয় বা বিদ্যালয়।

যুগের ভিত্তিতে শিক্ষাকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা— 

  • প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিক্ষা,

  • প্রাচীন যুগের শিক্ষা,

  • মধ্য যুগের শিক্ষা এবং

  • আধুনিক যুগের শিক্ষা।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিক্ষা বলতে ইতিহাস রচনার আগের যুগের শিক্ষাকে বােঝায়।

প্রাচীন যুগের শিক্ষা বলতে বৈদিক যুগের শিক্ষা, ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা এবং বৌদ্ধ শিক্ষাকে বােঝায়।

মধ্য যুগের শিক্ষা বলতে ইসলামিক যুগের শিক্ষাকে বােঝায়। ভারতবর্ষে ক্রমাগত মুসলমান আক্রমণের ফলে প্রাচীন যুগের অবসান ঘটে। অতঃপর মুসলমান শাসকেরা তাদের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিয়ে গড়ে তােলে ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থা৷

শিক্ষার্থীর ব্যক্তিসত্তা বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে আধুনিক যুগের শিক্ষা পরিকল্পিত হয়। এই শিক্ষার মধ্যে ব্যক্তির চাহিদা ও সামর্থ্য এবং সমাজের প্রত্যাশার সমন্বয় ঘটে। এই শিক্ষা হল জীবনব্যাপী অভিযােজনের একটি প্রক্রিয়া।

উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে শিক্ষাকে প্রধানত চারভাগে ভাগ করা যায়। যথা— 

  • জানার জন্য শিক্ষা (Learning to know),

  • কর্মের জন্য শিক্ষা (Learning to do),

  • একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাসের বা বাঁচার জন্য শিক্ষা (Learning to live together),

  • মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা (Learning to be)।

শিক্ষা হল জ্ঞান অর্জনের প্রয়াস| শিক্ষার্থীরা শিক্ষক, পুস্তক এবং অন্যান্য উৎস থেকে মূল্যবান জ্ঞানসংগ্রহ করে এবং নিজেদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তােলে। মানুষ সারা জীবন ধরেই কিছু না কিছু শেখে। তাই শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল জানার জন্য শিক্ষা।

কিছু করার জন্য শিক্ষা বলতে বােঝানাে হয়েছে। উৎপাদনশীল কোনাে কাজ করার শিক্ষাকে।

একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাসের শিক্ষা বলতে ব্যক্তির সামজিক অভিযােজন বা সংগতিবিধানের শিক্ষাকে বােঝানাে হয়েছে।

মানুষ হয়ে ওঠার জন্য শিক্ষা বলতে শিক্ষার্থীর মধ্যে মানবিক মূল্যবােধ গড়ে তােলার কথাই বােঝানাে হয়। এই শিক্ষা শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভিন্ন মানবিক গুণ, যেমন-দয়া, মায়া, সহানুভূতি, নৈতিকতা, সহযােগিতা ইত্যাদির বিকাশ ঘটায়।

শিক্ষাস্তরের ভিত্তিতে শিক্ষাকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়-

  • প্রাথমিক শিক্ষা,

  • প্রাথমিক শিক্ষা,

  • মাধ্যমিক শিক্ষা এবং

  • উচ্চ শিক্ষা।

প্রাথমিক শিক্ষার পূর্ববর্তী অর্থাৎ শিশুর পাঁচ বা ছয় বছর বয়সের আগে পর্যন্ত তাকে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তাকেই প্রাক্প্রাথমিক শিক্ষা বলে।

প্রাথমিক শিক্ষার পর বিদ্যালয়ে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যমে সাধারণত ছয় থেকে দশ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাকেই বলে প্রাথমিক শিক্ষা।

প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার মধ্যবর্তী স্তরকে মাধ্যমিক স্তর বলা হয়। এই স্তরকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয় মাধ্যমিক (অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত) এবং উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি)।

সাধারণত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষাকে বলে উচ্চশিক্ষা। এই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হল দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত মানুষ তৈরি করা, দায়িত্বশীল ও সক্রিয় নাগরিক তৈরি করা এবং গবেষণার দ্বারা শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আরও সমৃদ্ধ করা।

পাঠক্রমের বিভিন্নতা অনুযায়ী শিক্ষাকে প্রধানত দুইভাগে। ভাগ করা যায়। যথা-

সাধারপধর্মী শিক্ষা হল সেই শিক্ষা যার ফলে, শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিকশক্তির বিকাশ ঘটে। সে যে জগতে বাস করছে তাকে। জানতে ও বুঝতে, সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে এবং ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করা ছাড়াও সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থেকে জীবনকে অর্থবহ করে তােলাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য যে শিক্ষা, তাকে বিশেষ শিক্ষা বলা হয়। যেমন— প্রতিভাসম্পন্ন শিক্ষার্থী, দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী প্রভৃতি শিশুদের জন্য পরিকল্পিত শিক্ষা এই শিক্ষার উদাহরণ।

যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত হওয়া জ্ঞান শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষক, কোনাে অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং বই থেকে অর্জন করে। একেই জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষা বলে।

দীর্ঘকাল কোনাে নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশে বাস করার ফলে মানুষের মধ্যে খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার- আচরণ, আমােদ-উপকরণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে একটি সাদৃশ্য দেখা যায় যা তাদের কৃষ্টি বা সংস্কৃতিরূপে চিহ্নিত হয়। যে শিক্ষা ব্যক্তির এই সংস্কৃতির বিকাশে সাহায্য করে তাকেই কৃষ্টিমূলক শিক্ষা বলে।

যে শিক্ষা শিক্ষার্থীকে বৃত্তিগ্রহণের জন্য প্রয়ােজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে এবং পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করে তাকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা বলে।

শিক্ষার্থীর মধ্যে নৈতিক চেতনা জাগ্রত করা বা আদর্শ চরিত্র গঠনের জন্য তাকে যে বিশেষ ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়, তা নৈতিক শিক্ষা নামে পরিচিত।

আধ্যাত্মিক শিক্ষা হল সেই শিক্ষা যা শিক্ষার্থীর মধ্যে বৃহত্তর জীবনচেতনা গড়ে তােলে। আধ্যাত্ম জগৎকে বুঝতে এবং তাকে অনুভব করতে এই শিক্ষা সাহায্য করে।

যে শিক্ষা শিক্ষার্থীকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে সার্থকভাবে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে, সেই শিক্ষাকে সংগতিবিধানের শিক্ষা বলে|

যে শিক্ষা প্রত্যেক শিক্ষার্থী সম্বন্ধে এককভাবে চিন্তা করে এবং তার চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে তাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা বলে।

যে শিক্ষা সমাজের চাহিদা, প্রত্যাশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা করে তাকে সমাজকেন্দ্রিক শিক্ষা বলে।

শিক্ষার্থীর বয়স অনুযায়ী শিক্ষাকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা যায়। যথা শিশু শিক্ষা (Child education) এবং বয়স্ক শিক্ষা (Adult education) I

স্বাভাবিক নিয়মে শৈশবে যে শিক্ষা শিশুর পরিবার থেকে শুরু হয়ে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলতে থাকে, তাকে শিশু শিক্ষা বলে।

সাধারণভাবে শৈশবকালােক্তর সময়ের শিক্ষাকে বয়স্ক শিক্ষা বলা হয়। তবে এর একটি অন্য অর্থও প্রচলিত আছে। স্বাভাবিক নিয়মে পড়াশােনা করতে করতে শিক্ষার্থী পড়া ছেড়ে দিলে, বেশি বয়সে তাকে যদি আবার শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা হয়, অথবা নিরক্ষর বয়স্ক মানুষকে সাক্ষর করার জন্য যে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, তাকে বয়স্ক শিক্ষা বলে।

নিয়ন্ত্রণের তারতম্য অনুসারে শিক্ষাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এই তিনটি ভাগ হল— অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা (Informal Education), নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা (Formal Education) এবং  প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা (Non-formal education)।

যে শিক্ষায় শিক্ষার বিভিন্ন উপাদান, যেমন—শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পাঠক্রম ও শিক্ষালয়ের ওপর কোনাে নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তাকে অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বলে।

অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার দুটি সংজ্ঞা- যে শিক্ষা সবসময় চলছে, যার ওপর আমাদের কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা। প্রত্যক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া শিশু বা শিক্ষার্থী অন্যান্য মাধ্যম থেকে যে শিক্ষা অর্জন করে তা-ই হল অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা।

পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে সার্থকভাবে মানিয়ে নিতে গিয়ে এবং নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পরিবেশ থেকে কোনাে শিশু যে জ্ঞান, দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা অর্জন করে তাই হল অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা।

কুম্বসের মতে, অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা হল এমনই এক শিক্ষা যা‌ সর্বদা নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে ঘটে।

অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষার্থী প্রকৃতি, পরিবার এবং বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা বা গণমাধ্যম থেকে শিক্ষালাভ করে, তাই এই শিক্ষা শিক্ষকনির্ভর নয়।

জে. পি. নায়েক বলেছেন—“সমাজজীবনে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যা কিছু শেখা যায়, তা-ই হল অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা।”

অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা অসংগঠিত। এক্ষেত্রে শিক্ষার স্তর বলে‌ কিছু নেই।

সাধারণভাবে, পরিবার বলতে বােঝায় এমন একটি সামাজিক একককে যার সদস্যদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক বর্তমান।

ম্যাকাইভারের মতে, পরিবার হল একটি গােষ্ঠী যা যৌন সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত এবং যেখানে শিশু জন্মলাভ করে ও প্রতিপালিত হয়।

পরিবার হল সমাজ দ্বারা স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান যা স্ত্রী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত হয় এবং যার সদস্যরা বাবা-মা, ভাই-বােন, পুত্র-কন্যা প্রভৃতি সম্পর্কের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে একই বাসস্থানে বসবাস করে।

পরিবার হল সংস্কৃতির পীঠস্থান। প্রত্যেক পরিবারের নিজস্ব সংস্কৃতি বা কৃষ্টি থাকে। শিশুর মধ্যে ওই সংস্কৃতি বা কৃষ্টি সঞ্চালিত হয়। শিশু তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবারের সংস্কৃতি আয়ত্ত করে। তাই বলা যায় যে, শিশুর সাংস্কৃতিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুর অভ্যাস গঠনের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নির্দিষ্ট স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করা, সময়মতাে ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজা, খাদ্যগ্রহণের আগে এবং পরে ভালােভাবে হাতমুখ ধােয়া ইত্যাদি অভ্যাসগুলি শিশু পরিবার থেকেই শেখে। শৈশবকালীন নমনীয়তার জন্যই সহজে অভ্যাস গড়ে ওঠে।

শিশুর প্রাক্ষোভিক বিকাশে তার পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর প্রাক্ষোভিক বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়টি তার পরিবারেই সম্পন্ন হয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলেই যেমন শিশুর প্রক্ষোভ দেখা দেয়, তেমনি সেই প্রক্ষোভের বিকাশ ঘটে পরিবারের মধ্যেই।

শিশুর মানসিক বিকাশে তার পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক বিকাশ বলতে বুদ্ধি, চিন্তন, কল্পনা, স্মৃতি, যুক্তি ইত্যাদির বিকাশকে বােঝায়। বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মানসিক গুণাবলির বিকাশের জন্য যে উৎসাহ এবং উদ্দীপনার প্রয়ােজন তা শিশু পরিবারের মধ্যেই পায়।

শিশুর আধ্যাত্মিক বিকাশে তার পরিবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশু কোনাে আধ্যাত্মিক চেতনা নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। পরিবারের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নিতে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে শিশুর মধ্যে ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটে।

পরিবার শিশুর বিশ্লেষণাত্মক শক্তির বিকাশে সহায়তা করে। শিশুরা পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের কাছ থেকে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, ভালােমন্দ, আচার-অনাচার প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে।

পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শিশুর নৈতিক বিকাশে সাহায্য করা। নৈতিক আচরণ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, করণীয়-অকরণীয় ইত্যাদি সম্পর্কে শিশুকে শিক্ষা দেওয়া তার নৈতিক বিকাশের জন্য খুবই প্রয়ােজন। পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের এই ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

শিশুর জ্ঞান ও ধারণার বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ রচনা করায় পরিবারের বিশেষ ভূমিকা আছে। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের বিস্তারের জন্য একদিকে যেমন শিশুর সামর্থ্য অনুযায়ী নানারকম জ্ঞান সরবরাহ করতে হবে তেমনি বিভিন্ন বাস্তব পরিস্থিতি শিশুর সামনে তুলে ধরতে হবে।

পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শিশুর মধ্যে পারিবারিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ঘটানাে। প্রাথমিকভাবে পরিবারের মধ্য দিয়েই শিশু সামাজিক এবং বংশগত ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে সে এই ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে। এইভাবে পরিবার বংশপরম্পরায় বিভিন্ন ঐতিহ্যকে সঞ্চালিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে।

পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শিশুকে আর্থিক দিক থেকে সফলতা অর্জনে সহায়তা করা। শিশুর বড়াে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার তাকে বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

পরিবার শিশুর সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জন্মের পর নিরাপত্তা দান, খাদ্য সরবরাহ, উপযুক্ত বাসস্থান সরবরাহ, পঠনপাঠনে সাহায্য, আচারব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, সু-অভ্যাস গঠন, বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও ধারণা গঠন, নৈতিক জীবনের বিকাশ, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ, অর্থনৈতিক বিকাশ—এককথায় শিশুর সামগ্রিক উন্নয়নে পরিবার শিশুকে সাহায্য করে।

পরিবারের একটি শিক্ষামূলক ভূমিকা হল পরিবার শিশুকে বিভিন্ন ধরনের সু-অভ্যাস গড়ে তুলতে শেখায়।

পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে এবং আচার- আচরণের মাধ্যমে শিশুর মধ্যে মূল্যবােধ গড়ে ওঠে।

জনগণের সঙ্গে যােগাযােগের বিভিন্ন মাধ্যমকে গণমাধ্যম বলা হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমগুলি হল দূরদর্শন, বেতার, সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র ইত্যাদি।

বেতার গণশিক্ষার একটি শ্রুতিধর্মী মাধ্যম।

প্রায় 9৪ শতাংশ ছেলেমেয়ে দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখার জন্য খেলাধুলাের প্রতি অনাসক্ত হয়েছে।

সংবাদপত্রের মূল কাজ হল সংবাদ পরিবেশন করা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যে যে শিক্ষা সংঘটিত হয়, তাকে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বলে। শিক্ষার উপাদানগুলি এখানে নিয়ন্ত্রিত। এই শিক্ষার নির্দিষ্ট লক্ষ্য, বয়স, পাঠক্রম ও সময়সূচি থাকে এবং এটি নির্দিষ্ট কয়েকটি নিয়ম ও পদ্ধতির দ্বারা পরিচালিত হয়।

শিক্ষার মূল উপাদান হল চারটি। এগুলি হল যথাক্রমে-

  • শিক্ষার্থী,

  • শিক্ষক,

  • পাঠক্রম ও

  • শিক্ষালয়। 

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় এই উপাদান চারটি সুনিয়ন্ত্রিত। এই শিক্ষা শুরুর বয়স এবং বিভিন্ন শিক্ষাস্তরের বয়স পূর্বনির্দিষ্ট। যারা শিক্ষক হবেন, তাঁদের যােগ্যতা ও কর্তব্য পূর্বনির্দিষ্ট। কোন্ শিক্ষান্তরে কী পাঠ্য বিষয়, পাঠ্যসূচি এবং অভিজ্ঞতা থাকবে তা-ও পূর্বপরিকল্পিত। শিক্ষার স্থান, কক্ষ ইত্যাদি পূর্বনির্দিষ্ট।

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার সুবিধা হল- রাষ্ট্র তার প্রয়ােজনমতাে নাগরিক তৈরি করতে পারে৷ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিক্ষা শেষ হয়।

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা হল- শিক্ষার্থীর চাহিদাপূরণ সম্ভব হয় না। ‘সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা সন্তব নয়।

প্রথাগত শিক্ষার একটি সুবিধা হল—এতে একটি নির্দিষ্ট পাঠক্রম অনুসৃত হয় এবং একটি অসুবিধা হল—এই শিক্ষা পরীক্ষা নির্ভর।

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হল বিদ্যালয়। বাস্তবে স্কুল বা বিদ্যালয় হল এমনই এক প্রতিষ্ঠান যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীবৃন্দ এক নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হন এবং নির্দিষ্ট রীতিনীতি মেনে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কোনাে পাঠক্রম অনুশীলনে সহায়তা করেন।

School and Society গ্রন্থটির লেখক হলেন—জন ডিউই।

শিক্ষার মূলত পাঁচটি উপাদানের উল্লেখ করা যায়। এগুলি হল- -শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পাঠক্রম, সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি এবং পরিবেশ ভৌত ও সামাজিক।

যে শিক্ষা বিদ্যালয়ের বা অন্য কোনাে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ না হয়েও কোনাে নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আংশিক নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাকে বলে প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা।

কয়েকটি প্রথাবহির্ভূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল—সান্ধ্য বিদ্যালয়, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, নারীকল্যাণ সমিতি এবং শ্রমিক বিদ্যাপীঠ।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জে. পি. নায়েক প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার সংজ্ঞায় বলেছেন যে, নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বাইরে সংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রথাবহির্ভূত বা বিধিমুক্ত শিক্ষা বলে।

কুম্বস্ এবং আমেদের প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে—এই শিক্ষাব্যবস্থা

  • প্রথাগত বিদ্যালয়ের বাইরে সংগঠিত এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া,

  • নির্দিষ্ট শিখন পরিস্থিতিতে সম্পন্ন হয় এবং

  • নির্দিষ্ট জনগণের (শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক) জন্য স্থির করা হয়।

কেস এবং নিকফ-এর মতে, প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে বয়স্ক এবং বিদ্যালয়ছুট যুবকযুবতীদের মধ্যে ধারণা বা প্রত্যয় সালন করে এবং দক্ষতার বিকাশ ঘটায়; যা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে, ব্যাবসাবাগিজ্যে, ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করতে, পৌর, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়। অধিকতর বুদ্ধিদীপ্তভাবে অংশগ্রহণ করতে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে।

কিগ্যান উল্লিখিত দূরাগত শিক্ষার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম দুটি বৈশিষ্ট্য হল- 

  • এই জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যা ব্যক্তিগত শিখন থেকে দূরশিখনকে পৃথক করে

  • এই জাতীয় শিক্ষায় সর্বদা দ্বিমুখী সংযােগসাধনের ব্যবস্থা থাকে।

যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গিয়ে শিক্ষকের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ ছাড়াই ডাকযােগে বা অন্য কোনাে মাধ্যমের সহায়তায় শিক্ষালাভ করে, তাকে দূরাগত শিক্ষা বলে।

ডেভিড বাটস্ দূরাগত শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—দূরাগত শিক্ষা হল সেই ধরনের শিক্ষা যেখানে শিক্ষার্থীদের নিজস্বতা বজায় রাখার সুযােগ থাকে এবং শিক্ষা-পদ্ধতির নমনীয়তার ফলে তারা তাদের ইচ্ছা ও সময়-সুযােগ অনুযায়ী পঠনপাঠনের মাধ্যমে নিজেদের শিক্ষিত করে।

দূরাগত শিক্ষার দুটি গুণ হল – 

  • শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও সময় অনুযায়ী শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থী বহু দূরে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা সত্ত্বেও শিক্ষালাভ করতে পারে। 

  • দূরাগত শিক্ষা শিক্ষার্থীর নিজের ইচ্ছার দ্বারা ঘটে থাকে এবং এটি একটি গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা।

স্ব-শিখনের উপযােগী করে দূরশিক্ষার পাঠোপকরণ প্রস্তুত হয়, সাধারণ পাঠ্যপুস্তকে তা বিবেচনা করা হয় না। সাধারণ পাঠ্যপুস্তকের মতাে দূরশিক্ষার পাঠোপকরণের লক্ষ্য পাণ্ডিত্য নয়। দূরশিক্ষায় দূরশিক্ষক পাঠোপকরণের মধ্যেই অবস্থান করে, সেখানে সাধারণ পাঠ্যপুস্তকের জন্য থাকেন শ্রেণিশিক্ষক।

পড়া শুরু করার পর আর্থিক বা অন্যান্য কারণে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেওয়া ছাত্রছাত্রীকে বিদ্যালয়ছুট শিক্ষার্থী বলে।

সমাজ দ্বারা নির্ধারিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনভাবে এবং উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট পাঠক্রম অনুসারে শিক্ষার্থীদের যে বিশেষ শিক্ষাদান করা হয়, তাই হল প্রথাবদ্ধ বা বিধিবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা।

শিক্ষাবিদ পি. ডি. শুক্লা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার সংজ্ঞায় বলেছেন যে, নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা হল এমন এক গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতি যাতে পূর্বনির্ধারিত নির্দিষ্ট পাঠক্রম অনুসরণের দ্বারা ছাত্র ও শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পরস্পরের মুখােমুখি হয়৷