‘শিক্ষা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘শাস্’ ধাতু থেকে। শাস্ ধাতুর অর্থ শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দেশ দেওয়া, শৃঙ্খলিত করা ইত্যাদি। এই অর্থে শিক্ষা একটি কৌশলমাত্র। তাই বলা যায় ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ, শাসন বা শৃঙ্খলিত করার নামই হল শিক্ষা।

বাংলা ভাষায় ‘শিক্ষা শব্দের সমার্থক হিসেবে ‘বিদ্যা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বিদ্যা’ শব্দটি সংস্কৃত ‘বিদ্’ ধাতু থেকে এসেছে। ‘বিদ্’ ধাতুর অর্থ হল জ্ঞান।

শিক্ষাশ্রয়ী ভাববাদীদের মতে, আত্মােপলদ্ধিই হল শিক্ষা। ভক্তি ও কর্মের দ্বারা এই আত্মােপলদ্ধি সম্ভব হয়।

শিক্ষাশ্রয়ী বস্তুবাদীদের মতে, শিক্ষা হল বস্তুনিষ্ঠ তথ্য যা‌ শিক্ষার্থী বা ব্যক্তি অর্জন করে।

শিক্ষাশ্রয়ী প্রকৃতিবাদীদের মতে, শিশুকে তার নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সাহায্য করাই হল শিক্ষা।

শিক্ষাশ্রয়ী প্রয়ােগবাদীদের মতে, মানুষের অভিজ্ঞতার অবিরাম পুনর্গঠনের মাধ্যমে সামাজিক পটভূমিকায় ব্যক্তিনৈপুণ্য বৃদ্ধিই হল শিক্ষা।

মহাত্মা গান্ধির মতে, শিক্ষা হল তাই যা মানুষের দেহ, মন এবং আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায়।

রবীন্দ্রনাথের মতে, শিক্ষা হল বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানের দ্বারা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তােলা।

ঋষি অরবিন্দের মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হল মানুষকে দিব্য জীবনের জন্য প্রস্তুত করা।

রাধাকৃষ্ণ কমিশনের মতে, শিক্ষা তাই যা মানুষকে সত্যানুসন্ধানে এবং ধর্মাচরণে দীক্ষিত করে।

হুমায়ুন কবীরের মতে, শিক্ষা একটি গতিশীল প্রক্রিয়া যা সামগ্রিকভাবে মানুষকে পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানে সাহায্য করে।

ড. জাকির হােসেনের মতে, শিক্ষা হল এমন প্রক্রিয়া যা কোনাে ব্যক্তির মনের সম্পূর্ণ বিকাশে সহায়ক হয়।

দার্শনিক প্লেটোর মতে, শিক্ষা হল এমন একটি ধারণাশক্তি যা শিশুর মধ্যেকার সব পূর্ণতাকে বিকশিত করে।

অ্যারিস্টটলের মতে, শিক্ষা হল সুস্থ দেহে এক সুস্থ মনের সৃষ্টি।

কমেনিয়াসের মতে, শিক্ষা হল এমন কিছু যা সাধারণ মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করে।

দার্শনিক মন্টেগুর মতে, শিক্ষা হল মানুষের বিভিন্নপ্রকার মানসিক শক্তির বিকাশসাধন ও উপযুক্ত অনুশীলন।

রুশাের মতে, শিক্ষা হল শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ, যা মানবসমাজের সমস্ত কৃত্রিমতাবর্জিত স্বাভাবিক মানুষ তৈরিতে সহায়ক।

পেস্তালৎসির মতে, শিক্ষা হল মানুষের সহজাত ক্ষমতা পুলির স্বাভাবিক, সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ক্রমােন্নয়নমূলক বিকাশ।

ফ্রয়েবেলের মতে, শিক্ষা হল শিক্ষার্থীর সেই বিকাশপ্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে বিশ্বসত্তার অংশরূপে উপলব্ধি করে।

জন ডিউইর মতে, পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের সন্তাবনাগুলিকে বাস্তবায়িত করার যে শক্তি বা সামর্থ্য ব্যক্তির মধ্যে থাকে তার বিকাশ ঘটানােই হল শিক্ষা।

রেমন্টের মতে, শিক্ষা হল মানুষের শৈশব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত জীবনবিকাশের এক প্রক্রিয়া। এর সাহায্যে সে নানাভাবে তার প্রাকৃতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক পরিবেশের সঙ্গে ক্রমশ মানিয়ে নেয়।

অধ্যাপক নানের মতে, শিক্ষা হল ব্যক্তির নিজস্বতার পূর্ণ বিকাশ, যার সাহায্যে সে তার সর্বোচ্চ ক্ষমতানুযায়ী মানবজীবনে মৌলিক অবদান রাখতে পারে।

থম্পসনের মতে, শিক্ষা হল পরিবেশের এমন এক প্রভাব যা কোনাে ব্যক্তিকে তার অভ্যাস, আচরণ, চিন্তা এবং মনােভাবের স্থায়ী পরিবর্তনে সহায়তা করে।

স্যার জন অ্যাডামসের মতে, শিক্ষা হল একটি সচেতন ও ঐচ্ছিক প্রক্রিয়া যার দ্বারা একজন ব্যক্তি যােগাযােগ এবং জ্ঞান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির বিকাশে সংশোধন ঘটায়।

স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষার যে সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, তা হল- “Education is the manifestation of perfection already in man অর্থাৎ শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশসাধন।

সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার দুটি বৈশিষ্ট্য হল— এটি শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানের সঞ্চালন ঘটায় এবং স্মৃতি, কল্পনা, বিচারক্ষমতা প্রভৃতি কয়েকটি মৌলিক শক্তির বিকাশে সাহায্য করে।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার দুটি বৈশিষ্ট্য হল— শিক্ষা হল সহজাত সন্তাবনাগুলির পূর্ণ বিকাশ; শিক্ষা হল অভিযােজন।

শিক্ষা হল অভিযােজন; শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।

শিক্ষা কেবলমাত্র বৃত্তি গ্রহণে যােগ্যতা অর্জন করা নয় ; শিক্ষা নিছক জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াও নয়।

বর্তমান অর্থে শিক্ষা হল, ব্যক্তিজীবনের সেইসব গুণের বিকাশ যা ব্যক্তিকে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের সন্তাবনাগুলির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।

স্পার্টায় শিশুদের ছােটোবেলা থেকে মল্লযুদ্ধ, বর্শা ছােড়া, তিরন্দাজি, অশ্বচালনা প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদান করা হত।

কোনাে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পাঠক্রম অনুযায়ী শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা পাঠক্রমের বিষয়গুলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্মেলন করে তার জ্ঞানের বিকাশকেই সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বলা হয়।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষা বলতে বােঝায় ব্যক্তির জ্ঞানমূলক, অনুভূতিমূলক এবং মনশ্চালকমূলক বিকাশ যা শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। নিয়ন্ত্রিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং প্রথাবহির্ভূত সব মাধ্যমের দ্বারাই এই শিক্ষা সম্পন্ন হয়।

শিক্ষার একমেরুতে আছেন শিক্ষক, অন্য মেরুতে শিক্ষার্থী। উভয়ের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ফলেই শিখন সম্পন্ন হয়। তাই শিক্ষাকে দ্বিমেরুমূলক প্রক্রিয়া বলা হয়।

সামাজিক কর্মক্ষমতার দুটি বৈশিষ্ট্য হল— ব্যক্তি তার পরিবারকে সুখস্বাচ্ছন্দ্যে রাখবে; ব্যক্তি সামাজিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজের উন্নতি বিধানে সহায়তা করবে।

জাতীয় বিকাশ হল এমন এক গতিশীল প্রক্রিয়া যার ফলে জাতীয় আয় এবং জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটে এবং জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়।

আত্মপ্রকাশ বলতে বােঝায় ব্যক্তির নিজস্ব মতামত, চিন্তাধারা বা ধ্যানধারণার প্রকাশ। নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়ােগ করে সক্রিয়ভাবে কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ সম্ভব হয়।

সামাজিক রীতিনীতি, আদবকায়দা, প্রথা, সংস্কার ইত্যাদিকে বংশপরম্পরায় চালিয়ে যাওয়াকে সমাজ সংরক্ষণ বলা হয়।

সংগতিবিধান বলতে বােঝায় পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। সংগতিবিধানের ওপরেই মানুষের অস্তিত্ব নির্ভর করে।

জীবন হল পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে অভিযােজনের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া এবং জীবিকা হল জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় খাদ্য, বাসস্থান প্রভৃতি চাহিদা মেটানাের জন্য বৃত্তিমূলক কাজ। শিক্ষাবিদ হারবার্ট স্পেনসারের মতে, এই দুই-এর সমন্বয়সাধনের জন্য সব ধরনের শিক্ষাগত সহায়তাই হল পরিপূর্ণ জীবন-জীবিকা তত্ত্বের মূলকথা।

জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি হল শিক্ষা। প্রথাগত ও প্রথাবহির্ভূত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে মানবসম্পদ সৃষ্ট হয় তাদের ওপরই জাতীয় উন্নয়ন প্রধানত নির্ভর করে।

জাতীয় উন্নয়নের প্রসঙ্গে কোঠারি কমিশন বলেছে যদি – জাতীয় উন্নয়নের পদক্ষেপকে ত্বরান্বিত করতে হয়, তাহলে এক সুসংজ্ঞায়িত, সাহসী ও কল্পনাপ্রসূত শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

পারস্পরিক ভাবের আদানপ্রদান, সচেতনতা এবং কার্যকলাপের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে অবস্থানগত নৈকট্যের কারণে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাকে এককথায় বলে সমাজ।

শিক্ষার দ্বিমেরু প্রক্রিয়ার দুটি মেরু হল— শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক।

এমিল” শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল শিক্ষা-সংক্রান্ত নীতি।

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রবক্তা হলেন ব্লুশাে।

‘সামাজিক চুক্তি নীতির প্রবক্তা হলেন হেগেল।

‘সংগতিবিধান’ কথাটির অর্থ হল অভিযােজন।

শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশ বলতে শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশকে বােঝায়।

আধুনিক শিক্ষার জনক হলেন রুশাে।

এটি ব্রাম্মণ্য তপােবন শিক্ষার মূলমন্ত্র ছিল।

শিক্ষা একটি পরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিত সামাজিক কর্মসূচি। প্রত্যেকটি পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত কর্মসূচির লক্ষ্য থাকা প্রয়ােজন, তাই শিক্ষারও নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন| লক্ষ্য কর্মসম্পাদনের প্রেরণা সৃষ্টি করে এবং কর্মপ্রচেষ্টাকে নির্দিষ্ট পথে চালিত করে।

শিক্ষা একটি সচেতন গতিশীল সামাজিক প্রক্রিয়া। শিক্ষার ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ হল— সমাজ ও জাতির চাহিদার পরিবর্তন ও ব্যক্তির চাহিদার পরিবর্তন।

আদিম যুগের প্রথম দিকে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল খাদ্যসংগ্রহ, পরিধেয় বস্ত্র সংগ্রহ, আত্মরক্ষা ইত্যাদি কৌশলগুলিকে আয়ত্ত করা। পরবর্তীকালে পরিবেশের উপাদান ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও শিক্ষার চাহিদাপূরণের কৌশল আয়ত্ত করা শিক্ষার লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

প্রাচীন যুগে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল পরম জ্ঞানলাভ বা মােক্ষলাভ। এ ছাড়া পুরাতন (ক্ল্যাসিকাল) সংস্কৃতিকে ধরে রাখাও ছিল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।

আধুনিক যুগে শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজের কল্যাগসাধন করা এবং ব্যক্তিকে একজন সক্রিয়, সংবেদনশীল ও উৎপাদনক্ষম নাগরিক হিসেবে গড়ে‌ তােলা।

‘মােক্ষ’ কথাটির অর্থ হল মুক্তি। উপনিষদে শিক্ষার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে— শিক্ষা হল এমন কিছু যার অন্তিম পরিণতি হল মােক্ষ বা মুক্তিলাভ। আত্মােপলব্ধির মাধ্যমে এই মুক্তি লাভ হয়।

সনাতনী শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল—আত্মােপলদ্ধির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক বিকাশ সাধন করা।

শিক্ষার প্রধান লক্ষ্যগুলি হল- জ্ঞান অর্জন; ব্যক্তির বৃদ্ধি ও বিকাশ (শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি); সংগতিবিধান ও সক্রিয়তা; সামাজিক কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, সঞ্চালন এবং অগ্রগতি; ব্যক্তিকে বৃত্তির উপযুক্ত করে তােলা ইত্যাদি।

মনােবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তিগত পার্থক্যকে স্বীকার করে নিয়ে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে তার সন্তাবনাগুলির পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করা।

প্রয়ােগবাদীদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হল শিশুকে পরিবেশের সঙ্গে অভিযােজনে সমর্থ করে তােলা এবং অভিজ্ঞতার আলােকে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম করে তােলা।

ভাববাদীদের মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তিকে ব্রয়জ্ঞানলাভে এবং আত্মােপলন্ধিতে সাহায্য করা।

প্রকৃতিবাদীদের মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হল উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে ব্যক্তির অনুভূতিগুলির পূর্ণ বিকাশে সাহায্য করা।

শিক্ষার বৃত্তিমূলক লক্ষ্যটি হল ব্যক্তিকে ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের উপযােগী করে গড়ে তােলা এবং তাকে জীবিকা অর্জনে সহায়তা করা।

শিক্ষার আধ্যাত্মিক লক্ষ্য হল ব্যক্তিকে ব্রম্মজ্ঞানলাভে সাহায্য করা ও তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগিয়ে তােলা।

মধ্যযুগে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে মানুষকে শিক্ষিত করে তােলা এবং ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার-আচরণ কঠোরভাবে পালনের মাধ্যমে মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠন করা।

গ্রিক সভ্যতায় শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিগত প্রয়ােজনের পরিবর্তে সামাজিক প্রয়ােজন মেটানো। বলা হতব্যক্তি নিজের জন্য জন্মগ্রহণ করে না, সমাজের জন্যই তার জন্ম। শিক্ষার্থীর শিক্ষা, শরীর, নৈতিকতা সবই ছিল সমাজের জন্য নিবেদিত।

চৈনিক সভ্যতায় শিক্ষার লক্ষ্য ছিল পুরােনাে প্রবাদগুলি শিক্ষার্থীকে মুখস্থ করিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া শিক্ষার্থীকে জোর করে দেশাচার সম্পর্কিত তথ্য মুখস্থ করানাে হত।

শিক্ষার বিভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা। তারা প্রত্যেকে যেভাবে জগৎ এবং এর কর্মকাণ্ডকে ব্যাখ্যা করেছেন তার প্রেক্ষিতেই শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন।

শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য বলতে বােঝায় ব্যক্তির অন্তর্নিহিত প্রতিভার যথাযথ বিকাশসাধন। এখানে ব্যক্তির সর্বপ্রকারের কল্যাণই প্রাধান্য পায়।

শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের পক্ষে দুটি প্রধান যুক্তি হল- গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ব্যক্তির সুপ্ত সম্ভাবনা-গুলির পূর্ণ বিকাশ৷ ব্যক্তির উন্নতি দ্বারা সমাজ ও জাতির উন্নতি।

শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশ বলতে শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশকে বােঝায়।

শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তিগত বিকাশ’—এই মতের কয়েকজন সমর্থক হলেন নান, লক্, কান্ট, ইরাসমাস, রুশাে, বার্ট্রান্ড রাসেল প্রমুখ চিন্তাবিদ।

শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য বলতে বােঝায় সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ, সঞ্চালন এবং সমাজপ্রগতিকে সার্থক করে তােলা। শিক্ষার এই লক্ষ্যে সমাজের সর্বপ্রকারের কল্যাণের কথাই বলা হয়।

শিক্ষার লক্ষ্য হল সামাজিক বিকাশ’—এই মতের কয়েকজন উল্লেখযােগ্য সমর্থকের নাম হল হারবার্ট স্পেনসার, ডিউই, হেগেল, হবস, রেমন্ট, অধ্যাপক ব্যাগলি প্রমুখ চিন্তাবিদ।

ব্যাগলির মতে সামাজিক সামর্থ্য সৃষ্টি করা শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। প্রত্যেক ব্যক্তির কার্যক্ষমতার যথাসম্ভব বিকাশ ঘটিয়ে তাকে সামাজিক সামর্থযুক্ত করে গড়ে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

হারবার্ট স্পেনসার সমাজকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, দেহ ছাড়া কোশের যেমন মূল্য থাকে না, তেমনি সমাজ ছাড়া ব্যক্তিরও কোনাে মূল্য নেই। অর্থাৎ শিশুকে যদি সমাজের মধ্যে রেখে শিক্ষা দেওয়া না যায়, তা হলে তার সামাজিক বিকাশ ঘটবে না।

পারস্পরিক ভাবের আদানপ্রদান, সচেতনতা এবং কার্যকলাপের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে অবস্থানগত নৈকট্যের কারণে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাকে এককথায় বলে সমাজ।

শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের সপক্ষে একটি যুক্তি হল—শিক্ষা এমন একটি সংগঠিত সমাজ সৃষ্টিতে সহায়তা করে যা খাদ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তা, বিচার, বৃত্তি এবং জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় অন্যান্য সুযােগসুবিধা প্রদান করে।

সামাজিক বিকাশে সহায়ক শিক্ষার একটি লক্ষ্য হল—সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করা ও তার সমাধান করা।

জাতীয় উন্নয়ন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে জাতির অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, বাণিজ্য, যোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সামগ্রিক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে।

জাতীয় উন্নয়নের উপাদান বলতে কৃষি, শিল্প, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানবসম্পদকে বােঝায়।

দেশের উন্নয়নের জন্য- শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ, শিক্ষায় বিশেষীকরণ, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ, জনশক্তি অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন।

জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি হল শিক্ষা। প্রথাগত ও প্রথাবহির্ভূত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে মানবসম্পদ সৃষ্ট হয় তাদের ওপরই জাতীয় উন্নয়ন প্রধানত নির্ভর করে।

জাতীয় উন্নয়নের প্রসঙ্গে কোঠারি কমিশন বলেছে—যদি জাতীয় উন্নয়নের পদক্ষেপকে ত্বরান্বিত করতে হয়, তাহলে এক সুসংজ্ঞায়িত, সাহসী ও কল্পনাপ্রসূত শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

জাতীয় উন্নয়নের জন্য শিক্ষার একটি লক্ষ্য হল—জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করা ও সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক মূল্যবােধ জাগ্রত করা।

জাতীয় বিকাশে সহায়ক শিক্ষার একটি লক্ষ্য হল সামাজিক ঐক্য স্থাপন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ।