শিক্ষামনােবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলােচনার ক্ষেত্রে নীচের বিষয়গুলি উল্লেখ করা যায়一

(১) একটি প্রয়ােগমূলক বিজ্ঞান: মনােবিজ্ঞানের তত্ত্ব, নীতি, সূত্র ইত্যাদি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়ােগ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যকরী ও উন্নত করাই হল শিক্ষামনােবিজ্ঞানের কাজ, তাই শিক্ষামনােবিজ্ঞান একটি প্রয়ােগমূলক বিজ্ঞান।

(২) একটি স্বতন্ত্র বিষয়: আগে শিক্ষামনােবিজ্ঞান মনােবিজ্ঞানের একটি শাখা বলে বিবেচিত হত। বর্তমানে এটি একটি পৃথক বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে আসলে, কোনাে জ্ঞান-সমষ্টি অন্ততপক্ষে তিনটি শর্ত সাপেক্ষে নিজেকে পৃথক বিষয় হিসেবে দাবি করতে পারে

  • বিষয়টির পরিধি হবে যথেষ্ট বিস্তৃত।

  • বিষয়টির নিজস্ব সমস্যা থাকবে।

  • বিষয়টির নিজস্ব পদ্ধতি থাকবে যার সাহায্যে তার সমস্যা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা বা গবেষণা করে, সমাধানের পথ নির্দিষ্ট করে বিষয়টিকে আরও উন্নত করা সম্ভব হবে। শিক্ষামনােবিজ্ঞান এই তিনটি শর্তই পূরণ করতে সক্ষম

(৩) একটি গতিশীল বিষয়: শিক্ষামনােবিজ্ঞানের আলােচনার বিষয়গুলি স্থির নয়, গতিশীল। শিক্ষামনােবিজ্ঞানের ওপর প্রতিনিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা ও গবেষণার ফলে একদিকে যেমন নতুন তথ্য, তত্ত্ব, নীতি, সূত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং তার প্রয়ােগ ঘটছে; অন্যদিকে তেমনই পুরােনাে তত্ত্ব, নীতিসূত্র ও চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটছে যার ফলে শিক্ষামনােবিজ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে।

(৪) ব্যক্তি ও সমাজের পক্ষে কল্যাণকর: শিক্ষামনােবিজ্ঞান ব্যক্তির সম্ভাবনাগুলির বিকাশের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ব্যক্তির কল্যাপসাধন করে। ফলে পরোক্ষভাবে সমাজেরও মঙ্গল সাধিত হয়। শিক্ষামনােবিজ্ঞান ব্যক্তির আচরণ সংশােধন করে ব্যক্তির মঙ্গলসাধন করে।

(৫) ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের ওপর গুরুত্ব আরোপকারী: শিক্ষামনােবিজ্ঞান ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ব্যক্তিগত পার্থক্যের নীতিকে স্বীকার করে শিক্ষা মনােবিজ্ঞান তার বিষয়গুলিকে বিশ্লেষণ করে।

ওপরের আলােচনা থেকে বলা যায়, প্রকৃতিগতভাবে শিক্ষামনােবিজ্ঞান হল একটি প্রয়ােগমূলক স্বতন্ত্র বিজ্ঞান। নিজস্ব পদ্ধতি প্রয়ােগ করে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বিষয়টিকে আরও সমৃদ্ধ ও উন্নত করা সম্ভব।

শিক্ষামনােবিজ্ঞানের পরিধি বলতে মনােবিজ্ঞানের এই শাখার আলােচ্য বিষয়গুলিকে বােঝায়। শিক্ষামনােবিদরা বিভিন্ন দিক থেকে এই পরিধিকে ব্যাখ্যা করেছেন—

(১) সহজাত মানসিক সামর্থ্য: ব্যক্তি সহজাতভাবে কিছু মানসিক সামর্থ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে। যেমন-বুদ্ধি, প্রক্ষোভ, স্মৃতি, কল্পনা, চিন্তন ইত্যাদি। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই সামর্থ্যগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষামনােবিজ্ঞানে এই সহজাত সামর্থ্যগুলি সম্পর্কে বিশদ আলােচনা থাকে।

(২) জীবনবিকাশের ধারা: শিক্ষামনােবিজ্ঞান শিশুর দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক বিকাশের ধারাগুলি আলােচনা করে এবং শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য যে পরিবেশের প্রয়ােজন তার রূপরেখাও শিক্ষামনােবিজ্ঞানে আলােচিত হয়।

(৩) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য: ব্যক্তিগত পার্থক্য একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ব্যক্তিগত পার্থক্যের কারণ কী, কীভাবে এই পার্থক্যকে ভিত্তি করে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি, যেমন পাঠক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন প্রভৃতির বিচারবিবেচনা করা যায় তার আলােচনা শিক্ষামনােবিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত।

(৪) শিখনতত্ত্ব: গতানুগতিক শিখনের পদ্ধতি হিসেবে উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে আধুনিক অপেক্ষাকৃত জটিল আচরণমূলক ও জ্ঞানমূলক তত্ত্ব শ্রেণিশিখনে অধিকতর কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে।

(৫) শিখনের ভিত্তি: শিখনের ভিত্তিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—জ্ঞানমূলক এবং অনুভূতিমূলক। বুদ্ধি, স্মৃতি এবং মনােযােগ জ্ঞানমূলক ভিত্তির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে প্রেরণা, মনােভাব এবং আগ্রহ অনুভূতিমূলক ভিত্তির অন্তর্ভুক্ত।

(৬) শিক্ষাপ্রযুক্তি: শিক্ষাপ্রযুক্তি কাকে বলে, কী ধরনের প্রযুক্তি শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যকরী, কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়ােগ করা যায়—এসবই বর্তমানে শিক্ষামনােবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয়।

(৭) শ্রেণি ব্যবস্থাপনা: সম্প্রতি শ্রেণি ব্যবস্থাপনা শিক্ষামনােবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শিক্ষা-শিখন প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকরী করে তুলতে শ্রেণিকক্ষে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে শ্রেণি ব্যবস্থাপনার কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(৮) পরীক্ষা ও মূল্যায়ন: শিক্ষাপ্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হল পরীক্ষা ও মূল্যায়ন। শিক্ষাকার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থী কতটুকু শিখল, প্রত্যাশিত মানে পৌঁছােতে সক্ষম হল কি না, না হলে কোথায় তার অসুবিধা, সেই অসুবিধা দূর করতে কী ধরনের সংশােধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় প্রভৃতি শিক্ষামনােবিদ্যার আলােচ্য বিষয়।

(৯) প্রতিভাসম্পন্ন ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী: প্রতিভাসম্পন্ন এবং পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের কীভাবে নির্দিষ্ট করা যায়, কী তাদের মনস্তত্ত্ব, প্রভৃতি বিষয়ে চিন্তাভাবনা গণতান্ত্রিক এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পক্ষে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি শিক্ষামনােবিজ্ঞানে বিশদভাবে আলােচিত হয়।

(১০) পরিসংখ্যান: রাশিবিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তাই একজন শিক্ষকের পক্ষেপরিসংখ্যানের প্রয়ােজনীয় জ্ঞান অপরিহার্য।

(১১) মানসিক স্বাস্থ্য: মানসিক সুস্বাস্থ্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের পক্ষে প্রয়ােজন। অন্যথায় শিখন বা শিক্ষা কোনােটিই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না।

(১২) অভিযোজন প্রক্রিয়া: সার্থক অভিযােজনই হল শিক্ষার লক্ষ্য। অভিযােজনের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তােলা এবং প্রতিকূল পরিবেশকে প্রতিরােধ করাও শিক্ষামনােবিদ্যার আলােচ্য বিষয়।

(১৩) শিক্ষা নির্দেশনা: শিক্ষা নির্দেশনার আলােচ্য বিষয়, শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকের করণীয় কী, কীভাবে তার বিস্তার করা সম্ভব প্রভৃতি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য শিক্ষা ও বৃত্তি নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত হয়।

উপরিউক্ত আলােচনা থেকে বলা যায় যে, শিক্ষামনােবিদ্যার পরিধি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বিস্তৃত এবং সময়ের সঙ্গে শিক্ষামনােবিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে এর পরিধিও ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।