বর্তমানে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে স্কিনারের সক্রিয় অনুবর্তনের গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষক যদি অপারেন্ট অনুবর্তন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন, তাহলে শিক্ষার্থীর কাছে শিখন কার্যকরী ও সহজে বােধগম্য হবে। এই তত্ত্বের শিক্ষামূলক উপযােগিতাগুলি হল— 

(1) পূর্বপ্রস্তুতি: আচরণ পরিবর্তনের জন্য তিনটি উপাদান প্রধান, যথা— পূর্বাবস্থা, আচরণ এবং শক্তিদায়ক উপাদান। অর্থাৎ পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া সঠিক আচরণ বা আচরণের পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই পাঠদানের পূর্বে শিক্ষক মহাশয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাঞ্ছিত আচরণ আনার জন্য তাদের মধ্যে প্রস্তুতি আনবেন।

(2) শক্তিদায়ক উদ্দীপকের উপস্থাপন: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সঠিক আচরণের জন্য তাদেরকে শিক্ষক পুরস্কৃত করবেন, যা পরে সঠিক আচরণ করতে শক্তি জোগাবে। এই পুরস্কার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শক্তিদায়ক উদ্দীপক হিসেবে কাজ করবে।

(3) আচরণ সংশােধন করতে: শিক্ষার্থীদের আচরণ সংশােধন করার জন্য শিক্ষক মহাশয় সক্রিয় অনুবর্তনের প্রয়ােগ ঘটাতে পারেন। যদি শিক্ষক কোনাে শিশুর আচরণ সংশােধন করতে চায় তাহলে। তার বাঞ্ছিত আচরণের সঙ্গে শক্তিশালী উদ্দীপকের বন্ধন ঘটাতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত বাতি আচরণটি স্থায়ী হয় ততক্ষণ পর্যন্ত। এই বন্ধন চালিয়ে যেতে হবে। এইভাবেই আচরণের সংশােধন করা সম্ভব।

(4) ব্যক্তিত্ব বিকাশে: শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশ নির্ভর করে কোনাে না কোনাে শক্তিদায়ক উদ্দীপকের উপর। আমরা ভাষা শিখি-তার কারণ এর মাধ্যমে অপরের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করি, ভাব বিনিময় করি, নিজের চাহিদা মেটাই, প্রক্ষোভকে প্রকাশ করি যা পুরস্কারের সমতুল্য।

(5) গণিত, নামতা, বানান, শব্দ শেখা: অপারেন্ট কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষার্থীদের গণিত, নামতা, বানান, শব্দ শেখানাে হয়।

(6) টিচিং মেশিন ও প্রােগ্রাম শিখনে: স্কিনারের সক্রিয় অনুবর্তন প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে এই যুগান্তকারী শিখন পদ্ধতিটি রূপ পেয়েছে। টিচিং মেশিন ও প্রােগ্রাম শিখন পদ্ধতিটি নিম্নরূপ一

  • শিখনের বিষয়বস্তুকে এমনভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে (ফ্রেম) বিভক্ত করা হয় যাতে শিক্ষার্থীরা জানা থেকে অজানাকে সহজে নিজে নিজে শিখে ফেলতে পারে এবং এখানে সফলতার সম্ভাবনা সর্বোচ্চ মাত্রায় থাকে।
  • দ্রুত ফিডব্যাক’ সরবরাহ করার ব্যবস্থা এখানে থাকে।

(7) শাস্তির নীতি পরিত্যাগ করতে: শাস্তির ভয়ে শিক্ষার্থীরা পাঠ মুখস্থ করতে পারে কিন্তু তাদের স্থায়ী শিখন হয় না, কারণ শাস্তি শক্তিদায়ক উদ্দীপক নয়। তাই সক্রিয় অনুবর্তনের নীতি অনুযায়ী শিক্ষক মহাশয়কে এমন শক্তিদায়ক উদ্দীপকের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের সঠিক আচরণ সম্পাদনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় ও শিখন স্থায়ী হয়।

(8) সুঅভ্যাস গঠন করতে: শিশুর অভ্যাস সংশােধন, সুঅভ্যাস গঠন করতে অপারেন্ট কৌশল অনুসরণ করা হয়। যেমন— শিক্ষার্থীর প্রতিটি ভালাে কাজের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা যাতে সে কোনাে কাজ করতে আগ্রহী হয়।

(9) সক্রিয়তা: শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ততা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সক্রিয়তা আনে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ততা না থাকলে তাদের শিখন স্থায়ী হয় না। তাই শিক্ষক মহাশয় শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করবেন যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সক্রিয়তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে।

সক্রিয় অনুবর্তনের সীমাবদ্ধতা

সক্রিয় অনুবর্তনের ত্রুটি হিসেবে বা সীমাবদ্ধতা হিসেবে যে-সমস্ত বিষয়কে চিহ্নিত করা যায় সেগুলি হল—

(1) স্বাভাবিকতার অভাব: পরীক্ষাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রাণীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও স্বাভাবিক শিখন পরিস্থিতিতে তা কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়।

(2) মানসিক বৈশিষ্ট্যের গুরুত্বহীনতা: মানুষের সবরকম প্রতিক্রিয়া শুধুমাত্র শক্তিদায়ক উদ্দীপক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে এটা ঠিক নয়। ব্যক্তি তার নিজস্ব মানসিক বৈশিষ্ট্য যেমন— চাহিদা, প্রবণতা, আগ্রহ, কৌতুহল প্রভৃতির দ্বারাও প্রভাবিত হয়। সক্রিয় অনুবর্তনে এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

(3) সামাজিক প্রভাবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি: ব্যক্তির আচরণ বা শিখনে সামাজিক পরিবেশের যে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে তা সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্বে স্বীকার করা হয়নি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীর ভাষা শিক্ষা, যার উপর সামাজিক পরিবেশের প্রভাব সর্বাধিক, তার ব্যাখ্যা এই তত্ত্ব দিতে পারেনি।

(4) বংশগত ও গঠনগত উপাদান উপেক্ষিত: স্কিনারের এই অনুবর্তন ব্যক্তির বংশগত ও গঠনগত উপাদানগুলির উপর কোনাে গুরুত্ব আরােপ করেনি।

(৫) সাংগঠনিক ত্রূটি: সক্রিয় অনুবর্তনেশক্তিদায়ক উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু কীভাবে বাড়িয়ে দেয় তার ব্যাখ্যা তত্ত্বের মধ্যে দেওয়া হয়নি।

অনেক ত্রূটি বা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে বিচার করলে বলা যায় যে, অপারেন্ট অনুবর্তন তত্ত্ব মানুষের শিখনের অনেক বেশি বিস্তিত অংশকে ব্যাখ্যা করতে পারে।