থর্নডাইক প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলকে কেন্দ্র করে মােট ৪ টি সূত্রের অবতারণা করেছেন। সূত্রগুলির মধ্যে ৩ টি মুখ্য সূত্র এবং ৫ টি গৌণ সূত্র।

শিক্ষাক্ষেত্রে থর্নডাইকের মুখ্য সূত্র

(A) থর্নডাইকের অনুশীলনের সূত্র

থর্নডাইক উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযােগ স্থাপনের জন্য বারবার অনুশীলন বা চর্চার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। অনুশীলনের সূত্রকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—

(১) ব্যবহারের সূত্রব্যবহারের সূত্রে বলা হয়েছে, যখন সবকিছুই ঠিক থাকে, উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার সংযােগস্থাপনের পর যদি বারবার অনুশীলন করা হয়, তখন সংযােগের শক্তি বাড়বে এবং শিখন শক্তিশালী হবে।

(২) অন্যবহাবের সূত্র: অব্যবহারের সূত্রে বলা হয়েছে, যখন উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সাফল্যের সঙ্গে সংযােগ স্থাপনের পর যদি দীর্ঘদিন অনুশীলন না করা হয়, তখন সেই সংযােগের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।

থর্নডাইকের অনুশীলন সূত্রের শিক্ষাগত তাৎপর্য

(১) শ্রেণিকক্ষে অনুশীলন: শিক্ষক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণীয় বিষয় শিক্ষার্থীদের বারবার অনুশীলনের উপর জোর দেন। এক্ষেত্রে শিক্ষককে লক্ষ রাখতে হবে ছাত্রছাত্রীদের অনুশীলন যেন মুখস্থনির্ভর বা যান্ত্রিক না হয়ে পড়ে।

(২) অব্যবহারের সচেনতা: পূর্বে শেখা বিষয়বস্তু দীর্ঘদিন চর্চা না করলে অনেকক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তা ভুলে যায়। সেক্ষেত্রে শিক্ষক পূর্বের শেখা বিষয়বস্তু মাঝেমধ্যে অনুশীলনের জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করবেন।

(৩) শিক্ষার্থীদের প্রতি ক্রিয়ার প্রাধান্য: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া করার বেশি করে সুযােগ দিতে হবে। প্রথম প্রথম তারা ভুল প্রতিক্রিয়া করতে পারে। ভুল প্রতিক্রিয়া করতে করতে একসময় তারা সঠিক প্রতিক্রিয়া করবে।

(৪) একাধিকবার উপস্থাপন: শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় শিক্ষক-শিক্ষিকারা নতুন ও জটিল অংশগুলি একাধিকবার উপস্থাপন করবেন।

(৫) জানা থাক অজানা বিষয় পাঠদান: শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় জানা থেকে অজানা বিষয়ের দিকে যাওয়ার নীতি অনুসরণ করবেন। শিক্ষক এই নীতি অনুসরণ করে শিক্ষাদান করলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণে বেশি করে আগ্রহী হবে।

(৬) ভুল পরিত্যাগ: পাঠের অপ্রয়ােজনীয় বা ভুল অংশগুলি যাতে প্রথম সুযােগেই বাদ দেওয়া যায় সেদিকে শিক্ষক মহাশয় সজাগ থাকবেন।

(৭) পুনরালোচনা: নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে গঠিত বিষয়কে শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের কাছে পুনরালােচনা করবেন।

(B) থর্নডাইকের প্রস্তুতি সুত্র

থর্নডাইক শিখনের মুখ্য সূত্রে দৈহিক প্রস্তুতির কথা বলেছেন। তাঁর মতে, উদ্দীপক ও তার উপযােগী প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযােগ স্থাপনের জন্য ব্যক্তির দৈহিক প্রস্তুতি থাকা প্রয়ােজন। যখন সংযােগস্থাপনের জন্য ব্যক্তি প্রস্তুত আছে তখন সংযােগ স্থাপন করতে দিলে সে তৃপ্তিবােধ করবে। ব্যক্তির যদি প্রস্তুতি না থাকে, সেক্ষেত্রে জোর করে সংযােগ স্থাপন করতে দিলে সে বিরক্তিবােধ করবে।

থর্নডাইকের প্রস্তুতি সূত্রের শিক্ষাগত তাৎপর্য

(১) শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যদি শিক্ষাগ্রহণের জন্য দৈহিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের উদ্দেশ্য সফল হবে না।

(২) শিক্ষার্থী প্রস্তুতির অভাবে অমনােযােগী হয়ে পড়বে।

(৩) শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে ধীরে ধীরে তাদের শিক্ষাগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করবেন।

(৪) প্রয়ােজনে শিক্ষক নীতি, আদর্শ, মূল্যবােধ দ্বারা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে তুলবেন। কারণ, শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি ছাড়া শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা বাস্তবে কোনাে কাজেই লাগবে না।

(C) থর্নডাইকের ফললাভের সূত্র

থর্নডাইকের মতে, উদ্দীপক ও তার উপযােগী প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযােগস্থাপনের ফল যদি ব্যক্তির কাছে তৃপ্তিদায়ক হয়, তাহলে শিখন শক্তিশালী ও স্থায়ী হবে। অপরপক্ষে, সংযােগ স্থাপনের ফল যদি ব্যক্তির কাছে বিরক্তিকর হয়, তাহলে শিখন দুর্বল হবে এবং একসময় সম্পূর্ণ ভুলে যাবে।

থর্নডাইকের ফললাভের সূত্রের শিক্ষাগত তাৎপর্য

(১) তৃপ্তিদায়ক: বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিখনকে কার্যকরী করে তুলতে হলে শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু ও তার ফল তাদের কাছে তৃপ্তিদায়ক করে তুলতে হবে। শ্রেণিকক্ষে নিম্নলিখিত উপায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখনের মাধ্যমে আনন্দদায়ক অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে হবে। শিক্ষক শিক্ষণীয় বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করবেন যাতে বিষয় ও শিখনের ফল দুই-ই শিক্ষার্থীর কাছে সুখকর হয়।

(২) বিষয়বস্তু আয়ত্তকরণ: শিক্ষক মহাশয় পাঠ্য বিষয়টি যেন শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতার আয়ত্তের মধ্যে থাকে সেদিকে নজর দেবেন।

(৩) সহজ থেকে কঠিন বিষয়ে পাঠদান: শিক্ষক-শিক্ষিকারা পাঠক্রমকে সহজ থেকে কঠিন এই ক্রমানুসারে বিন্যস্ত করবেন।

(৪) আংশিক থেকে সমগ্র বিষয়ে পাঠদান: দীর্ঘ পাঠকে ছােটো ছােটো অংশে ভাগ করে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষক মহাশয় শিক্ষার্থীদের কোনাে বিষয় পড়াবেন।

(৫) পুরস্কৃত করা: মাঝে মাঝে প্রশংসা, পুরস্কার ও তিরস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দেবেন।

(৬) শিক্ষাসহায়ক উপকরণ ব্যবহার: বিভিন্ন রকম শিক্ষাসহায়ক উপকরণ ও আকর্ষণীয় শিক্ষাপদ্ধতি সহযােগে শিক্ষক-শিক্ষিকা পাঠ প্রদান করবেন।

(৭) বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য: শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুটি বৈচিত্র্যময় হতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি দূর হয়।

শিক্ষাক্ষেত্রে থর্নডাইকের মূল সূত্রগুলির গুরুত্ব যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শিখনের জন্য এই সূত্রগুলির প্রয়ােগ দেখা যায়।