প্রশ্নঃ শিক্ষণ সংক্রান্ত থর্নডাইকের সূত্রগুলো আলোচনা কর।

অথবা, শিক্ষণের প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধনমূলক পদ্ধতি আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ প্রত্যেক সমাজই সুসভ্য মানুষ আশা করে থাকে। কিন্তু মানুষকে সুসভ্য হতে হলে অবশ্যই তাকে স্বীয় সমাজের অনেক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষণের মাধ্যমে জানতে হয়। কেননা, শুধুমাত্র শিক্ষণের মাধ্যমেই একজন সভ্য ও সুশিক্ষিত দায়িত্বপূর্ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠাতে পারে। এমনিভাবে সভ্য, সুশিক্ষিত ও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য তাকে অসংখ্য আচরণ শিক্ষা করতে হয়। শিক্ষণ মানুষের জীবনে একটি অতি প্রয়োজনীয় ব্যাপার।

প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধন তত্ত্বের প্রেক্ষাপটঃ প্রত্যেক প্রকার শিক্ষণের ক্ষেত্রে কমবেশি চেষ্টার প্রয়োজন হয়। তবে চেষ্টা ও ভুল সংশোধনের পদ্ধতিকে এক বিশেষ অর্থে গ্রহণ করা হয়। এতে সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে অবহিত না থেকে এলোমেলোভাবে চেষ্টা চালানো হয়। বারবার ভুল করতে করতে শিক্ষার্থী হঠাৎ সঠিক প্রতিক্রিয়াটি করে ফেলে। এই পদ্ধতিতে শিক্ষণ হলো অতিমাত্রায় যান্ত্রিক। এ কারণে এ পদ্ধতিতে শিক্ষণকে বুদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষণের ঠিক বিপরীত বলে মনে করা হতো। কিন্তু আজকাল চেষ্টা ও ভুল সংশোধনের পদ্ধতিতে শিক্ষণকে ঐ অর্থে গ্রহণ করা হয় না। শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকে আন্দাজে এলোপাতাড়ি চেষ্টা চালানোই চেষ্টা ও ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষণ নয়। যা হোক, এ পদ্ধতিতে শিক্ষণ সম্পর্কিত গবেষণাগুলোর আলোচনা থেকে এই শিক্ষণ পদ্ধতির স্বরূপ সম্পর্কে জানা যাবে।

প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষণঃ আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড লি থর্নডাইক (EL. Thorndike, 1874-1949) মনে করেন, ভুল সংশোধন ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রাণী ও মানুষেরা বহুসংখ্যক আচরণ শেখে। যেমন একটি দরজা খুলতে শেখা অথবা সাইকেল চালাতে শেখা। এসব শিক্ষণ কি কি শর্তের অধীনে ঘটে আর কি শর্তের অধীনে ঘটে না সেগুলো নিয়ে তিনি বহুসংখ্যক পরীক্ষণ করেছিলেন। প্রাণীদের আচরণ বাইরে থেকে দেখা যায় এবং যার যার পরীক্ষা করা যায়। সেজন্য যেসব আচরণ জন্মগত নয় সেগুলো মানুষ বা প্রাণী কি পদ্ধতিতে শেখে তা জানার জন্য তিনি প্রাণীদের নিয়ে পরীক্ষণ করেন। থর্নডাইক ডারউইনের বিবর্তনবাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। বিশেষত, ডারউইন যে বলেছিলেন, মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে সেই ধারণাটি থর্নডাইক পরীক্ষা করতে চেষ্টা করেন। প্রাণী তার পরিবেশের সঙ্গে কীভাবে খাপখাইয়ে নিতে শেখে তিনি তা বুঝতে চেষ্টা করেন। তিনি গবেষণাগারের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এমন সবধরনের আচরণ নিয়ে পরীক্ষা করতে চাইলেন যেসব আচরণ প্রাণী তার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যবহার করে। এ উদ্দেশ্যে তিনি ক্ষুধার্ত বিড়াল খাদ্য পাওয়ার জন্য কীভাবে একটি ধাঁধার বাক্স থেকে বের হওয়া শিখতে পারে তা নিয়ে গবেষণা করেন। থর্নডাইফ মনে করতেন যে, শিক্ষণ মানেই যোগসূত্র বা এস্পনি স্থাপন। ক্রমাগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অথবা যা একই কথা বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে এসব সংযোগ ক্রমশ শক্তিশালী হয়। আবার অনুশীলন না করলে এসব সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে। থর্নডাইক বলেন যে, একটি উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পুরস্কারের প্রয়োজন। থর্নডাইকের তত্ত্বের মূল কথা হলো এই যে, উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পুরস্কারের প্রয়োজন।

প্রথমদিকের প্রচেষ্টাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভুল প্রতিক্রিয়া ঘটে। যেমন থাবা দিয়ে বাক্সের গায়ে আঁচড়ানো, থাবা দিয়ে ধাক্কা দেয়া, খিলটিতে কামড় দেয়া, এমনি আরো অনেক। কিছু প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই দরজা খোলে না। অবশেষে একটি প্রতিক্রিয়া, যেমন থাবা দিয়ে খিলটিতে চাপ দেয়া- এর মাধ্যমে দরজাটি খুলে যায়।

বিড়ালটিকে বাক্সের মধ্যে রাখার পর থেকে দুরজা খোলার পূর্বমুহূর্ত সময় পরিমাপ করা হয়। প্রথমদিকের প্রচেষ্টাগুলোতে বাক্স থেকে বের হওয়ার জন্য সময় বেশি লাগে, কিন্তু এ সময় ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

শিক্ষণের নীতিঃ অর্নডাইক তিনটি মৌলিক নীতি বা সূত্রের মাধ্যমে শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন। এ তিনটি নীতি ছকের মাধ্যমে দেখানো হলোঃ থর্নডাকের শিক্ষণের নীতি, (১) প্রস্তুতির নীতি, (২) অনুশীলনের নীতি, (৩) ফলাফলের নীতি। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হলোঃ

(১) প্রস্তুতির নীতিঃ এ নীতিটি শিক্ষণের একটি সহযোগী নীতি। শিক্ষণের মূল নীতিটি হলো ফলাফলের নীতি। কিন্তু প্রস্তুতির নীতিটি ছাড়া ফলাফলের নীতিটি কার্যকর হতে পারে না। প্রস্তুতির নীতিটিতে বলা হয়েছে, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে প্রাণী সন্তুষ্ট বা বিরক্ত হয়— যাতে সে উদ্দীপনা পেতে চায় বা প্রত্যাখ্যান করে। এ ধরনের তিনটি পরিস্থিতি হতে পারে- ক. প্রাণীর মধ্যে কোনো কাজের প্রবণতা বা প্রস্তুতি সৃষ্টি হলে সে কাজটি করতে দিলে প্রাণীটি সন্তুষ্ট হবে। খ. আর কাজটি করতে না দিলে বিরক্তির সৃষ্টি হবে। গ. কোনো প্রাণীর মধ্যে কাজের প্রস্তুতি সৃষ্টি না হলে জোর করে কাজটি করতে বাধ্য করা হলে বিরক্তি সৃষ্টি হবে।

(২) অনুশীলনের নীতিঃ এই নীতিটির দু’টি অংশ রয়েছে- একটি অংশ ব্যবহারের নীতি (law of use) এবং অন্য অংশে অব্যবহারের নীতি (Law of disuse) ব্যক্ত করা হয়েছে। ব্যবহারের নীতিতে বলা হয়েছে যে, অনুশীলনের ফলে উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ায় সংযোগের শক্তি বৃদ্ধি পায়। এর অর্থ হলো অনুশীলনের সংখ্যা যত বেশি হবে একই ধরনের উদ্দীপকের উপস্থিতিতে উক্ত প্রতিক্রিয়াটি ঘটবার সম্ভাবনা তত বৃদ্ধি পাবে। অব্যবহারের নীতিতে বলা হয়েছে যে, অনুশীলন বন্ধ করা হলে উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ার সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে অথবা প্রতিক্রিয়াটির বিস্মৃতি ঘটে।

ফলাফলের নীতিঃ ফলাফলের নীতিতে বলা হয়েছে যে, একটি উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ার সংযোগ শক্তিশালী হবে না দুর্বল হয়ে পড়বে তা নির্ভর করে এর ফলাফলের ওপর। যদি কোনো প্রতিক্রিয়ার পরে প্রাণীটি সন্তুষ্টি পায় বা পুরস্কার পায়, তাহলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটলে প্রতিক্রিয়াটি পুনরায় ঘটবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে কোনো প্রতিক্রিয়ার পর প্রাণী যদি শাস্তি পায় বা বিরক্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে একই রকম পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়াটি ঘটবার সম্ভাবনা কমে যায়।

সমালোচনাঃ অ্যাডামস (Adams, 1929) থর্নডাইকের পরীক্ষণগুলো পুনরায় পরিচালনা করেন। প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি ভিন্ন সিদ্ধান্তে আসেন। তার মতে, প্রাণী কেবলমাত্র এলোপাতাড়ি চেষ্টা চালায় না। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখেই প্রাণীটি চেষ্টা চালিয়ে থাকে। হবহাউস (১৯০১) থর্নডাইকের শিক্ষণ পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেন। তার মতে, প্রাণী শিক্ষণ পরিস্থিতির অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পারে। কোনো সমস্যার সমাধান করতে দেখে প্রাণী তা অনুকরণ করে সমাধানটি পুনরায় করতে পারে। চেষ্টা ও ভুল সংশোধন পদ্ধতির যান্ত্রিক দিকটিকে তিনি পুরোপুরি স্বীকার করেননি। তার মানে, প্রাণী শুধু এলোপাতাড়ি চেষ্টা করে না, শিক্ষণ পরিস্থিতির অভ্যন্তরীণ অংশগুলোকে প্রত্যক্ষণ করেই প্রাণী লক্ষ্যবস্তু অর্জনের উদ্দেশ্যে চেষ্টা চালাতে থাকে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষণ তত্ত্বের আলোচনায় বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর যুক্তি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, শিক্ষণ একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। চিন্তা-ভাবনা বা অন্তর্দৃষ্টির কোনো স্থান এতে নেই। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, বারবার অনুশীলন করতে যেসব ভ্রান্তি ঘটে তা পরিহার বা সংশোধন করে সঠিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করাই শিক্ষণ থর্নডাইক যুক্তি দেখান যে, শুধু ইতর প্রাণী নয়, সভ্য মানুষও প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে।