অথবা, শিক্ষণ প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য হিসেবে সার্বিকীকরণ, পৃথকীকরণ ও স্বতঃস্ফুর্ত পুনরাগমন উদাহরণসহ আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ প্রত্যেক সমাজই সুসভ্য মানুষ আশা করে থাকে। কিন্তু মানুষকে সুসভ্য হতে হলে অবশ্যই তাকে স্বীয় সমাজের অনেক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষণের মাধ্যমে জানতে হয়। কেননা, শুধুমাত্র শিক্ষণের মাধ্যমেই একজন সভ্য ও সুশিক্ষিত দায়িত্বপূর্ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এমনিভাবে সভ্য, সুশিক্ষিত ও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার জন্য তাকে অসংখ্য আচরণ শিক্ষা করতে হয়। শিক্ষণ মানুষের জীবনে একটি অতি প্রয়োজনীয় ব্যাপার।
শিক্ষণ প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যসমূহঃ নিম্নে এগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হলোঃ
(১) অর্জন প্রক্রিয়াঃ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়ার সংযোগ স্থাপন। অর্থাৎ শিক্ষণ একটি মান প্রচেষ্টায় সম্পন্ন হয় না। চিরায়ত সাপেক্ষণে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সাপেক্ষ প্রতিবর্তী প্রতিষ্ঠার জন্য সাপেক্ষ উদ্দীপক (es) ও অসাপেক্ষ (us) কে যুগ্মভাবে অথবা অল্প সময়ের ব্যবধানে বহুসংখ্যকবার উপস্থিত করতে হয়। সাপেক্ষ ও অসাপেক্ষ উদ্দীপক যতই বেশিবার উপস্থিত করা হয়, সাপেক্ষ উদ্দীপক ও সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়ার সংযোগ ততই শক্তিশালী হতে থাকে।
(২) সার্বিকরণ বা সাধারণীকরণঃ যখন কোনো একটি উদ্দীপকের প্রতি প্রাণী একটি বিশেষ প্রতিক্রিয়া করতে শেখে তখন এই উদ্দীপকের সদৃশ বা অনুরূপ উদ্দীপকের প্রতি সে একই প্রতিক্রিয়া করে। ধরা যাক, প্যাভলভের পরীক্ষণে একটি কুকুরকে ২৫ ওয়াটের বাল্ব জ্বালানোর অব্যবহিত পরে খাবার দেয়া হলো। এভাবে কয়েকবার খাবার দিলে ২৫ ওয়াটের বাল্বের প্রতি কুকুরটির প্রতিক্রিয়া (লালা নিঃসরণ) সাপেক্ষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ খাবার না দিয়ে শুধু ২৫ ওয়াটের বাল্বটি জ্বালালেই কুকুরটি লালা নিঃসরণ করবে। কিন্তু এই সাপেক্ষকরণ বা শিক্ষণের পর ২৫ ওয়াটের পরিবর্তে ১৫ বা ৪০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালালেও কুকুরটি লালা ক্ষরণ করবে।
(৩) পৃথকীকরণ বা পার্থক্যকরণঃ শিক্ষণের ক্ষেত্রে দু’টি উদ্দীপকের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করাকেই বলা হয় পৃথকীকরণ বা পার্থক্যকরণ। ধরা যাক, প্যাভলভের পরীক্ষণে একটি ক্ষুধার্ত কুকুরকে গাঢ় নীল রঙের বাল্ব জ্বালানোর অব্যবহিত পরে খাবার দেয়া হলো। এভাবে কয়েকবার খাবার দিলে গাঢ় নীল বাল্ব-এর প্রতি কুকুরটির প্রতিক্রিয়া (লালা ক্ষরণ) সাপেক্ষ হয়ে যাবে। তখন খাবার না দিয়ে শুধু গাঢ় নীল আলো জ্বালালেই কুকুরটি লালা নিঃসরণ করবে। এখন সার্বিকরণের নিয়মানুসারে হালকা নীল রঙের বাল্ব জ্বালালেও কুকুরটি লালা নিঃসরণ করবে। কিন্তু হালকা নীল বাল্ব জ্বালানোর সময় যদি প্রতিবারই খাবার দেয়া না হয় তাহলে কুকুরটি বাল্ব দু’টির অর্থাৎ উদ্দীপক দুটির পার্থক্য বুঝতে পারবে।
(৪) অবলুপ্তিঃ সাপেক্ষীকরণের সময় একটি স্বাভাবিক উদ্দীপকের সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপককে কয়েকবার উপস্থাপিত করলে নিরপেক্ষ উদ্দীপকটি স্বাভাবিক উদ্দীপকের প্রক্রিয়াটি ঘটাতে পারে। যেমন, কুকুরকে মাংসের গুঁড়া (স্বাভাবিক উদ্দীপক) দেয়ার সময় প্রতিবার আলো (নিরপেক্ষ উদ্দীপক) জ্বালালে বার কয়েক এরূপ করার পর সে লালা নিঃসরণ করবে। কিন্তু খাবার না দিয়ে শুধু আলো জ্বালাতে থাকলে কুকুরটির লালা ক্ষরণের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকবে। অবশেষে কুকুরটির লালা ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যাবে। অবশ্য এটা সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়ার স্থায়ী বিলোপ নয়।
(৫) স্বতঃস্ফূর্ত পুনরাগমনঃ অবলুপ্তি বলতে সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়াটির বা অভ্যাসের স্থায়ী বিলুপ্তি বোঝায় না। অবলুপ্তি প্রতিক্রিয়াটির সাময়িক অনুপস্থিতিকে বোঝায়। কারণ কুকুরটিকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে দিয়ে পুনরায় সাপেক্ষ উদ্দীপকটি উপস্থাপন করা হলে সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়াটির (লালা নিঃসরণ) স্বতঃস্ফূর্ত আবির্ভাব ঘটে। অর্থাৎ ক্লান্তি দূর হওয়ার ফলে প্রতিক্রয়াটি কিছু শক্তি পুনরুদ্ধার করে। তাই কুকুরটির মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুনরায় লালা আসে। এই ঘটনাকে স্বতঃস্ফূর্ত পুনরাগমন বলা হয়। সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়ার অবলুপ্তির পর প্যাভলভের পরীক্ষণাধীন কুকুরটি কিছুক্ষণ বিশ্রামে থাকে। এরপর প্যাভলভ কুকুরটিকে গবেষণাগারে আনেন এবং মাংসের গুঁড়া ছাড়াই শুধু ঘণ্টাধ্বনি দেন। এতে কুকুরটি পুনরায় কিছু পরিমাণ লালা নিঃসরণ করে। প্যাভলভ এ ঘটনাকে স্বতঃস্ফূর্ত পুনরাগমন বা পুনরুজ্জীবন বলে অভিহিত করেছেন।
(৬) শিক্ষণের সঞ্চালনঃ আমরা একটি পরিস্থিতিতে যা শিখি, অনুরূপ পরিস্থিতিতে তা স্থানান্তর করতে পারি। এ জন্যই প্রত্যেকটি নতুন পরিস্থিতিতে আমাদের নতুন আচরণ শিখতে হয় না। অথবা নতুন আচরণ শিখতে গেলে সহজ হয়। সুতরাং শিক্ষণের স্থানান্তর বলতে বুঝায় একটি কাজ প্রথমে শিক্ষা করলে পরবর্তীকালে একই ধরনের অন্য একটি কাজ করতে সহজ হয়। যেমনঃ বাইসাইকেল চালানো শিখলে পরবর্তীতে মোটরসাইকেল চালানো শিখা সহজ হয়। ঠিক তেমনিভাবে সাধারণ টাইপ মেশিনে টাইপ করতে শিখলে কম্পিউটারের কি বোর্ডে টাইপ করতে সহজ হয়। এমনিভাবে একটি মোটর গাড়ির পুরাতন মডেল চালানো শিখলে নতুন মডেল চালাতে সহজ হয়। ভাষাগত শিক্ষণ এবং অঙ্গ সঞ্চালনমূলক শিক্ষণ উভয় ধরনের শিক্ষণেরই স্থানান্তর ঘটে থাকে। যেমন স্কুলে আমরা যেসব বিদ্যা শিক্ষা করি সেগুলো বাস্তব জীবনে কাজে লাগে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, ওপরের বৈশিষ্ট্যগুলো মূলত আনুষঙ্গিক ঘটনাবলি। তাই একে বৈশিষ্ট্য না বলে আনুষঙ্গিক ঘটনাবলি বলা অপেক্ষাকৃত সমীচীন। এই আনুষঙ্গিক ঘটনাবলির মাধ্যমে শিক্ষণতত্ত্ব অনেকটা সফল হয়েছে। তবে এগুলোর ব্যাখ্যাগত বিষয় নিয়ে মনোবিজ্ঞানে যথেষ্ট জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সম্প্রতি থর্নডাইক, স্পিনার ও প্যাভলভ গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব দিয়ে একদিকে যেমন জ্ঞান-ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি অন্যদিকে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
Leave a comment