প্রশ্নঃ শাস্তি বলতে কি বুঝায়? দণ্ড বা শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য কি? ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী কি কি ধরনের শাস্তি প্রদান করা যায়? দণ্ডবিধির অধীনে কোন কোন অপরাধের জন্য সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যায়। মৃত্যুদণ্ড আমাদের দেশে কিভাবে কার্যকর করা হয়?

What is meant by punishment? What is the object of punishment? What are the different kinds of punishment prescribed by the Penal Code, 1860? What are the offenses for which forfeiture of property can be awarded under the penal code? How a capital sentence is executed in our country?

শাস্তিঃ সাধারণ অর্থে কোন ব্যক্তির উপর কষ্টদায়ক কিছু ব্যবস্থা আরোপ করাকে শাস্তি বলে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে আইন ভঙ্গের জন্য কিংবা কৃত কোন অপরাধের জন্য বিচারে দোষী ব্যক্তির উপর রাষ্ট্রীয় আদালত কর্তৃক আরোপিত কষ্টদায়ক ব্যবস্থাকে শাস্তি বলা হয়৷

আদালত ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের বিধিবদ্ধ নিয়মের অধীনে নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যে সকল বিরুদ্ধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন সেগুলিকেও শাস্তি বলা হয়।

শাস্তিদানের উদ্দেশ্যঃ শাস্তিদানের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধ প্রতিরোধ করা এবং অপরাধীকে সংশোধন করা। অপরাধ বিজ্ঞানীরা শাস্তির উদ্দেশ্যসমূহকে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলি হচ্ছে (১) প্রতিশোধ, (২) নিবারণ, (৩) প্রতিরোধ এবং (৪) সংশোধন।

সমাজের সাধারণ মানুষেরা প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে শাস্তির যথার্থতা খুঁজে পায়। অপরপক্ষে আধুনিক কালের উদার নৈতিক প্রগতিশীল সমাজ নিবারণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শাস্তিদানের যথার্থতা চিহ্নিত করেন। যারা সামাজিক সংস্কারে বিশ্বাসী তারা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সংস্কারের জন্য শাস্তির প্রয়োজনীয়তা আছে বলে স্বীকার করেন।

মানুষের একটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিহিংসা পরায়ণতা। সে চায় ক্ষতিপূরণ। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি তাই অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার অনলে জ্বলে উঠে। এমতাবস্থায় সে অপরাধীর যথার্থ শাস্তি কামনা করে এবং অপরাধীকে শাস্তি ভোগ করতে দেখলেই তার প্রতিহিংসার অনল নিবৃত হতে পারে। তাই প্রতিহিংসামূলক শাস্তি প্রতিহিংসাকে লাঘব করে এবং এতে সমাজে একটা ভারসাম্য অবস্থা বিরাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

নিবারণ অর্থ হচ্ছে বারণ করা। তাই কোন কাজ করতে বাধা প্রদানই হচ্ছে নিবারণের উদ্দেশ্য। এই মতবাদের প্রবক্তারা মনে করেন যে, অপরাধীকে শাস্তি দিলে সমাজের অন্য ব্যক্তিরা তা দেখে ভবিষ্যতে অপরাধমূলক কার্যকলাপ হতে বিরত থাকবে। অর্থাৎ শাস্তি সকলের নিকট একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকবে। আধুনিক যুগে প্রায় সকল দেশেই নিবারণমূলক উদ্দেশ্য শাস্তি প্রদানকে অধিকতর বিবেচনা প্রসূত বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অপরাধ বিজ্ঞানী বেকারিয়ার মতে, শাস্তির উদ্দেশ্য অপরাধীকে অত্যাচার করা নয় বরং এ ধরনের অপরাধ যেনো অন্যরা না ভবিষ্যতে না করে তার ব্যবস্থা করা।

প্রতিরোধমুলক মতবাদের যুক্তি হলো কোন বিশেষ অপরাধীকে এমনভাবে অক্ষম বা ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলা যেনো সে পুনরায় অপরাধ করার সুযোগ না পায়। বস্তুত এর দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। 

প্রথমতঃ শাস্তিটি অন্য সকলের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যেনো তারা অপরাধ কর্মে লিপ্ত হতে সাহস না পায়। 

দ্বিতীয়তঃ অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে এমন অবস্থায় রাখা যেনো সে পুনরায় অপরাধে লিপ্ত হতে সুযোগ না পায়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এ ধরনের একটা শাস্তি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক আমুল পরিবর্তন আনে। এই পরিবর্তনের একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো অপরাধের উপর গুরুত্ব আরোপের পরিবর্তে অপরাধীর উপর গুরুত্ব আরোপ। বর্তমানে সভ্য রাষ্ট্রগুলিতে অপরাধীকে রোগী হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তার সুচিকিৎসা হলে সমাজে একজন সুনাগরিক হিসেবে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে সক্ষম হবে। “অপরাধকে ঘৃণা কর, অপরাধীকে নয়” এটাই হচ্ছে সংশোধনমূলক মতবাদের মূল কথা। এই মতবাদের সমর্থকরা কষ্টদায়ক শারীরিক শাস্তির বিরোধীতা করেন। তবে, কারাগারে আবদ্ধ করার পরে চারিত্রিক পরিবর্তন আনার জন্য এক বিশেষ নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অনুসরণের দ্বারা তাকে সংশোধিত করা যায়৷

শাস্তির ধরণঃ বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫৩ ধারা অনুযায়ী যে সকল শাস্তির বিধান রয়েছে তার নিম্নরূপ-

(১) মৃত্যুদণ্ড; (২) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড; (৩) সশ্রম কারাদণ্ড; (৪) বিনাশ্রম কারাদণ্ড; (৫) সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত; (৬) জরিমানা।

যে সকল অপরাধের জন্য সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যায়ঃ দণ্ডবিধির ধারা ১২৬, ১২৭ ও ১৬৯ এ বর্ণিত অপরাধের জন্য অপরাধীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যায়। ধারা ১২৬ য়ে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি বাংলাদেশের সাথে মৈত্রীবদ্ধ বা শান্তিতে বসবাসকারী কোনো ব্যক্তির রাজ্য এলাকাসমূহের ওপর লুণ্ঠনকার্য সংঘটিত করে বা সংঘটনের প্রস্তুতি নেয়, সে ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ ৭ বছর পর্যন্ত হতে পারে, দণ্ডিত হবে এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে এবং অনুরূপ লুণ্ঠন কার্যে ব্যবহৃত বা ব্যবহারের নিমিত্ত অভীষ্ট বা অনুরূপ লুণ্ঠনের সাহায্যে অর্জিত তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে। ১২৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, ১২৫ ও ১২৬ ধারায় উল্লেখিত কোনো অপরাধ সংঘটনকলে প্রাপ্ত, বলে জেনেও তা গ্রহণ করে, সে ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ ৭ বছর পর্যন্ত হতে পারে, দণ্ডিত হবে এবং আর্থিক দণ্ডেও দণ্ডিত হবে এবং তার অনুরূভাবে প্রাপ্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে।

১৬৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী হয়ে এবং অনুরূপ সরকারী কর্মচারি হিসেবে কোনো বিশেষ সম্পত্তি ক্রয় না করা বা তার জন্য নিলামে না কেনার জন্য আইনত বাধ্য হয়েও তার নিজের নামে বা অন্য কার নামে যৌথভাবে বা অন্যদের সাথে অংশে উক্ত সম্পত্তি ক্রয় করে বা তার নিলামে দর প্রস্তাব দেয়, সে ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ ২ বছর পর্যন্ত হতে পারে বা আর্থিক দণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং সম্পত্তি ক্রয় করা হয়ে থাকলে, তা বাজেয়াপ্ত হয়ে যবে।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরীকরণঃ ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৮(১) ধারায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “When any person is sentenced to death, the sentence shall be direct that he be hanged by the neck till he is dead’। তাই দেখা যায় যে, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ফাঁসিতে ঝুলায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।