শাসন বিভাগ: আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারের তিনটি বিভাগ (আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ)-এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হল শাসন বিভাগ। এককথায় বলা যায় যে, আইন বলবকারী বিভাগই হল শাসন বিভাগ। অধ্যাপক গার্নার-এর ভাষায়, আইনসম্মতভাবে সরকারের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত স্তরে চৌকিদার পর্যন্ত সকল কর্মচারীকে নিয়ে যে বিভাগ গঠিত হয়, সেই বিভাগকে শাসন বিভাগ বলা হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে, যথাㅡ
- একক পরিচালক ও বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা।
- নামসর্বস্ব ও প্রকৃত শাসক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা।
- উত্তরাধিকারসূত্রে মনােনীত শাসক ও নির্বাচিত শাসকবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থা।
একক পরিচালক ও বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা
[1] একক পরিচালকবিশিষ্ট শাসন কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞা: যে ধরনের শাসন ব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতা কোন একজন ব্যক্তি বা কোনাে ব্যক্তি গােষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং শাসকের নির্দেশে ও নেতৃত্বে প্রশাসনের কাজ সম্পাদিত হয়, তাকে একক পরিচালকবিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা বলে অভিহিত করা হয়। একক পরিচালকবিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় সরকারি তথ্যের গােপনীয়তা রক্ষা সহজ হয়। উদাহরণ : চরম রাজতন্ত্র, হিটলারের নাৎসি দলের শাসন এবং ইটালিতে মুসােলিনির শাসন একক পরিচালিত শাসন ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
[2] বহু পরিচালক বিশিষ্ট শাসন কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞা: বহুপরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা হল একক পরিচালক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থার বিপরীত শাসনব্যবস্থা। শাসন বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার প্রয়ােগ ও পরিচালনার দায়িত্ব একাধিক ব্যক্তির হাতে অর্পিত হলে, তাকে বহুপরিচালকবিশিষ্ট শাসন কর্তৃপক্ষ বলা হয়। উদাহরণ : যুগোস্লাভিয়া, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ এবং সুইজারল্যান্ডে বহুপরিচালকবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থা প্রচলিত আছে। প্রাচীনকালে এথেন্সে এবং রােমে বহুপরিচালকবিশিষ্ট শাসন প্রচলিত ছিল।
নামসর্বস্ব ও প্রকৃত শাসক বিশিষ্ট শাসনব্যবস্থা
[1] নামসর্বস্ব শাসকবিশিষ্ট শাসন কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞা: যার নামে তত্ত্বগতভাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়, কিন্তু বাস্তবে তিনি ক্ষমতা ভােগ করেন না, শুধু নামেই শাসক, সেই শাসক নামসর্বস্ব শাসক বলে।
উদাহরণ: ইংল্যান্ডের রাজা ও রানি এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন নামসর্বস্ব শাসকের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এঁরা প্রত্যেকেই নামসর্বস্ব শাসকের মর্যাদায় থাকেন অর্থাৎ তারা রাষ্ট্রপ্রধান হলেও ক্ষমতায় আসীন থাকেন না।
[2] প্রকৃত শাসকবিশিষ্ট শাসন কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞা: তত্ত্বগতভাবে যিনি সর্বোচ্চ শাসনক্ষমতা বা মর্যাদার অধিকারী না হয়েও বাস্তবে শাসনক্ষমতার প্রকৃত কর্ণধার ও প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী, তাকে বলা হয় প্রকৃত শাসক।
উদাহরণ: ভারতের প্রধানমন্ত্রী, গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রকৃত শাসকপ্রধানের দৃষ্টান্ত।
উত্তরাধিকারসূত্রে মনোনীত শাসক ও নির্বাচিত শাসক বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা
[1] উত্তরাধিকারসূত্রে মনােনীত শাসকের সংজ্ঞা: যে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন সেই ব্যক্তিই উত্তরাধিকারসূত্রে মনােনীত শাসক বলে বিবেচিত হন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত না হয়ে বংশানুক্রমিকভাবে মনােনীত হন তখন সেই ব্যক্তিকে উত্তরাধিকারসূত্রে মনােনীত শাসক বলে অভিহিত করা হয়।
উদাহরণ: গ্রেট ব্রিটেনের রাজা ও রানি হলেন উত্তরাধিকারসূত্রে মনােনীত শাসকের উদাহরণ।
বর্তমানে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা উত্তরোত্তর বিকাশের ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে মনােনীত শাসন কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাজা বা রানির ভূমিকা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
[2] নির্বাচিত শাসকের সংজ্ঞা: নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি নির্বাচিত শাসক বলে পরিচিতি লাভ করে। এখানে জনগণ প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে দেশের শাসক নির্বাচিত হন। এই নির্বাচন পদ্ধতি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ উভয় ধরনের হতে পারে।
উদাহরণ: গ্রেট ব্রিটেন এবং ভারতের মন্ত্রীসভা বা আইনসভার সদস্যগণ প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত শাসক প্রতিনিধি হলেও শাসন বিভাগীয় প্রধান কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমানে অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরােক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা দেখা যায়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের রাষ্ট্রপতি একটি নির্বাচক সংস্থার দ্বারা পরােক্ষ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতাসীন হয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণের জন্য দায়িত্বশীল থাকে। এই রাজনৈতিক অংশের কার্যাবলির নিরিখে তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল一
[1] নীতি প্রণয়নকারী সংস্থা: নীতি প্রণয়ন ও আইন বিভাগ প্রণীত আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করাই হল এই অংশের মূল বৈশিষ্ট্য। শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কর্মসূচি ও নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের স্থায়ী কর্মীদের নির্দেশ জারি করে থাকেন।
[2] প্রশাসনের স্নায়ুকেন্দ্র: রাষ্ট্রীয় নীতি, সিদ্ধান্ত এবং কার্যাবলির সমন্বয়ের স্নায়ুকেন্দ্র বলে বিবেচিত হয় শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, সংসদীয় বা মন্ত্রীসভা পরিচালিত সরকারের রাষ্ট্রপতি ও গ্রেট ব্রিটেনের রাজা বা রানি শাসন বিভাগের আনুষ্ঠানিক প্রধানের ভূমিকা পালন করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে শাসকপ্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী, অনেকে গ্রেট ব্রিটেনের সরকারকে প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকার এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী পদের রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। বলে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন।
[3] সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা: দেশের প্রচলিত সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী সরকারকে নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে নেতৃত্ব দান করে থাকে শাসন বিভাগের এই রাজনৈতিক অংশ। যেমন – ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীসভা এই রাজনৈতিক অংশের সাহায্যে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নীতি প্রণয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ছাড়াও শাসনব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন্ কোন্ কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশই করে থাকে।
[4] অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নকারী সংস্থা: পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে বাজেট ও অর্থবিল পেশ করার ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ এইভাবেই অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করে থাকে।
[5] আলংকারিক বৈশিষ্ট্য: শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ দ্বারাই পদস্থ কর্মচারী নিয়ােগ, বিচারপতি নিয়ােগ, সামরিক বাহিনীর তিন প্রধান রাষ্ট্রদূত, কাউন্সিলার নিয়ােগ ও অপসারণ, বিদেশি কূটনীতিক প্রতিনিধিদের পরিচয়পত্র গ্রহণ, অপরাধী বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে ক্ষমা প্রদর্শন এবং যুদ্ধ ঘােষণা, শান্তিচুক্তি ও সন্ধি স্থাপন প্রভৃতি কার্য সম্পাদিত হয়ে থাকে।
[6] শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে: শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ শাসনব্যবস্থার প্রশাসনিক কাজকর্ম চালনা করার ক্ষেত্রে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ভারতের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তাদের সমগ্র কাজকর্মের জন্য লোকসভার সদস্যদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে।
Leave a comment