শাসন-বিভাগের সংজ্ঞা

সরকারের তিনটি বিভাগ আছে। তার মধ্যে যে বিভাগ আইন বলবৎ করে তাকেই শাসন-বিভাগ বলে। সকল দেশেই আইন প্রয়োগের একটা ব্যবস্থা থাকে। যে সংস্থা বা সংগঠনের উপর আইন প্রয়োগ করার দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে, সাধারণত তাকেই বলে শাসন-বিভাগ। শাসন-বিভাগ শব্দটি ব্যাপক ও সংকীর্ণ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়।

ব্যাপক অর্থে শাসন-বিভাগের সংজ্ঞা:

ব্যাপক অর্থে আইন বলবৎকরণে নিযুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে শাসন-বিভাগ গঠিত হয়। এই অর্থে কেবলমাত্র মন্ত্রী, সচিব এবং উচ্চপদাধিকারী ও তাদের সহযোগীদের মধ্যে শাসন বিভাগের আলোচনাকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। আইনের প্রয়োগ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রশাসনিক কর্মচারীরাও শাসন-বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রশাসনিক কাজকর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, উচ্চ-পদাধিকারী ছাড়াও অধীনস্থ প্রশাসনিক কর্মচারীরাও যুক্ত থাকেন। এই কারণে ব্যাপক অর্থে শাসন-বিভাগ হল একটি বৃহৎ কাঠামো। এই কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হল সকল স্তরের কর্তাব্যক্তি ও পদাধিকারিগণ এবং আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত ও প্রকাশিত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কর্মচারিগণ। অর্থাৎ প্রধান কর্মকর্তা থেকে শুরু করে চৌকিদারের ন্যায় সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত সকলেই শাসন-বিভাগের অন্তর্গত। অন্যভাবে বলতে গেলে, আইন-বিভাগ ও বিচার-বিভাগ ব্যতীত সরকারী কার্যে নিযুক্ত সকল ব্যক্তিই শাসন-বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রের এই ইচ্ছা বা আইনকে কার্যকর করার সকল সরকারী সংস্থা শাসন-বিভাগ হিসাবে পরিচিত। রাষ্ট্রের সকল প্রশাসনিক কাজ শাসন-বিভাগের মাধ্যমেই সম্পাদিত হয়।

সংকীর্ণ অর্থে শাসন-বিভাগের সংজ্ঞা:

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শাসন-বিভাগকে এই ব্যাপক অর্থে ধরা হয় না। শাসন-বিভাগ বলতে প্রধান কর্মকর্তা এবং প্রধান কর্মসচিবগণকে বোঝায়। এইসব কর্তাব্যক্তিদের উপরই প্রশাসনিক নীতি ও কার্যক্রম নির্ধারণের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। নীতিনির্ধারণকারী এই সব কর্মকর্তাগণকে নিয়েই শাসন-বিভাগ গঠিত বলে ধরা হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ আমলাদের নিয়ে গঠিত হয় শাসন-বিভাগ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শাসন-বিভাগ কথাটি সাধারণত এই সংকীর্ণ অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক শাসক

শাসন-বিভাগের অস্থায়ী অংশ:

সকল দেশের শাসন-বিভাগের মধ্যে আবার দু’টি অংশ দেখা যায়। এই দু’টি অংশ: (১) রাজনীতিক অংশ ও (২) অ-রাজনীতিক অংশ। শাসন-বিভাগের যেসব ব্যক্তি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন তাঁদেরকে শাসন-বিভাগের রাজনীতিক অংশ (Political Executive) বলা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে এঁরা শাসন-বিভাগে যোগ দেন। কার্যকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর এঁদের পুনরায় নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হয়। তাই এঁদের শাসন-বিভাগের অস্থায়ী অংশও বলা হয়। শাসন-বিভাগের রাজনীতিক অংশকে সরকারী নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে চূড়ান্তভাবে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। এই দায়িত্ব হল আইনসভার কাছে এবং চূড়ান্ত বিচারে নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে। এবং এই দায়িত্বের প্রকৃতি হল প্রত্যক্ষ। উদাহরণ হিসাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার সদস্যদের কথা বলা যায়।

শাসন-বিভাগের স্থায়ী অংশ:

অপরদিকে সরকারের স্থায়ী কর্মচারীদের শাসন-বিভাগের স্থায়ী বা অ রাজনীতিক অংশও (Non-political Executive) বলা হয়। এঁরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে গুণগত যোগ্যতার ভিত্তিতে স্থায়িভাবে শাসন-বিভাগে যোগ দেন। এঁদের নিযুক্তির ব্যাপারে নির্বাচনী রাজনীতিক কোন সম্পর্ক নেই। দৃষ্টান্ত হিসাবে ভারতের সামরিক ও সরকারী দপ্তরের অসংখ্য সরকারী‌ কর্মচারীর কথা বলা যায়। স্থায়ী সরকারী কর্মচারীদের ‘আমলা’ (bureaucrat) নামেও অভিহিত করা হয়। শাসন-বিভাগের অস্থায়ী বা রাজনীতিক অংশ প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণ করেন এবং তার বাস্তবায়নের দিকে নজর রাখেন। আর সরকারের আমলা বা স্থায়ী কর্মচারীরা নীতিগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করেন। শাসন বিভাগের স্থায়ী কর্মচারীরা রাজনীতিক শাসকদের দ্বারা স্থিরীকৃত নীতি ও কর্মসূচীকে বাস্তবে কার্যকর করেন। নিজেদের কাজকর্মের জন্য রাজনীতিক শাসকের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। তবে কার্যত নীতি-নির্ধারণের ব্যাপারেও আমলাদের প্রভাবকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। যাইহোক সরকারের নীতি নির্ধারণ এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রশাসনের স্থায়ী কর্মচারীদের দায়িত্বের প্রকৃতি হল পরোক্ষ। সাধারণত প্রচলিত ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক শাসকদের সম্পর্কে এই ধারণা বর্তমান।

সরকারের নীতি নির্ধারণের বিষয়টি রাজনীতিক পদাধিকারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়:

সাধারণত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারী নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ও অ রাজনীতিক শাসকদের মধ্যে এ ধরনের পার্থক্য সম্পর্কিত ধারণা প্রচলিত দেখা যায়। দেশের রাজনীতিক শাসক এবং অ-রাজনীতিক শাসকের ক্ষমতা ও পদমর্যাদার মধ্যে সীমারেখা স্থিরীকরণের উদ্দেশ্যে উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় এ ধরনের পার্থক্যমূলক আলোচনা করা হয়। অন্যান্য রাজনীতিক ব্যবস্থাতেও ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে এ ধরনের সাবেকী ধারণা প্রচলিত ছিল। এ কথা ঠিক। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণার অবসান ঘটেছে। এখনও অল্পবিস্তর সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই সরকারের স্থায়ী কর্মচারী ও রাজনীতিক পদাধিকারীদের মধ্যে একটা সীমারেখা আছে। এতদ্‌সত্ত্বেও পদস্থ আমলারা সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সরকারী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এখন উচ্চপদাধিকারী আমলারা সরকারের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে প্রতিপন্ন হন। নীতি নির্ধারণের বিষয়টি এখন আর সরকারের রাজনীতিক পদাধিকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বিশেষত জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রতিককালে রাজনীতিক দল, দলের মাধ্যমে নিযুক্ত রাজনীতিবিদ, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী প্রভৃতির মত অ-রাজনীতিক পদাধিকারীরাও দেশের প্রচলিত রাজনীতিক পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়। দেশের সামগ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থায় অ-রাজনীতিক শাসকদের অনুপ্রবেশ ও ভূমিকার গুরুত্ব একটি বড় বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হয়। এই কারণে শাসন-বিভাগের রাজনীতিক পদাধিকারী এবং স্থায়ী সরকারী কর্মচারীর মধ্যে কার্যকর পার্থক্য সব সময় অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। বলও এ ধরনের পার্থক্যমূলক আলোচনার বিরোধিতা করেছেন। তিনি তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “It is difficult to make clear-cut distinction between the bureaucracy and the political executive … with regard to their functions.”

রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক শাসকের মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা অস্পষ্ট:

বর্তমানে অধিকাংশ দেশেই শাসন-বিভাগের স্থায়ী কর্মচারীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আধুনিক কোন উন্নত জনপ্রশাসনে শাসন-বিভাগের রাজনীতিক পদাধিকারীদের স্বরাষ্ট্র বা পররাষ্ট্র সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে সাধারণত একক ভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখা যায় না। তাঁরা স্ব স্ব বিচক্ষণ ও প্রবীণ আমলাদের সঙ্গে প্রায়শই পরামর্শ করেন। অনুরূপভাবে সরকারী নীতি নির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শাসন-বিভাগের স্থায়ী কর্মচারীদের উদ্যোগী ও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। শাসন-বিভাগের কার্যপ্রক্রিয়ায় এই আধুনিক ধারাটি সংবিধান স্বীকৃত নয়। কোন দেশের সংবিধানে এ বিষয়ে লিখিতভাবে কোন অনুমোদন নেই। এতদ্‌সত্ত্বেও শাসন-বিভাগের মধ্যে এই প্রবণতা সকল দেশের শাসনব্যবস্থায় একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। ফ্রান্সের শাসনব্যবস্থায় শাসন-বিভাগের রাজনীতিক অংশ ও অ-রাজনীতিক অংশের মধ্যে পার্থক্যের সীমা নিরূপণ মোটেই সহজ বিষয় নয়। দেশের রাজনীতিক দলের কাজকর্মেও ফরাসী আমলাদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। ফ্রান্সের পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধান (১৯৫৮) প্রবর্তিত হওয়ার পর সরকারের উচ্চপদস্থ আমলারা মন্ত্রিসভার বৈঠকেও অংশগ্রহণ করেছেন। তবে ১৯৬২ সালে আমলাদের এই সুযোগ অস্বীকৃত হয়েছে। পদস্থ আমলাদের মন্ত্রিসভার বিভাগীয় প্রধানের পদে নিয়োগের নজির ফ্রান্সে আছে। নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে চূড়ান্তভাবে দায়িত্বশীল শাসন-বিভাগের রাজনীতিক পদাধিকারীদের সঙ্গে নৈপুণ্যের ভিত্তিতে নিযুক্ত ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শাসন-বিভাগের স্থায়ী কর্মচারীদের পার্থক্যের সীমারেখা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইংল্যাণ্ডের মত উন্নত দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কেও একথা সমভাবে প্রযোজ্য। তবে সদ্য স্বাধীন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই প্রবণতা অধিকতর প্রকট। প্রকৃত প্রস্তাবে এই সমস্যা এই সমস্ত দেশে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

শাসন-বিভাগের রাজনীতিক অংশ এবং অ-রাজনীতিক অংশের ভূমিকার মধ্যে পার্থক্যে

শাসন-বিভাগের রাজনীতিক অংশ এবং অ-রাজনীতিক অংশের ভূমিকার মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা ক্রমশ অপসৃয়মান। এই অবস্থার পিছনে কতকগুলি কারণ বর্তমান। এই কারণগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

(১) বর্তমানে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে। তার ফলে সরকারের দায়িত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিধি প্রসারিত হয়েছে। আবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমস্যা সংখ্যাগত বিচারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকৃতিগত বিচারে জটিল হয়েছে। কাজকর্মের প্রকৃতি ও পরিধি অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে শাসন-বিভাগের উপর কাজের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থার মোকাবিলা করা রাজনীতিক শাসকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এই রকম পরিস্থিতিতে শাসন-বিভাগের স্থায়ী পদস্থ কর্মচারীরা নীতি নির্ধারণমূলক কাজকর্মে অনুপ্রবেশের সুযোগ পান এবং অনুপ্রবেশ করেন। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The sheer volume of rules to be enforced, resources to be gathered and information to be processed and transmitted requires the rule-making structure.”

(২) শাসন-বিভাগের রাজনীতিক পদাধিকারীরা সরকারী সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি নন। প্রশাসনিক বিষয়ে পারদর্শিতার জন্য তাঁরা নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন, এমন নয়। এই অবস্থায় এককভাবে ব্যক্তিগত বুদ্ধি-বিবেচনার ভিত্তিতে সরকারী সকল বিষয়ে নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পর্কিত যাবতীয় খসড়া তৈরি করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, চ্যান্সেলার প্রভৃতি রাজনীতিক পদাধিকারীদের কেউই বিশেষজ্ঞ প্রশাসক নন। দেশের রাজনীতিবিদরাই এই সমস্ত পদে আসীন হন। তাঁদের কাছে প্রশাসনকি বিষয়ে বিশেষজ্ঞের জ্ঞান ও পারদর্শিতা আশা করা যায় না। তবে ব্যতিক্রম হিসাবে কোন কোন রাজনীতিবিদের প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও পারদর্শিতা থাকতে পারে। অপরদিকে শাসন-বিভাগের স্থায়ী কর্মচারীরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্যের ভিত্তিতে নৈপুণ্যের নিরীখে নিযুক্ত হন। তারপর তাঁদের জন্য বিশেষ প্রশাসনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। স্বভাবতই প্রশাসনিক বিষয়ে নীতি নির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ত্রুটিমুক্ত খসড়া প্রস্তুত করার ব্যাপারে তাঁদের স্বাভাবিক দক্ষতার সৃষ্টি হয়। তাঁরা বিভিন্ন প্রশাসনিক কলাকৌশলের অধিকারী হন। এই সমস্ত কারণের জন্য শাসন-বিভাগের রাজনীতিক কর্তাব্যক্তিদের প্রশাসনের স্থায়ী পদস্থ কর্মচারীদের উপর নির্ভর না করে উপায় থাকে না। এবং তার স্বাভাবিক ফল হিসাবে শাসন-বিভাগের রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক অংশের মধ্যে ক্ষমতা ও ভূমিকার সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যায়।

(৩) সরকারের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যাদির মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রশাসনের স্থায়ী উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। কারণ শাসন-বিভাগের রাজনীতিক পদাধিকারীদের কার্যকালের নিরবচ্ছিন্নতা থাকে না। তার ফলে সরকারী ক্ষমতা ব্যবহারের একচেটিয়া ক্ষমতা করায়ত্ত করার সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হন। তা ছাড়া অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতার পরিপ্রেক্ষিতেও রাজনীতিবিদরা আমলাদের সঙ্গে প্রচ্ছন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাস্ত হন। কার্যকালের ধারাবাহিকতার জন্য প্রশাসনের স্থায়ী ও পদস্থ কর্মচারীরাই দীর্ঘকালীন সমস্যাদির সমাধান সম্পর্কিত সরকারী উদ্যোগকে অব্যাহত রাখেন। এবং স্বভাবতই সরকারী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অ-রাজনীতিক প্রশাসকদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৪) এখনকার সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে বহু আইন প্রণয়ন করতে হয়। আধুনিক আইনের প্রকৃতি ও পদ্ধতি জটিল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের অ-রাজনীতিক অংশের উপর রাজনীতিক পদাধিকারীদের নির্ভরশীলতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া আধুনিক কালের শাসনব্যবস্থায় অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন (delegated legislation)-এর প্রচলন বেড়েছে। এই কারণেও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

(৫) আধুনিক-রাজনীতিক ব্যবস্থার সামর্থ্য বৃদ্ধি ও সাফল্যের স্বার্থে আইন ও প্রশাসন ব্যবস্থায় এক উন্নত পরিকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এই প্রয়োজন অ-রাজনীতিক প্রশাসনই পূরণ করতে পারে। আমলারা উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নৈপুণ্যকে নিশ্চিত করে সরকারের উপর জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি করে। প্রশাসনের স্থায়ী উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সরকারী কাজকর্মে বিচক্ষণতা, বিশেষজ্ঞতা, পারদর্শিতা, দায়িত্বশীলতা প্রভৃতির সমাবেশকে সুনিশ্চিত করে।