রাজনীতিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে ধারণার বাখ্যা বাঞ্ছনীয়
শাসন-বিভাগের প্রধান’ কথাটি বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু এ প্রসঙ্গে ধারণাগত সমস্যা আছে। শাসন-বিভাগের প্রধানকে কোথাও রাষ্ট্রপতি, কোথাও প্রধানমন্ত্রী, আবার কোথাও চ্যান্সেলার বলা হয়। কিন্তু এই সমস্ত পদাধিকারীরা দেশ-কাল নির্বিশেষে বিভিন্ন ধারণার দ্যোতক নন। বল বলেছেন: “Terminology presents certain difficulties in discussing chief executives. The terms prime ministers’, ‘chancellor’ and ‘president’ mean different things in different political structures.” এই সমস্ত পদাধিকারীর ক্ষমতা, ভূমিকা, মর্যাদা প্রভৃতি ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পার্থক্য বর্তমান। মার্কিনী, ভারতীয় ও ফরাসী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা অভিন্ন নয়। আবার চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে স্বীকৃত ফরাসী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার থেকে পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধান স্বীকৃত ফরাসী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অনেক বেশী। অর্থাৎ সকল রাজনীতিক কাঠামোতে শাসন-বিভাগের প্রধানরা অভিন্ন ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী নন। এই সমস্ত পদাধিকারীদের ক্ষমতা ও প্রভাব বিভিন্ন রাজনীতিক কাঠামোতে বিভিন্ন রকমের হয়। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ভারতের শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পদ বর্তমান। কিন্তু এই সমস্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীরা সাংবিধানিক ও রাজনীতিক বিচারে অভিন্ন অবস্থায় অবস্থিত নন। তাঁদের মধ্যে ক্ষমতা ও পদমর্যাদাগত পার্থক্যের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। আবার ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ (Head of the State) ও ‘শাসক প্রধান’ (Head of the Government) শব্দ দুটিও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। কোথাও এই দুটি পদের মধ্যে পার্থক্য আছে। আবার কোথাও এই পার্থক্য নেই। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় এই দুটি শব্দের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। মার্কিন রাষ্ট্রপতিই হলেন একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসক-প্রধান। কিন্তু যেখানে এই দুটি পদের মধ্যে পার্থক্য আছে, সেখানে রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকা হল নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। এখানে সরকারের প্রধান হিসাবে অন্য একজন থাকেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে যথাক্রমে ব্রিটেনের রাজা বা রানী এবং প্রধানমন্ত্রীর কথা বলা যায়। এ রকম ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের থেকে শাসকপ্রধান অনেক বেশী কার্যকর বা অর্থবহ ক্ষমতার অধিকারী। বিভিন্ন রাজনীতিক কাঠামোতে আনুষ্ঠানিক প্রধান ও রাজনীতিক প্রধানের মধ্যে ভূমিকা ও মর্যাদাগত পার্থক্য বর্তমান থাকে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেও এই পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
পশ্চিমী উদারনীতিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাগুলিতে দু’ধরনের শাসন-বিভাগের প্রধানের পরিচয় পাওয়া যায়। শাসন-বিভাগেরও এই দু’ধরনের প্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি-শাসিত এবং মন্ত্রিসভা শাসিত শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শাসন-বিভাগের প্রধান পদে এই পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান
মার্কিন শাসনব্যবস্থা হল রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। মার্কিন রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রের প্রধান এবং শাসন-বিভাগেরও প্রধান। তিনিই হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান এবং প্রকৃত প্রশাসনিক প্রধান। মার্কিন রাষ্ট্রপতি গ্রেট ব্রিটেনর রাজা বা রানীর আনুষ্ঠানিক মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রকৃত ক্ষমতারও অধিকারী। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের নীতি প্রযুক্ত হয়েছে। এই কারণে রাষ্ট্রপতি মার্কিন কংগ্রেসের অংশ নন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস ও রাষ্ট্রপতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নির্বাচনী সংস্থার দ্বারা পৃথকভাবে নির্বাচিত হন। এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের কাছে দায়িত্বশীল নন। তাঁকে কংগ্রেসের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। রাষ্ট্রপতি যে দলের সদস্য কংগ্রেসে সেই রাজনীতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও থাকতে পারে। তবে রাষ্ট্রপতির দলের সদস্যরা যদি কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকেন তা হলে মার্কিন রাষ্ট্রপতির পক্ষে তাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পরিধিকে প্রসারিত করতে সুবিধা হয়। উল্লেখ করা দরকার যে মার্কিন সিনেট অর্থ, নিয়োগ, আন্তর্জাতিক সন্ধি বা চুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে নিরঙ্কুশ ও একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী। তবে প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে সুবিধার স্বার্থে তিনি প্রয়োজনীয় সংখ্যক সচিব নিযুক্ত করেন। এই সচিবদের নিয়েই গঠিত হয় তাঁর মন্ত্রিসভা। এই মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতির কাছেই দায়িত্বশীল থাকে। সাধারণত তাঁর দলীয় সদস্যদের ভিতর থেকেই তিনি তাঁর সচিবদের নিযুক্ত করে থাকেন। বর্তমানে এই সচিবদের উপর মার্কিন রাষ্ট্রপতির নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
শাসন-বিভাগের প্রধানের ক্ষমতা বৃদ্ধি
সাম্প্রতিককালে শাসন-বিভাগের প্রধানদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার এক সাধারণ প্রবণতার কথা বলা হয়। এই ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণসমূহ সবসময় সংবিধানের মধ্যে থাকে না। কোন দেশের সংবিধান এবং বাস্তব অবস্থা সব সময় অভিন্ন পথে অগ্রসর হয় না। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সংবিধানকে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলতে হয়। বর্তমানে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হলেন প্রভূত ক্ষমতাশালী। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু কেবল মার্কিন সংবিধান তাঁর যাবতীয় ক্ষমতার একমাত্র উৎস নয়। সংবিধান স্বীকৃত ক্ষমতার বাইরেও তিনি বহু ও বিভিন্ন ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসাবে কতকগুলি বিষয়ের কথা বলা হয়। এগুলি হল: পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের সহায়ক সিদ্ধান্তসমূহ, মার্কিন সংবিধানের উদারনীতিক ব্যাখ্যা প্রভৃতি।
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীই প্রকৃত প্রশাসনিক প্রধান
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় শাসন-বিভাগের প্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি অথবা রাজা বা রানী। কিন্তু এখানে তাঁর ভূমিকা নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। তিনি রাজত্ব করেন, শাসন করেন না। এককভাবে তিনি কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীই হলেন প্রকৃত ক্ষমতার প্রয়োগকর্তা। প্রধানমন্ত্রীই হলেন শাসন বিভাগের প্রকৃত প্রধান। আইনসভার সাধারণ সদস্য হিসাবে তিনি নির্বাচিত হন। তারপর সংখাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী মার্কিন রাষ্ট্রপতির মত পৃথক কোন পদ্ধতিতে নির্বাচিত হন না। তবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির মতই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল আইনসভার উপর প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ। আইনসভার উপর রাষ্ট্রপতির এই নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় থাকে না।
ব্রিটিশ ব্যবস্থার উদাহরণ
গ্রেট ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা হল সংসদীয় শাসনব্যবস্থার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে রাজা বা রানী হলেন শাসন-বিভাগের নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব প্রধান। তাঁর ভূমিকা আনুষ্ঠানিক। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে তাঁকে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। এবং কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করতে হয়। এও রাজা বা রানীর একরকম আনুষ্ঠানিক কাজ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার দ্বারাই ব্রিটিশ সরকারের নীতি নির্ধারিত ও প্রযুক্ত হয়। এই মন্ত্রিসভাকে কমন্সসভার কাছে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থার উপর প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার ক্ষমতাসীন থাকার বিষয়টি নির্ভরশীল।
একাধিক ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত ক্ষমতা
শাসন-বিভাগের প্রধানের ক্ষমতা সাধারণত একজন ব্যক্তির হাতেই ন্যস্ত থাকে। যেমন, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে এই ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। তবে একাধিক ব্যক্তির হাতেও শাসন-বিভাগের প্রধানের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকতে পারে। বল তাঁর Modern Politics and Government: “Chief executive powers may not be vested in one person, but dispersed between two or more individuals.” বাস্তবে তেমন নজিরও আছে। সুইজারল্যাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ (federal council) আছে। ঐ দেশের শাসন-বিভাগীয় প্রধানের ক্ষমতা এই পরিষদের হাতে যৌথভাবে ন্যস্ত আছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ যৌথ দায়িত্ব সহকারে শাসনকার্য পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের সাতজন সদস্য চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে। সদস্যরা বিভিন্ন দল থেকে নির্বাচিত হন। আবার গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ (State Council)-ও শাসন ক্ষমতা যৌথভাবে প্রয়োগ করে থাকেন।
স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা
শাসন-বিভাগের প্রধানের বিষয়টি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভ্রান্তিকর। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজা বা রাষ্ট্রপতি শাসনকার্য পরিচালনার সমগ্র বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় বংশানুক্রমিক রাজা বা রাষ্ট্রপতিই হলেন রাষ্ট্রের শাসকপ্রধান। স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পদও পরিলক্ষিত হয়। তবে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এঁদের তুলনা চলে না। জর্ডন ও সৌদি আরবে এই ধরনের শাসনব্যবস্থা বর্তমান। এই দু’টি দেশে শাসন-বিভাগের প্রধানের পদে আসীন হন উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। জর্ডনে প্রধানমন্ত্রীর পদ বর্তমান। ইরানে শাহ-র আমলে প্রধানমন্ত্রীর পদ বর্তমান ছিল।
সামরিক শাসন
সামরিক শাসনে শাসন-বিভাগের প্রধান হলেন সামরিক চক্রের অধিনায়ক। সামরিক চক্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু কালক্রমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পর্তুগালে সামরিক চক্রের ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তী কালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা যায়।
Leave a comment