শাসন-বিভাগের প্রধানের আলংকারিক ক্ষমতা গুরুত্বহীন:
সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর সর্বত্র রাজনীতিক পরিবেশের গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের পিছনে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুবিধ কারণ বর্তমান। পরিবর্তিত রাজনীতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে শাসন-বিভাগের প্রধানের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পরিধি বিশেষভাবে প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে স্বরাষ্ট্র বা পররাষ্ট্র সংক্রান্ত এমন কোন বিষয় নেই যা দেশের শাসকপ্রধানের এক্তিয়ারের অন্তর্ভুক্ত নয়। সকল দেশের শাসন-বিভাগের রাজনীতিক প্রধানের কতকগুলি আনুষ্ঠানিক বা আলংকারিক কার্যাবলী ও ক্ষমতা (formal or ceremonial functions and powers) থাকে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ব্যাপক নিয়োগ ও অপসারণ সম্পর্কিত ক্ষমতা, আইনসভার অধিবেশন আহ্বান, দণ্ডিত ব্যক্তির দণ্ডহ্রাস বা মুকুব, উপাধি ও খেতাব বণ্টন, অন্য রাষ্ট্রের কূটনীতিক প্রতিনিধিদের গ্রহণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই সমস্ত আনুষ্ঠানিক ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে শাসন-বিভাগের প্রধানের রাজনীতিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্ধারণ করা যায় না। অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে এগুলি শাসকপ্রধানের প্রকৃত বা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা নয়। এ সব ছাড়াও শাসকপ্রধানের ফলপ্রসূ ও তাৎপর্যপূর্ণ বহু ও বিভিন্ন ক্ষমতা আছে। সেই সমস্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলীর উপর শাসকপ্রধানের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সাংবিধানিক মর্যাদা নির্ভরশীল।
শাসন-বিভাগের প্রধানের নীতি নির্ধারণ:
সকল রাষ্ট্রের শাসন-বিভাগের প্রধান বর্তমানে দেশের সামগ্রিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সরকারের নির্দিষ্ট কর্মসূচী শাসন-বিভাগ গ্রহণ করে। এই কর্মসূচীকে কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আবশ্যক। সরকারকেই বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে শাসকপ্রধানই সরকারকে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। বল শাসকপ্রধানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা ও কার্যাবলীর পরিবর্তে সরকারের নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানমূলক ভূমিকার গুরুত্বের কথা বলেছেন। Modern Politics ans Government শীর্ষক গ্রন্থে তিনি বলেছেন: “Putting on one side the ceremonial functions of the formal head of state or the formal functions of the political executive, the most important function of the chief political executive is that of providing policy-making leadership to the government,…” আধুনিক জীবনযাত্রায় বিভিন্ন বিষয়ে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বর্তমানে শাসকপ্রধানকেই চূড়ান্তভাবে দায়বদ্ধ থাকতে হয় এবং দায়িত্ব পালন করতে হয়। আইন প্রণয়ন, প্রশাসন পরিচালনা, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বিষয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে একই কথা সমভাবে প্রযোজ্য। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এখন মূল উদ্যোগ আয়োজন শাসক প্রধানকেই গ্রহণ করতে হয়। আধুনিক আইনসভার উপর শাসকপ্রধানের কর্তৃত্ব কায়েম হতে দেখা যায়। আইনসভার অধিবেশন সম্পর্কিত ক্ষমতা, নির্দিষ্ট কার্যকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই আইনসভাকে বাতিল করার ক্ষমতা, আইনসভায় পাস হওয়া বিলে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা, পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনের ক্ষমতা প্রভৃতি এ ক্ষেত্রে শাসকপ্রধানকে সাহায্য করে।
শাসকপ্রধানের দায়িত্ব বৃদ্ধি, আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং শাসকপ্রধানের সমন্বয় সাধনমূলক ভূমিকা:
বর্তমানে শাসকপ্রধানের দায়-দায়িত্বের পরিধি প্রসারিত হয়েছে এবং কার্যাবলীর প্রকৃতি জটিল হয়েছে। কারণ সাবেককালের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগ এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভৃতি কাজকর্মের মধ্যে শাসকপ্রধানের দায়-দায়িত্ব সীমাবদ্ধ নয়। এখন দেশবাসীর বহু ও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পুরণের ব্যাপারে শাসকপ্রধানকে উদ্যোগী হতে হয়। এবং এই কারণে তাঁকে এখন জাতীয় অর্থনীতি পরিচালনা এবং সামাজিক কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এইভাবে নতুন নতুন বিষয় ও সমস্যাদি সংযুক্ত হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের পন্থা-পদ্ধতির প্রকৃতি অধিকতর জটিল হয়েছে। এই অবস্থায় শাসকপ্রধানের কাজকর্ম ও দায়-দায়িত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বল বলেছেন: “The traditional areas of executive action, such as foreign policy, defence and internal policing, have been joined by the crucial roles modern governments play in the management of the economy and in attempting to satisfy demands for social welfare.” শাসকপ্রধানের দায়-দায়িত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের পন্থা-পদ্ধতি জটিল ও ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। এই অবস্থায় অনিবার্যভাবে আমলাতন্ত্রের এক্তিয়ার ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্তুত বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কার্যাবলী ও দায়িত্বের ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষেত্রবিশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সরকারের অন্যান্য পদাধিকারী ও সংস্থার হাতে ন্যস্ত করা ছাড়া শাসকপ্রধানের অন্য কোন উপায় থাকে না। অর্থাৎ শাসন-বিভাগের কার্যাবলীকে বর্তমানে বিকেন্দ্রীভূত করা হয়। এবং এই অবস্থায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কাজকর্ম ও সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন অত্যন্ত জরুরী। শাসন-বিভাগের রাজনীতিক প্রধানকে এখন এই সমন্বয় সাধনমূলক দায়িত্ব পালন করতে হয়। বল বলেছেন: “It is these additional functions that have added to the complex nature of the decision-making process and increased the size of modern bureaucratic, with the political executive having to ensure coordination throughout the whole government machine.”
আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা ও যুদ্ধের সামগ্রিকতা:
বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে। আধুনিক সরকারের এক্তিয়ার সম্প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার এই পরিবর্তনের আংশিক প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। তবে বিংশ শতাব্দীতে অধিকাংশ রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে আধুনিক যুদ্ধের সামগ্রিকতা বা সর্বব্যাপকতা। বল বলেছেন: “…a significant factor in the twentieth century is major political systems has been the totality of modern wars.” এ প্রসঙ্গে বল টেলরকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন: “As A.J.P. Taylor has pointed out: Until August 1914 a sensible law abiding English man could pass through life and hardly notice the existence of the state beyond the post office and the policeman.”
রাষ্ট্রপতি-শাসিত ও মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে পার্থক্য:
রাজনীতিক ব্যবস্থার পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে শাসকপ্রধানের ক্ষমতার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রপতি-শাসিত এবং মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত শাসনব্যবস্থায় নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে পদ্ধতি ও মূল দায়িত্বের তারতম্য আছে। রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের এই সমস্ত ক্ষেত্রে মূল ক্ষমতা আইনত রাষ্ট্রপতির হাতেই ন্যস্ত আছে। তবে রাষ্ট্রপতি ব্যক্তিগতভাবে নয়, তাঁর ব্যক্তিগত সচিবদের সহায়তায় তিনি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির কথা বলা যায়। আনুষ্ঠানিক ও বাস্তব বিচারে মার্কিন সরকারের প্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি। সরকার পরিচালনার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত আছে। সরকারী নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া তিনি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু নীতি প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষজ্ঞ সচিবদের নিয়ে গঠিত ক্যাবিনেট ও ব্যক্তিগত উপদেষ্টাদের সাহায্য গ্রহণ করেন। অপরদিকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসন-বিভাগের সাংবিধানিক প্রধানের ভূমিকা আনুষ্ঠানিক বা নিয়মতান্ত্রিক। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাই হল কেন্দ্রীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ। সরকারের নীতি নির্ধারণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্যাবিনেটের সাহায্যে প্রধানমন্ত্রীই কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে গ্রেট ব্রিটেন ও ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার কথা বলা যায়। তবে সাম্প্রতিককালে উভয় দেশেই প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক প্রবল প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেট ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থাকে অনেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসনব্যবস্থা হিসাবে অভিহিত করার পক্ষপাতী। ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এই প্রবণতাকে জোহারী ‘প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের রাষ্ট্রপতিকরণ’ (Presidentialisation of Prime Minister’s Office) বলে অভিহিত করেছেন।
পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে শাসকপ্রধানের ভূমিকা:
সাম্প্রতিককালে শাসন-বিভাগের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ। পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শাসন-বিভাগের প্রধানের ভূমিকা সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ। বল বলেছেন: “One area in which the chief executive is most active is that of foreign policy.” বর্তমানে বিদেশ নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে শাসন-বিভাগের প্রধান অতিমাত্রায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সাধারণভাবে বিদেশ দপ্তরের দায়িত্ব কোন বা কতিপয় সচিব বা কূটনীতিবিদদের হাতে ন্যস্ত থাকে। কিন্তু শাসন-বিভাগের প্রধানই দেশ বিদেশে পররাষ্ট্র নীতির মুখ্য প্রবক্তা হিসাবে সর্বাধিক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের বিষয়টি বর্তমানে নানা কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখন ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ শিবিরের অস্তিত্ব বর্তমান। এদের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রসারের প্রচেষ্টাও বর্তমান। তার ফলে বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়টি বর্তমানে অত্যন্ত জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া স্বরাষ্ট্র য়টিকে পররাষ্ট্র বিষয় থেকে সম্পূর্ণ। করা যায় না। পররাষ্ট্র নীতির সাফল্য স্বরাষ্ট্র নীতির সাফল্যের সহায়ক হয়। এই কারণে উভয় বিষয়ের সঙ্গে পারস্পরিক গভীর যোগাযোগ বর্তমান থাকে। আবার পররাষ্ট্র নীতির সাফল্যের স্বার্থে গোপনীয়তা এবং দ্রুততা দরকার। এই সমস্ত কারণের জন্য শাসকপ্রধানকেই এই দায়িত্ব গ্রহণ ও পালন করতে হয়। অন্যথায় দেশের স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার আশংকা থাকে। তাই পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে শাসকপ্রধানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিষয়টির তাৎপর্য পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে বল কিউবা সংকটের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: “The Cuban missile crisis of 1962 is an illustration of the speed of response and personal decision-making by Kennedy and Khrushchev.” এই সময় মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডি তাঁর ক্যাবিনেট বা ব্যক্তিগত উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ পাননি। পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখা এবং সত্বর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য এ ক্ষেত্রে শাসন-বিভাগের প্রধানের ভূমিকা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বল আরও বলেছেন: “The power of the American president in 1962, or in relation to the Vietnam war, can be paralleled in parliamentary systems by the power of the British prime minister during the Suez crisis of 1956.” প্রকৃত প্রস্তাবে শাসকপ্রধানই হলেন দেশের বিদেশ নীতির মুখ্য রূপকার। তবে সরকারের স্বতন্ত্র একটি পররাষ্ট্র মন্ত্রক আছে। তার জন্য আলাদা মন্ত্রী ও সচিব আছেন। এতদ্সত্ত্বেও শাসকপ্রধানকেই দেশে-বিদেশে পররাষ্ট্র নীতির প্রধান প্রবক্তা হিসাবে মূল দায়িত্ব পালন করতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে শাসকপ্রধানই দেশের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।
জরুরী অবস্থায় শাসকপ্রধানের ক্ষমতা:
বর্তমানে জটিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের সংকটের আশংকাকে অস্বীকার করা যায় না। এই সমস্ত সম্ভাব্য সংকটের দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। শাসন-বিভাগের প্রধান জরুরী অবস্থা জারী করতে পারেন এবং জরুরী অবস্থা বলবৎ থাকাকালীন সময়ে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। দেশের শাসন-বিভাগই জরুরী অবস্থার সংজ্ঞা নির্দেশ করে। এবং দেশে জরুরী অবস্থার উদ্ভব হয়েছে কিনা তাও নির্দেশ করে শাসন-বিভাগ। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government গ্রন্থে বলেছেন: “A significant area of chief executive responsibility is that which demands emergency action in the constitutional sense. All modern executives have developed a degree of freedom in defining emergencies and an increase of power to deal with them.” ভারতের সংবিধানের ৩৫২ থেকে ৩৬০ ধারার মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। তবে ভারতের রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা অবাধ বা স্বৈরাচারমূলক নয়। ১৯৭৮ সালের ৪৪ তম সংবিধান সংশোধনী আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতির নামে ভারতের প্রধানমন্ত্রীই জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। কানাডা, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সংবিধানেও শাসন-বিভাগকে জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। হেমার (Weimar) সংবিধান অনুসারে জার্মান রাষ্ট্রপতিও অনুরূপ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। গ্রেট ব্রিটেনে ১৯৪০ সালে জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত আইনে শাসন-বিভাগের জন্য বিশেষ ক্ষমতার ব্যবস্থা করা হয়। বল বলেছেন: “The British government was granted dictatorial powers by the Emergency powers Act of 1940… and gave unlimited power in practice to the government over citizens and their property. ” ফ্রান্সের পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের (১৯৫৮) ১৬ ধারায় সংকটকালীন সময়ে ফরাসী রাষ্ট্রপতিকে পর্যাপ্ত জরুরী ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “This article could institute a period of presidential dictatorship, and is similar to the clause in the German Weimar constitution which allowed the president to abrogate civil rights and pass legislation by decree.”
উপসংহার: সাম্প্রতিককালে শাসন-বিভাগের রাজনীতিক প্রধানের ক্ষমতা ও কার্যাবলীর পরিধি বিশেষভাবে প্রসারিত হয়েছে। শাসকপ্রধানকে এখন বহু ও বিভিন্ন কার্যাবলী সম্পাদন করতে হয়। আধুনিক কালের অধিকাংশ শাসনব্যবস্থায় আইন-বিভাগের থেকে শাসন-বিভাগের ক্ষমতা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থা সৃষ্টির পিছনে কারণ হিসাবে কতকগুলি বিষয়ের উল্লেখ আবশ্যক। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অস্বাভাবিক অগ্রগতি ঘটেছে। আণবিক অস্ত্রের ক্রমসম্প্রসারণ রোধ করা যায়নি। ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যে অশুভ প্রতিযোগিতার অকাম্য অবস্থার অবসান ঘটেনি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা সতত বর্তমান। আধুনিক যুদ্ধের সর্বাত্মক ও ভয়াবহ পরিণতির আশংকা ও আতঙ্ক কাটিয়ে উঠা যায়নি। আবার আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও আর্থ-সামাজিক জটিলতা ক্রমবর্ধমান। এই সমস্ত কিছুর সামগ্রিক ফলশ্রুতি হিসাবে সকল দেশেই শাসন-বিভাগের প্রধানের ক্ষমতার পরিধি অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত হয়েছে।
Leave a comment