সংকীর্ণ অর্থে ‘গণতন্ত্র’ বলতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকেই বোঝায়। এই শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। সরকারের শ্রেণীবিভাগ প্রসঙ্গে যখন গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, তখন এই গণতান্ত্রিক সরকার বা শাসনব্যবস্থাই প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়।

লিঙ্কনের সংজ্ঞা ও তার ব্যাখ্যা:

ব্যুৎপত্তিগত অর্থে জনগণের শাসনকেই গণতন্ত্র বলে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা বহুল প্রচলিত। তিনি বলেছেন: গণতন্ত্র হল “জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন’ (“Government of the people, by the people and for the people……”)। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে লিঙ্কনের সংজ্ঞাটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। যাইহোক লিঙ্কনের বিখ্যাত সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, (১) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হল জনগণের কল্যাণের জন্য (of the people)। এই শাসনব্যবস্থার সঙ্গে জনগণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান থাকে। সুইজির মতানুসারে এই শাসনব্যবস্থার উৎস হল জনগণ এবং জনগণ ও সরকার অঙ্গাঙ্গিভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। (২) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জনগণের দ্বারা পরিচালিত (by the people)। সিলী প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতানুসারে যে শাসনব্যবস্থায় সকলেই অংশগ্রহণ করে তা হল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। তাঁর কথায়: “A government in which everybody has a share.” মিল (John Stuart Mill)-এর মতে এ হল রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে সকলের অধিকার। তিনি বলেছেন: “Admission of all to a share of the sovereign power of the state.”)। (৩) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হল জনগণের জন্য (for the people)। গণতান্ত্রিক সরকার কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য নয়, সর্বসাধারণের স্বার্থে পরিচালিত হয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন:

তত্ত্বগতভাবে গণতন্ত্র বলতে জনগণের শাসনকে বোঝায়। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর কোন দেশেই জনগণের সকলে শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে না বা করতে পারে না। বৃহদায়তন ও জনবহুল রাষ্ট্রগুলিতে তা সম্ভব নয়। তাই প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটেছে। এখন বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিনিধিমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে তাই গণতন্ত্র বলতে এই প্রতিনিধিমূলক পরোক্ষ গণতন্ত্রকেই বোঝায়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শাসনকার্য পরিচালনা করে। আবার কার্যক্ষেত্রে সকল দেশেই নাবালক, উন্মাদ, সমাজদ্রোহী প্রভৃতি ব্যক্তিকে ভোটাধিকার বা রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। সেই জন্য লর্ড ব্রাইসের মতানুসারে গণতন্ত্র কার্যক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। তিনি বলেছেন: “A Government in which the will of the majority of qualified citizens rules.” ডাইসি-ও অনুরূপ অভিমত পোষণ করেন। তাঁর মতানুসারে জনগণের গরিষ্ঠ অংশ শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করলে তা হল গণতন্ত্র (“A form of Government in which the governing body is a comparatively large fraction of the nation.”)। র‍্যাফেল (D. D. Raphael) মন্তব্য করেছেন: “Democracy in practice has to mean following the view of the majority.”

গরিষ্ঠ দলের শাসন: আবার যে সকল প্রতিনিধি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন তাঁরা সকলেই শাসনকার্য পরিচালনা করেন না। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের প্রতিনিধিরাই সরকার পরিচালনা করেন। সংখ্যালঘিষ্ঠ দলগুলি শাসনকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তারা কেবল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। সুতরাং গণতন্ত্র চূড়ান্তভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসনে পরিণত হয়। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আবার নির্বাচকমণ্ডলীর অধিকাংশের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে, তেমন কোন নিশ্চয়তা থাকে না। নির্বাচনকেন্দ্রগুলিতে বহুসংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তা ভোটদাতার অধিকাংশের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। ভোটদাতার অধিকাংশের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকারকে প্রকৃত গণতন্ত্র বলা যায় না। কারণ তা সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধিপুষ্ট সরকার ব্যতীত কিছু নয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ অবহেলিত হয় না: এ প্রসঙ্গে লর্ড ব্রাইসের মত উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতানুসারে গণতন্ত্র হল নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের শাসন। কিন্তু মোট জনসংখ্যার অধিকাংশের ভোটাধিকার থাকা আবশ্যক। তা না হলে গণতন্ত্র সংখ্যালঘিষ্ঠের শাসনে পরিণত হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলেও গণতান্ত্রিক সরকার সর্বসাধারণের মঙ্গলার্থে পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশের মতামতকেও যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিচার-বিবেচনা করা হয় এবং তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকার সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর ফলে সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশও গণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করে। অর্থাৎ গণতন্ত্রের পিছনে সর্বসাধারণের সমর্থন বর্তমান থাকে। তাই একে ‘ঐকমত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা’ (Government based on consensus) বলা হয়।

জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত: গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর অর্থ, শাসনকার্যে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সকলে সমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। আর গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ভিত্তি হল শাসিতের সম্মতি। পাশবিক শক্তির প্রয়োগ এক্ষেত্রে অস্বীকৃত। এই কারণে একে ‘জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত সরকার’ (Government based on consent) বলে। আবার এই কারণেই একে ‘জনমতের উপর প্রতিষ্ঠিত সরকার’ (Government based on public opinion) বলা হয়।

গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে জনমত-পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। গণতান্ত্রিক সরকার জনমতকে বিশেষ মূল্য দেয়। কারণ জনসাধারণের অভিমত-অভিপ্রায়, আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি জনমতের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়। তাই সরকার জনমতকে উপেক্ষা করতে পারে না।

প্রকৃত প্রস্তাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূল কথা হল এই যে শাসন ক্ষমতার উপর জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বর্তমান থাকে। এই ব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতার উৎস হল জনগণ। জে. এস. মিল (John Stuart Mill) বলেছেন: “The whole people or numerous portion of them exercise the governing power through deputies periodically elected by themselves.” গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এই প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে এর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা দরকার।

(১) প্রতিনিধিমূলক সরকার: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে বর্তমানে প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রকে বোঝায়। রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সর্বসাধারণের সরাসরি শাসন এখন অসম্ভব। এই কারণে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিমূলক (indirect or representative) গণতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে।

(২) প্রতিনিধি নির্বাচন: এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে না। নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণ সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। এই জনপ্রতিনিধিরাই শাসনকার্য পরিচালনা করেন। জনগণ এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে।

(৩) সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন: গণতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশের সকল মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে না। সকল দেশেই নাবালক, উন্মাদ, দেউলিয়া, সমাজদ্রোহী প্রভৃতি ব্যক্তিদের ভোটাধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়। তা ছাড়া যে সকল প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তাঁদের সকলেই শাসনকার্য পরিচালনা করেন না। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের নিয়ে সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয়। সুতরাং গণতন্ত্র জনগণের সমগ্র অংশের নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের শাসন মাত্র।

(৪) সর্বসাধারণের স্বার্থে পরিচালিত: গণতন্ত্রে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর ন্যস্ত থাকে। কিন্তু শাসনকার্য কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থেই নয়, সর্বসাধারণের কল্যাণ সাধনের জন্য পরিচালিত হয়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত ও স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

(৫) জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত: দেশবাসীর সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশও গণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করে। অর্থাৎ জনগণের সমগ্র অংশ একে সমর্থন করে। কারণ সর্বসাধারণের স্বার্থে এই সরকার পরিচালিত হয়। এই কারণে একে জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত সরকার (Government based on consent) বলে।

(৬) জনমতের গুরুত্ব: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জনমতের উপর প্রতিষ্ঠিত। জনমত হল গণতন্ত্রের প্রাণ। গণতন্ত্রে জনমতকে উপেক্ষা করা যায় না। জনমতের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

(৭) গণসার্বভৌমত্ব: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে।

(৮) রাষ্ট্রনৈতিক সাম্য: রাষ্ট্রনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রনৈতিক সাম্য বলতে শাসনকার্যে সকলের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ-সুবিধাকে বোঝায়। নির্বাচন করা বা নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে সকলে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এখানে জন্মগত বা ধনগত বৈষম্যকে স্বীকার করা হয় না। এবং বলপ্রয়োগকে অস্বীকার করা হয়। রাষ্ট্রের দিক থেকে সকলেই সম-মর্যাদা ও সমানাধিকার সম্পন্ন।

(৯) দলব্যবস্থা: দল-ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রে সুষ্ঠুভাবে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য দলপ্রথার অস্তিত্ব অপরিহার্য বিবেচিত হয়। নির্বাচন যদি দলপ্রথার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত না হয় তা হলে জনসাধারণের পক্ষে প্রতিনিধি বাছাই করতে অসুবিধা হয়। দলীয় ভিত্তিতে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে নাগরিকগণ বিভিন্ন দলের আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে পছন্দমত দলীয় প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে। তারপর যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলই সরকার গঠন ও পরিচালনা করে। এইভাবে গঠিত সরকার স্থায়ী হয়।

গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে বক্তব্য ও মতামত অনত্ত। এ বিষয়ে সংশয়-সন্দেহ ও অবিশ্বাসের অভাব নেই। স্বভাবতই রাজনীতি বিজ্ঞানে গণতন্ত্র সম্পর্কে বিবিধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বর্তমান।