‘গ্রন্থ যাবে গড়াগড়ি গানে হব ব্যস্ত’—উক্তিটি বিদ্যাসুন্দরের রচয়িতা রামপ্রসাদ সেনের। তাঁর শাক্ত পদে গ্রন্থলব্ধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দূর হয়ে যায়। রামপ্রসাদ রূপক প্রতীকের আড়ালে বিশ্ব জননীকে লুকিয়ে রেখেছেন। আমরা মাতার বরাভয় লাভ করে নির্ভয় হই, অনাবৃত শিশুর বেশে তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সাধক কবি আমাদের জন্য এই আশ্বাস ও সান্ত্বনা তাঁর গানে সঞ্চিত করে রেখেছেন। বাইরের প্রতিকূল শক্তি যত দুর্মদই হোক না কেন, জননী কালিকার স্নেহধন্য আশ্রয় পেলে আমরা যমরাজকে অবহেলা করতে পারি। রামপ্রসাদ অন্ধকারের মধ্যে আশার বর্তিকা জ্বেলেছেন। তিনি শুধু কবি বা গায়কমাত্র নন—মানুষের তাপদগ্ধ জীবনে তিনি স্নেহের প্রলেপ দিয়েছেন। মাতৃতন্ত্রের তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পূজারী। তবে তাঁর পূর্বে বাংলার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের স্থানে স্থানে শাক্ত পদাবলীর আভাস ফুটে উঠলেও রামপ্রসাদের কণ্ঠে শ্যামাসঙ্গীত শতধারায় প্রবাহিত হয়েছে। তাই তাঁকে শাক্ত পদাবলীর প্রথম পূজারী বলে ধরা যায়।

রামপ্রসাদ পদাবলীকে এইভাবে বিভক্ত করা যেতে পারে– ক) উমা বিষয়ক (আগমনী ও বিজয়া) খ) সাধন বিষয়ক (তন্ত্রোক্ত সাধনা) গ) দেবীর স্বরূপ বিষয়ক ঘ) তত্ত্ব দর্শন ও নীতি বিষয়ক ঙ) কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি বিষয়ক ইত্যাদি।

অবশ্য রামপ্রসাদের আগমনী ও বিজয়া গানের সংখ্যা নগণ্য, কাব্যোকর্ষও এমন কিছু প্রশংসার যোগ্য নয়। বৎসরাস্তে উমার হিমাচল ভবনে আগমনে চারিদিকে যখন আনন্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছে তখন কন্যার দারিদ্রের কথা স্মরণ করে গিরিরানী বলেন—

“জনক তোমার গিরি     পতি জনম ভিখারী

তোমা হেন সুকুমারী দিলাম দিগম্বরে।।”

মেনকার এই মনোবেদনা কবি বেশ আন্তরিকভাবেই ফুটিয়েছেন। তবে পরবর্তী কবিসাধক ও গায়কগণ বিশেষত কবিওয়ালাগণ এই পর্যায়ের পদে অধিকতর নিপুণতা দেখিয়েছেন।

রামপ্রসাদ স্বয়ং তন্ত্রসাধক ছিলেন। এই সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন এরূপ জনশ্রুতি আছে। তাঁর গ্রামে এখনো তাঁর সাধন ধামের ধ্বংসাবশেষ লক্ষ্য করা যায়। তন্ত্রোক্ত সাধনা মূলত সাধকের দেহকেন্দ্রিক সাধনা। কবি বহুপদে এই সমস্ত তত্ত্বকথা বলেছেন—

তীর্থ গমন মিথ্যা ভ্রমণ 

মন উচাটন করো না রে। 

ও মন ত্রিবেনীর পাটেতে বেসে 

শীতল হবে অন্তঃপুরে।।

কিংবা

“ইড়া পিঙ্গলা নামা    সুষুম্মা মনোরমা

তাঁর মধ্যে গাঁথা শ্যামা ব্রহ্মসনাতনী ওমা।।”

তিনি যে তান্ত্রিক গ্রন্থ অবলম্বনে ও গুরুনির্দেশে তন্ত্র সাধনা করতেন তার ইঙ্গিত এই সাধন ভজন গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই পথের পথিকদের নিকট তাঁর তাৎপর্য বিশেষ মূল্যবান হলেও সাহিত্যের ইতিহাসে ও কাব্যরস বিচারে এর বিশেষ মূল্য আছে বলে মনে হয় না। কেবল যেখানে সাধ্য সাধনতত্ত্ব কথা কবির ব্যক্তিগত অনুভূতিকে স্পর্শ করেছে সেখানে কিঞিৎ শিল্প রসের উদ্ভদ হয়েছে।

“কালী পদ্মবনে হংস সনে হংসীরূপে করে রমন।

তাঁরে মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন।।”

তখন তা তত্ত্ব কথা হয়েও বিচিত্র রূপরস সৃষ্টিতে সার্থক হয়ে ওঠে।

রাম প্রসাদ তাঁর কোন কোন পদে দেবীর স্বরূপ অন্বেষণ করতে গিয়েছেন। সস্তান যেমন মাকে খুঁজে বেড়ায় তিনিও তেমনি নানাভাবে সন্ধান করেছেন। কবি কখনও কালিকার রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে প্রশ্ন করেছেন—

“ঢলিয়ে ঢলিয়ে কে আসে

গলিত চিকুর আসব আবেশে।”

অসুর যুদ্ধে কালিকার কালো অঙ্গে রাঙা রক্ত লেগেছে। কবি দেখছেন— “কালিন্দীর জলে কিংশুক ভাসে।”—এ বর্ণনা সংযত গম্ভীর এবং বিষয় বস্তুর সম্পূর্ণ উপযুক্ত। শেষ পর্যন্ত কবি বলেছেন— “ব্রষ্মময়ী রে করুণা ময়ী রে বল জননী।” কবি দেখেন সমস্ত ভুবন জুড়ে ক্ষেপা মায়ের খেলা চলছে— “এসব ক্ষেপা মায়ের খেলা।” এই ক্ষেপার খেলায় রামপ্রসাদও যোগ দিয়ে প্রবহমান বিশ্বে ভেলা ভাসিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বসে আছেন। কবি তীর্থ দর্শন কামনা করেন না, কারণ “মায়ের পদতলে পড়ে আছে গয়া-গঙ্গা-বারাণসী।” কাশীধামে মোহমুক্তি হয় কিন্তু কবি তো মোহ মুক্তির অভিলাষী নন। মাতা পুত্রের বাৎসল্য লীলার স্নেহমধুর ভাবই তাঁর কাম্য। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি— “চিনি হওয়া ভাল নয় মা চিনি খেতে ভালো বাসি।” ব্রহ্মময়ীর সাযুজ্য লাভ নয়, তাঁর সঙ্গে লীলরসই তাঁর একান্ত কাম্য।

কবি অবাধ্য অবশ মনকে তত্ত্বের কশাঘাতে শাসন করতে চেয়েছেন। বিষয় রসে আকণ্ঠ মগ্ন পার্থিব মনকে সম্বোধন করে কবি বলেছেন “ও তোর ঘরে চিন্তামনি নিধি দেখিস না রে বসে বসে।” তবে বিষয়াসক্ত মনকে তিনি ভর্ৎসনা করতে ছাড়েননি—

“রইলি না মন আমার বশে।

তাজি কমলদলের অমল মধু মত্ত হলি বিষয় রসে।”

অবশ্য মনের অধোগতির জন্য মনকে দায়ী না করে কবি শ্যামা মায়ের প্রতি অনুযোগ করে বলেন— “তুমি বাজীকরের মেয়ে শ্যামা যেমনি নাচাও তেমনি নাচি।” এমনি করে অশাস্ত দুর্বল মনকে শ্যামা মায়ের চরণে সঁপে দিয়ে কবি নিশ্চিন্ত হয়েছেন। তবে একটু অবহিত হয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে, কবি যে একটি বিশেষ সামাজিক দুর্যোগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা তিনি গোপন করেননি। বিষয় বুদ্ধিতে অপুষ্টিতটার জন্য তাঁর অর্থাভাব কোনদিনই ঘোচেনি। তবু তিনি সান্ত্বনার সুরে বলেছেন— “তুমি এ ভালো করেছো মা আমায় বিষয় দিলে না।” কখনো সংসারের দুঃখে ব্যথিত কবি বলেন— “এই সংসারে সং সাজিতে সার হল গো দুঃখে ভরা।” কখনো বা আর্তনাদ করে বলেন—

“মাগো নিম খাওয়ালে চিনে বলে কথায় কর ছলো

মিঠার লোভে তিত মুখে সারা দিনটা গেল।”

এখন জীবনপ্রান্তে পৌঁছে কবি কি করবেন? “এখন সন্ধ্যা বেলায় ঘরের ছেলে ফিরে চলে।” রামপ্রসাদ বিশ্ব জননীর স্নেহালে ঠাঁই চেয়েছেন। মৃত্যু ভীতিও বিদায় নিয়েছে—“যারে শমন যারে ফিরে।”

রামপ্রসাদের জনপ্রিয়তার একটা কারণ, বাস্তব দুঃখকে তিনি বৈষ্ণব পদাবলীর মতো সূক্ষ্ম রসে পরিণত করেননি। তাকে স্বীকার করে তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। দুঃখ বেদনা থেকে পলায়ন নয়, তার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে নয়— আদ্যাশক্তির কৃপায় কবি সমস্ত সুখ দুঃখ ত্যাগ করে মুক্তির পথ খুঁজেছেন—

“আমি কি দুঃখেরে ডরাই। 

ভরে দাও দুঃখ মা আর কত চাই।।”

কবি দুঃখের আঘাতে আরো নিবিড় করে জননীকে চিনে নিয়েছেন। এই জন্যই দুঃখকে নিয়ে তার এত বড়াই। শ্যামার দেওয়া দুঃখ তাঁকে অগ্নিশুদ্ধ স্বর্ণের মতো বিশুদ্ধি দান করেছে। কবি দেখিয়েছেন, দুঃখ থেকে একমাত্র পরিত্রাণের পথ—শ্যামার চরণে আশ্রয় গ্রহণ। বাঙালি একথায় বড়ো সান্ত্বনা পেয়েছিল। তাই তাঁর গানের মধ্যে দুঃখ বেদনার কথা থাকলেও সেই দুঃখ বেদনা অতিক্রম করে চিদানন্দময়লোকে উত্তরণ কবির একমাত্র লক্ষ্য। সাধারণ গৃহী মানুষ এ থেকে আশার আলো লাভ করেছে, মুমুক্ষু এ থেকে মোক্ষের প্রাথর্না লাভ করেছে, লীলা রসিক এই সমস্ত গানে মাতা পুত্রের বাৎসল্যরসের সম্পর্ক দেখে তৃপ্তি লাভ করে করেছে। এই জন্য বাঙালি জাতির হৃদয়ের সঙ্গে রামপ্রসাদের পদাবলী জড়িয়ে গেছে।

রাম প্রসাদের রচনারীতি সম্পর্কে বলা যায় যে, তাঁর বিভিন্ন পদের অনেক স্থলে অলঙ্কৃত বাকীতি থাকলেও কবি সাদা সুরে সহজ ভাষায় অধিকাংশ গান রচনা করেছিলেন। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতাই তাঁর একমাত্র অবলম্বন। দৈনন্দিন জীবিকার প্রতীকই তাঁর তত্ত্ব কথার বাহন হয়েছে। যখন তিনি প্রশ্ন করেন—

“বল দেখি ভাই কি হয় মলে।

এই বাদানুবাদ করে সকলে।।”

উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন—

“প্রসাদ বলে যা ছিলি রে তাই হবি রে নিদান কালে

যেমন জলের বিম্ব জলে উদয়, জল হয়ে সে নেশায় জলে।”

এই সহজ উপমা রূপকে তিনি যেভাবে তত্ত্বকথার নির্দেশ দান করেছেন তাতে তাঁর কবিত্বের বিশেষ প্রশংসা করতে হয়। অবশ্য বৈষ্ণব পদকারের মতো ভাষাও ছন্দের ঝঙ্কার এবং কল্পনার সূক্ষ্মতা তাঁর রচনায় ততটা পাওয়া যায় না। অবশ্য এ শুধু তাঁর একার ত্রুটি নয়, সমস্ত শাক্ত পদাবলীরই এটা একটা সাধারণ লক্ষণ। কবিগণ মূলত সাধক ছিলেন বলেই তত্ত্বের দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন—ফলে কাব্যকলার কিছুটা খর্বতা ঘটেছে। রামপ্রসাদ সম্পর্কে সে কথা আংশিক সত্য, তাঁর কয়েকটি পদের রচনা কৌশল, সংযত বাক্‌মূর্তি ও ভাবাবেগ অতি প্রশাংসনীয় মনে হলেও বহু স্থলেই পদগুলি নিতান্ত গতানুগতিক, কৃত্রিম ও রসবর্জিত হয়েছে। তথাপি এই পদে তাপ জর্জর মানুষের সান্ত্বনার বাণী আছে বলে এর কাব্য মূল্য যেমন হোক না কেন, বাঙালি মানসে এর বিশেষ প্রভাব ও চিরকালীন আবেদনকে অস্বীকার করা যায় না।