শাক্ত পদাবলীর সামাজিক পটভূমি

 
শাক্তপদাবলী বা শক্তি বিষয়ক সংগীত বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এই শাক্ত পদাবলীর সমৃদ্ধি ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীতেই।পূর্বই আলোচনা করেছি যে যখন সারা দেশব্যাপী চলতে থাকে এক চরম বিশৃঙ্খলা। দেশের সর্বত্র অত্যাচার অবিচার। চতুর্দিকে সে এক ‘মাৎসন্যায়’এর মত অবস্থা। এর ওপর এ সময়েই ( ১৭৪২-১৭৫১ )শুরু হয় ফিরিঙ্গি,মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদের অত্যাচার বর্গীয় হামলা। এই অত্যাচার ও অবিচারের  সংকটময় অবস্থায় বিপন্ন মানুষ অতিষ্ঠ ও দিশেহারা হয়ে সন্ধান করে কোনো এক বরাভয়দাত্রি শক্তির আশ্রয়।যে শক্তি তাদের রক্ষা করবে ওই সব বিপদ আপদ থেকে।উদ্ধার করবে নির্যাতন থেকে।ভয় থেকে নিয়ে যাবে অভয়লোকে। এমনতর আশ্রয় হতে পারে একমাত্র ‘কালভয়হারিনি জগৎজননীর’ চরণই।সেই পরম নির্ভয় করুণাময়ী জগৎজননীর উপাসনারই আরেক নাম শাক্তসাধনা। আর সেই সাধনার অঙ্গ হিসাবে সাধক পদকর্তাগণ যে সমস্ত গান রচনা করেছিলেন,সেগুলো হল শাক্তপদাবলী। দেবতাকে প্রিয় করার সাধনা বা দেবতার উপর মানবত্ব আরোপের প্রবণতা ভারতীয় আধ্যাত্ব সাধনা র অন্যতম বৈশিষ্ট্য।বিশ্বের মূলীভূতা পরাশক্তি।আদ্যাশক্তির ভূমিকা মাতা এবং কন্যার এই বিশিষ্ট ভাবনার উপরই অষ্টাদশ শতকে শাক্ত পদাবলীর প্রতিষ্ঠা।
“দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি।”ফলে স্বভাবতই আমাদের ধর্ম ভাবরসে পরিপূর্ণ। তা শুষ্ক জ্ঞান মাত্র নয় লৌকিক সম্পর্কেরমধুর বন্ধনে আমাদের কাজে বাধা পড়ে অব্যক্ত অচিন্ত্য তত্ত্বও।ফলে লৌকিক ভাবের  সুর ধ্বনিত হলেও শাক্তপদাবলীতে  দেবতার দেবসত্তা এতোটুকুও ম্লান হয়নি। কেবল মাত্র লীলা নয়,লীলা ও তত্ত্বের অদ্বৈত সন্ধি এই শাক্ত পদাবলী।
শাক্ত পদাবলীর জন্ম বাঙালি তন্ত্র সাধনা ও শক্তি উপাসনার মধ্য দিয়েই। কিন্তু সংগীতের স্বাভাবিক প্রাণাবেগ ও কাব্যের নিজস্ব সূত্রে অনুসরণ করে শাক্তগীতি পদাবলী বাংলা গীতিকবিতা ধারায় একটি মহৎ ঐতিহ্যর জন্ম দিয়েছে। আর এজন্যই শাক্ত পদাবলীর ধর্মনিরপেক্ষ আবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।শাক্ত কবিদের জীবন শক্তি এবং বাৎসল্যবৃত্তি, সংসারমুখীতা ও বাস্তবচেতনা, অশ্রুবাষ্পে এবং নিবিড় অনুরাগে মাতৃ নামোচ্চারণ – এইসব জীবনধর্মী সাহিত্যের লক্ষণ হিসেবেই চিহ্নিত।ভাবের সারল্য ও অকৃত্রিমতা শাক্ত পদাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই ভাবাশ্রয়ী পদগুলি অনুভূতির নিবিড়তায় পাঠক/ শ্রোতার মর্মকে স্পর্শ করে।পারিবারিক জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ের অভিজ্ঞতা, সমাজচেতনা,লোকজীবনের ক্রীড়া-কৌতুক, পাশাখেলা,ঘুড়ি ওড়ানো, শিকার ধরা,কলুর বলদের ঘানিটানা,এমনকি ভানুমতির ভেলকিও তারা অনুপুঙ্খভাবে দেখেছেন। ধর্ম-পথ পরিক্রমা করতে করতে শাক্ত পদকর্তাগণ বিশেষ বস্তুুনিষ্ঠা ও মর্মপ্রীতির পরিচয় দিয়েছেন।ফলে শাক্ত সংগীতগুলীর  কাব্যমূল্যও অস্বীকার করবার জো নেই।
 
শাক্তপদগুলীর মধ্যে জনজীবনের বিচিত্র সুখ বেদনা,আশা-আকাঙ্ক্ষার সুর ধ্বনিত হয়েছে।শাক্ত পদাবলীর রচয়িতা ও শ্রোতা উভয়েই সমসাময়িককালের নিষ্পেষিত বাঙালি সমাজ।স্বভাবতই সংগীতগুলী তাই  রচিত হয়েছে বাংলা ভাষাতেই।শাক্ত সাধক কবিরা সকলেই প্রায় গৃহী।সে জন্যই তাদের শক্তি সাধনা মধ্যে সংসারের ত্যাগের কথা নেই।পলায়নী মনোবৃত্তিও আদৌ নয়।বরং দুঃখকে জয় করার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে চেয়েছিলেন তারা।অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই নির্বিচার পীড়নের মুখে অসহায়,ভয়বিহ্বল জীবনে নিঃসন্দেহে শক্তি সঞ্চার করেছিল এই শাক্তগীতি।হতোদ্যম জীবনে এই নব নবচেতনার মন্ত্র কবিদের বিশেষ উৎসাহিত করেছিল।এই নব চেতনার প্রথম সার্থক রূপকার সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন ও পরে কমলাকান্ত।