অষ্টাদশ শতকের শুরুতেই সমগ্র গৌড়বঙ্গ জুড়ে দেখা দিয়েছিল অমানিশার অন্ধকার। মোগল সম্রাটদের রাজত্বকালে দেশে মোটামুটিভাবে যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছিল অব্যাহত, ঔরংজীবের মৃত্যুর পর তা’ হল অন্তর্হিত বাংলার সমাজ-জীবনেও তখন বিপর্যস্ত অবস্থা, চৈতন্যদেবের প্রভাব ক্রমবিলুপ্তির পথে। বৈষ্ণবের প্রেমধর্ম সহজিয়া পন্থা অবলম্বন করে যে তৎকালিক রূপ লাভ করেছিল, সমাজের শিষ্ট সম্প্রদায় তাকে ‘ন্যাড়ানেড়ির’ কাণ্ড বলে তা থেকে শতহস্ত দূরে সরে গিয়েছিলেন। দেশের এই সামূহিক অবক্ষয়ের যুগে আলোকবর্তিকা হাতে দেখা দিলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ শাক্ত সাধনার একটি উচ্চস্তরে আরোহণ কাঁরে তিনি রচনা করলেন কিছু সাধনসঙ্গীত— একালে আমরা এগুলিকেই ‘শাক্তপদাবলী’ নামে অভিহিত ক’রে থাকি।
প্রাক্-চৈতন্য যুগেই আমাদের দেশে রাধাকৃষ্ণ-কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছিল বৈষ্ণব পদাবলী’। আদি বৈষ্ণবপদকর্তা জয়দেব গোস্বামী তাঁর ‘গীতগোবিন্দে’র রচনাকে ‘পদ’ নামে অভিহিত করায় পরবর্তীকালে রচিত অনুরূপ রচনাকে ‘বৈষ্ণবপদ’ নামেই পরিচায়িত করা হতো। রামপ্রসাদ-কর্তৃক প্রবর্তিত দেবী-বিষয়ক গানগুলিকে একালে আমরা বৈষ্ণব পদাবলীর সাদৃশ্যে ‘শাক্তপদাবলী’ নামে অভিহিত করে থাকি। কিন্তু বিভিন্ন কালে এই গানগুলি ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রচলিত ছিল। এ জাতীয় গানগুলি প্রধানত রামপ্রসাদ-রচিত অথবা তার অনুসরণে রচিত বলে এগুলিকে ‘রামপ্রসাদী গান’ বা ‘প্রসাদী সঙ্গীত’ নামেও অভিহিত করা হয়। আবার সঙ্গীতের প্রধান বিষয় ‘শ্যামা’ বা ‘কালী’ বলে এর নামাত্তর ‘শ্যামাসঙ্গীত’ ও ‘কালীকীর্তন’। চর্যাপদে এবং সঙ্গীত শাস্ত্রে ‘মালসী’ (মালবশ্রী রাগিণীর উল্লেখ আছে, কেউ কেউ ভবানী বিষয়ক গানকেও ‘মালসী’ বলে উল্লেখ করেছেন। ‘সঙ্গীত দামোদর’ গ্রন্থে দুর্গাপূজার অব্যবহিত পূর্ববর্তীকালে গেয় গানকে ‘মালসী’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। দুর্গার অপর নাম ‘আগমনী’ – এই হেতু কচিৎ কেউ যাবতীয় শাক্ত সঙ্গীতকেই ‘আগমনী’ আখ্যা দিতে চান— যদিও এজাতীয় গানের একটি বিশেষ অংশের নামই শুধু ‘আগমনী’ বলে সর্বজন স্বীকৃতি লাভ করেছে।
একালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্পাদিত শক্তি তথা দেবী-বিষয়ক গানের সঙ্কলন ‘শাক্ত পদাবলীর’ নামে অভিহিত হওয়ায় এই নামটিই বিশেষভারে প্রচলিত।
শাক্ত পদাবলীর বিষয় প্রধানত শক্তি হলেও তার দুটি বিশেষ রূপকেই কবিরা নির্বাচন ক’রে নিয়েছেন এবং সেই হিসেবে শাক্ত পদাবলীর দুটি ধারাই প্রধান। একটি ধারার বিষয় ‘উমা / পার্বতী’ এবং অপর ধারায় কালী / শ্যামা।
উমা-বিষয়ক গানগুলি ‘উমাসঙ্গীত’ বা ‘আগমনী’ নামেই বিশেষভাবে পরিচিত হলেও এর অংশবিশেষকে ‘বিজয়া’ নামেও অভিহিত করা হয়। এই সঙ্গীতের প্রধান রস ‘বাৎসল্য’—মা মেনকা স্বামীগৃহবাসিনী উমার জন্য আকুল হয়ে পড়েছেন। তিনি তার স্বামী হিমালয়কে পাঠিয়েছেন উমাঝে পিতৃগৃহে নিয়ে আসবার জন্য পিতা হিমালয় তিনদিনের জন্য উমাকে নিয়ে এসেছেন; উমা শারদ সপ্তমী অষ্টমী-নবমী এই তিন দিন পিতৃগৃহে রইলেন; দশমী প্রভাতে মহাদেব নিজে এসে উমাকে নিয়ে গেলেন—মোটামুটি এই কাহিনীকে অবলম্বন ক’রে মা মেনকার-হাদয়ে বাৎসল্য রসের যে বিচিত্র অভিব্যক্তি দেখা দেয়, তাকেই সাধারণত ‘উমা সঙ্গীত’ বা ‘‘আগমনী বিজয়া’ নামে অভিহিত করা হয়। এই উমাসঙ্গীতের সঙ্গে বাঙালী পারিবারিক জীবনের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। বাঙালী ঘরের কন্যা মাত্রেই যেন উমা। পতিগৃহবাসিনী কন্যাই বাঙালী মায়ের মনে উমার স্থান অধিকার করে। দুর্গাপূজার কিছুকাল থেকে বিজয়া পর্যন্ত এই সঙ্গীতের প্রচলন কাল। রামপ্রসাদ ছাড়াও অনেক কবি উমাসঙ্গীত রচনা করেছেন।
কন্যারূপিণী শক্তি ছাড়াও বাঙালী শক্তি-সাধকের চিত্ত জুড়ে রয়েছেন মাতৃরূপিণী শক্তি— তিনি সাধারণত ‘কালী’ বা ‘শ্যামা’ রূপেই পরিচিতা। এঁকে অবলম্বন ক’রে যে পদগুলি রচিত হয়েছে, তাকে বলা হয় ‘শ্যামাসঙ্গীত’ বা ‘কালীকীর্তন’। এখানে প্রধান রস ‘প্রতিবাৎসল্য’ বা ‘মাতৃভক্তি’। উমা সঙ্গীতে জগজ্জননীর মধুর ভাবের ও মাধুর্যরসের প্রাধান্য, শ্যামাসঙ্গীতে প্রাধান্য ভঙ্গি ভাবের ও ঐশ্বর্যরসের। এ জাতীয় সঙ্গীতে যেমন জগজ্জননীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা আছে বিভিন্ন তত্ত্বকথা, তেমনি এতে প্রকাশ পেয়েছে ভক্তের আকৃতিও আবার কোনো কোনো পদে নানারকম সামাজিক সমস্যারও পরিচয় পাওয়া যায়। উমাসঙ্গীতে যেমন সহজ সরল ভাষায় হাদয়-বেদনা প্রকাশিত হয়েছে, শ্যামাসঙ্গীতে তেমন নয়। উমাসঙ্গীতে পারিবারিক জীবনের অনুপুঙ্গ পরিচয় যেমন পাওয়া যায়, শ্যামাসঙ্গীতে তেমনি পাওয়া যায় সামাজিক জীবনের পরিচয়, এগুলিতে ভাষার ঐশ্বর্য এবং অলঙ্কারের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়।
বৈষ্ণব কবিতার আদর্শে রচিত বলেই কোনো কোনো শাক্ত পদাবলীতে বৈষ্ণব পদের মতোই বাল্যলীলা, গোষ্ঠ, রাস আদিও বর্ণিত হয়েছে। তৎসত্ত্বেও একটি কথা স্বীকার করতে হয় যে, শাক্তপদে ধরণীর ধূলিমাখা জীবনের প্রতি যে গভীর মমত্ববোধ রয়েছে, তেমনটি সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আর কোথাও এমনকি বৈষ্ণব পদাবলীতেও নয়।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সর্বশেষ সৃষ্টি এই শাক্ত পদাবলী। মধ্যযুগের সমাপ্তিমুখে শাক্ত পদাবলীর উদ্ভব, এদের বিকাশ ঘটেছে সেই ক্রান্তিকালে–সে যুগটিকে আমরা বলি আলো আঁধারির যুগ, ভাঙা-গড়ার যুগ বা অবক্ষয়ের যুগ। এই ধারা এগিয়ে এসেছে একালেও অর্থাৎ আধুনিক যুগেও। সম্ভবত এই কারণেই মধ্যযুগের বাবতীয় সাহিত্যের তুলনায় শাক্ত পদাবলীর অবস্থান আমাদের হৃদয়ের অনেক বেশি কাছে।
নানা কারণেই শাক্ত পদাবলী কতকগুলি বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। সাধারণভাবে এগুলিকে গীতিকবিতা বলেই আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু আধুনিক যুগে গীতিকবিতাগুলি সুরবর্জিত হওয়া সত্ত্বেও যেমন সুখপাঠ্য কিংবা বৈষ্ণব কবিতা থেকে সুর বর্জন করলেও যেমন রসানুভূতিতে পাঠকের মন বিমুগ্ধ হয়, শাক্ত পদাবলীর এতখানি ক্ষমতা নেই এটি তার বিশেষ দুর্বলতা। প্রায় সর্বত্র শাক্ত পদাবলীতে তত্ত্বের উপস্থিতি বর্তমান থাকে, তা ছাড়া একটি বিশেষ সুরের সঙ্গে এই পদাবলীগুলি এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে সাধারণ আবৃত্তিতে পাঠকের মন পূর্ণ হয় না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এগুলিকে কবি-হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছাস ঘটেছে বলেই এগুলিকে গীতিকবিতা বলে মেনে নিতে হয়। একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে ধর্মীয় বিষয়কে অবলম্বন ক’রেই শাক্ত পদাবলীর সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে এদের সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ যে ধর্ম-সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে পাঠ করলেও এদের আবেদন বিঘ্নিত হয় না।
অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী বৈষ্ণব পদাবলী ও শাক্ত পদাবলীর তুলনামূলক আলোচনা প্রসঙ্গে স্বীকার করেছেন, “বৈষ্ণব পদাবলী গোষ্ঠীগত প্রেমবিশ্বাসের ভক্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত। তাই, এই পদসাহিত্যে ধর্ম ও ধর্মানুরাগ সমসুত্রে বিধৃত, একে অন্য থেকে অবিচ্ছিন্ন। কিন্তু শাক্তসঙ্গীতের মর্মোৎসারিতা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি-চিত্ত প্রবাহে সমাকুল। এইখানেই এই দুই শ্রেণীর ধর্মনির্ভর গীতিসাহিত্যের ঐতিহাসিক পার্থক্যমূল।” শাক্ত পদাবলী একান্তভাবে জীবনাশ্রয়ী। সমাজ সংসারকে কেন্দ্র করেই চলেছে এদের আবর্তন, সমাজ-জীবন এবং ব্যক্তিজীবনের রূপ এগুলিতে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। মানবিক আবেদনে পুষ্ট এবং জীবনরসে অভিষিক্ত এই পদগুলিতে বাঙালী গৃহস্থজীবনের যে অকৃত্রিম চিত্র উদ্ভাসিত হয়েছে, প্রাগাধুনিক যুগের কোনো সাহিত্যেই এর তুলনা মিলবে না। এইদিক থেকে বাংলো সাহিত্যের ইতিহাসে শাক্ত পদাবলীর স্থান একক ও অনন্য।
শাক্ত পদাবলীতে ঘটেছে তত্ত্ব ও লীলার সমন্বয়, মাধুর্য ও ঐশ্বর্যরসের সমন্বয় এবং তার চেয়েও বড় কথা,— এক পরম উদার মনোভাবের ফলে এতে বিভিন্ন ধর্মমতেরও সমন্বয় – ঘটেছে বলে সাধক কবির দৃষ্টিতে ‘শ্যাম’ ও ‘শ্যামা’ একাকার হয়ে গেছে। বস্তুত বহু বিচিত্রতার মধ্যে সমন্বয় সাধনই যেন শাক্ত পদাবলীর বৈশিষ্ট্য এ জাতীয় ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হতে অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তিই আনন্দানুভব ক’রে থাকেন। অধিকন্তু এখন শাক্ত পদাবলীতেই যেন শোনা যায় গীতার সার–কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সুর।
Leave a comment