প্রথমে জানতে হবে শাক্ত পদাবলী কাকে বলে? শাক্ত পদাবলী হল শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী অর্থাৎ মহাকালী কে নিয়ে যে সমস্ত পদ বা পদাবলী মধ্যযুগে রচিত হয়েছিল সেগুলোকে একসঙ্গে শাক্তপদাবলী বলে।এর প্রধান উৎস হলো তন্ত্রশাস্ত্র, পূরাণ এবং প্রকীর্ণ কবিতা।
শাক্ত পদাবলীর উৎস ও পশ্চাদপট –
বাংলা সাহিত্যে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দি পর্যন্ত রাধা কৃষ্ণের প্রেমভক্তিমূলক বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের প্রাধান্য দেখা যায়। ধীর ধীরে রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা জাতীয় জীবনে তার পূর্বপ্রভাব হারিয়ে ফেলে এবং মাতৃদেবীর পূজা-অর্চনা প্রাধান্য লাভ করে। বৈষ্ণব সাহিত্যে যেমন রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তেমনি শাক্ত সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে উমা-পার্বতী-চন্ডী- কালিকাকে কেন্দ্র করে।রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন -প্রাচীন বাঙালি কুলত্যাগিনী ও গৃহত্যাগিনী উমা এই দুই নারীর ভজনা করেছেন। কুলত্যাগিনী রাধার প্রেম সামাজিক দৃষ্টিতে অবৈধ। তাই ধীরে ধীরে রাধার প্রতি জনরুচির সমর্থন হ্রাস পায়। মাতৃ-দেবী গৃহচারিনী উমা ও পার্বতীকে বাঙালি আপন করে নেয়।বাঙালী জীবনে ভক্তিস্রোতের এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনৈতিক,সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নীতিগত আদর্শের প্রেরণা কাজ করেছে বেশি। বহিরঙ্গের দিক থেকে রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের প্রবল আঘাত বাঙালির জীবনে চিন্তাভাবনার এই পরিবর্তন সৃষ্টি করে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে যখন বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা,উৎপীড়ন ও দুর্দশার চরম আকার ধারণ করে তখন প্রেমের ভাববিলাসের পরিবর্তে শক্তি সাধনা ও আত্মরক্ষার অনিবার্য প্রেরণা সমাজ পরিবেশে অনস্বীকার্য সতত।
অষ্টাদশ শতাব্দিতে বাঙালি সমাজে আদর্শ বিচ্যুতি ঘটে।এ সময় বাংলার সুবাদার ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ।রাজস্ব আদায়ের জন্য তিনি ঘৃণ্য ও নির্মম পন্থা অবলম্বন করতেন।রাজস্ব আদায়ের করড়াকড়ি শোচনীয় হয়ে ওঠে।এর ফলে মুর্শিদাবাদের কোষাগারের ধনবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। আর অসহায় জনসাধারণ গো- মহিষের মত মরতে থাকে।মুর্শিদকুলি খাঁর পর সুজাউদ্দিন,সরফরাজ ও নবাব আলীবর্দী বাংলার দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়েছেন। ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের মতে এদের রাজস্বের পর রাজস্ব আদায়ের কাজে জমা বৃদ্ধি পেতে থাকে।এতে রাজা জমিদার পর্যুদস্ত প্রজারা বিপন্ন হয়। খাজনা দিতে না পারলে তাদের সম্পত্তি নিলামে ওঠে, দীর্ঘমেয়াদের কয়েদে আবদ্ধ থাকতে হয়।সর্বত্রই জুলুম নীলামেরহিড়িক,অত্যাচার কয়েদ।
ঐতিহাসিক ভিননসেন্ট স্মিথের ভাষায় তখন Everything was on sale।জনগণ ন্যায় বিচার পায় না। বিচারের নামে প্রহসন চলে।”বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে”। এছাড়াও ছিল মগ ও ফিরিঙ্গি পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে।বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সুন্দরবন তাদের অত্যাচার ও দস্যুতায় শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়।এই পরিস্থিতিতে বাংলারয় কুখ্যাত বর্গীর হাঙ্গামা শুরু হয়। সাংঘাতিকভাবে বাংলার জনজীবন আক্রান্ত হয়।বর্গীর অত্যাচারে গ্রামবাসী সাধারণ মানুষ, বেনে,মুদি,হাজা-মহারাজা,জমিদার ও নবাব সকলেই বিপর্যস্ত হয়।বর্গীদের অমানুষিক অত্যাচারে কৃষি ও ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষতি,নারীধর্ষণ ও নরহত্যা প্রভূতি নারকীয় অনুষ্ঠানে বাংলাকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করে। এর ফলে জনজীবনে চরম আর্থিক দুর্দশার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে।
রাষ্ট্রীয় অরাজকতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার যুগে সাধারণ মানুষ স্বভাবতই বরাভয়দাত্রী এমন একটি আশ্রয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠে যা তাদের সর্বদুঃখ,বিপদ ও যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করতে পারে।বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে সেই আশ্রয় তখন খুজে পাওয়া যায়নি।মহাপ্রভুর তিরোধানের পর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অভাবে বৈষ্ণবধর্মে প্রাণ-প্রাচুর্যের ক্রমবর্ধমান হ্রাস ঘটতে থাকে এবং নৈতিক শৈথিল্য দেখা দেয়।তখন অত্যাচারও দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনন্ত করুণাময়ী কালভয়হারিনি জগৎজননী কালিকাকে পরমনির্ভর স্থল বলে শাক্ত কবিরা জনগণের মধ্যে শাক্তপদাবলী রচনা করলেন। দেবী কালিকার আশ্রয়ে ব্যভিচার নেই, দুর্বলতা নেই,হিংসা নেই,আছে প্রেম ও করুণা।
রাজ শক্তি যখন বিশৃঙ্খলা, রাজা যখন দুর্বল এবং রাজসভা বিচার-বিমূঢ় তখন মাতৃচরনই একমাত্র ভরসা।মায়ের এজলাসই অভিযোগ জানানোর প্রকৃষ্ট স্থান। তাই শাক্ত কবিরা সহস্র প্রকার অভিযোগ,অনুযোগ ও আবদার-অনুনয় নিয়ে নিজেদের প্রাণের কথা তথা সমগ্র দেশবাসীর হৃদয়কে সংগীতে উৎসারিত করে দিয়েছেন।
আর্য সমাজ পুরুষপ্রধান ছিল।তাই আর্য ধর্মে আধ্যাত্বিক চিন্তায় পুরুষ দেবতার প্রাধান্য।কিন্তু অনার্য দ্রাবিড় অস্ট্রিক ও মোঙ্গলদের সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। তারা মার্তিকামূর্তির উপাসক ছিলেন। সম্ভবত অনার্য প্রভাবে বৈদিক সাহিত্যে মাতৃরূপিনী, প্রাণদায়িনী,স্তন্যদায়িনী অন্নদায়িনী পৃথিবীর কথা বলা হয়েছে। অথর্ববেদের পৃথিবীতে পৃথিবীসূক্তে পৃথিবী সন্তানবাৎসল্যের প্রতিমূর্তি। সেখানে কল্যাণময়ী,স্নেহময়ী ও কল্যাণী পৃথিবী- মাতার বর্ণনা রয়েছে। ঋগ্বেদের দেবীসূক্ত ও রাত্রিসূক্তে, সামবেদের রাত্রিসূক্তে সমস্ত সৃষ্টির মূলীভূত শক্তিকে মাতৃ রূপে কল্পনা করে তার বিভিন্ন রূপের বর্ণনা রয়েছে। কোনপনিষদে ওমা হৈমবতীর গল্পে শক্তি দেবীরই প্রভাব পড়েছে।
ভারতবর্ষে শক্তিপূজো এবং ওমা-পার্বতী, চন্ডী,কালীকাকে আদ্যাশক্তি রূপে গ্রহণের রীতি সর্বপ্রথম পৌরাণিক সাহিত্যে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়।মার্কণ্ডেয় পুরাণ,দেবীভাগবত,ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, কালিকাপুরাণ এমনকি বিষ্ণুপুরাণ ভাগবতেও শক্তি উপাসনার পরিচয় লিপিবদ্ধ। দক্ষ প্রজাপতির কন্যা সতীর সঙ্গে মহাদেবের বিবাহ,সতীর দেহত্যাগ, হিমাচল গৃহে সতীর উমা-পার্বতী রূপে পুনর্জন্ম,শিবের সঙ্গে বিবাহ ও তাদের দাম্পত্যলীলার নানা কাহিনী শাক্ত ও শৈব পুরাণ রয়েছে।মার্কন্ডেয় পুরাণে দেবী মাহাত্ম্য উপচ্ছেদে চন্ডী কাহিনী বর্ণিত।বাংলার শাক্ত সাহিত্যে চন্ডীর প্রভাব যথেষ্ট পড়েছে। হিন্দু ধর্ম, কর্ম ও দেবপ্রতিমা সবই পূরাণ থেকে গৃহীত।বেদান্ত ও সংখ্যা দর্শনের প্রভাবে তন্ত্রে ও পূরাণে শক্তিতত্ত্ব গৃহীত হয়েছে। তন্ত্র শাস্ত্রে শক্তি দেবীর মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।তন্ত্রের সংখ্যা অসংখ্য। প্রকারভেদের শক্তির তত্ত্ব ও উপাসনা পদ্ধতি আলোচনা করাই তন্ত্রের লক্ষ্য।আর্যেতর,আদিম জাতির মধ্যে যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিল সেটাই বেদে, উপনিষদে,দর্শনে ও পূরানে প্রভাব বিস্তার করেছে।তারই সুসংহত সমন্বয় ঘটেছে তন্ত্রে।
তন্ত্রের দেবতা শক্তি বা নারী। তিনি আদ্যাশক্তি,সৃষ্টিপ্রপঞ্চের মুল।তন্ত্রাচারই জীবের মোহ নাশ করে তাকে মোক্ষ ফল প্রদান করে।তান্ত্রিক সাধকরা ভব ব্যাধি থেকে মুক্তির উপায় স্বরূপ তান্ত্রিক সাধন প্রকরণকে একমাত্র নিদান ভেবেছেন।
তান্ত্রিক সাধকের মতে মানবদেহেই ব্রম্ভান্ডের অবস্থিতি – “যাহা আছে ব্রহ্মান্ডে তাহা আছে দেহভান্ডে”।তান্ত্রিক সাধনা ও আচার-আচরণে ভঙ্গুরা দেহেই পরামুক্তি সম্ভব।তন্ত্রমতে মানবদেহে সাড়ে তিন লক্ষ্য নাড়ির মধ্যে মেরুদন্ডে প্রবাহিত ইড়া,পিঙ্গলা,সুষুম্মাই প্রধান।এগুলীর মধ্যে সুষুম্মা নাড়ী সর্বপ্রধান।সুষুম্মাতে ছয়টি চক্র পরিকল্পিত – মূলাধারচক্র,স্বাধিষ্ঠান চক্র, মনিপুর চক্র,অনাহত চক্র, বিশুদ্ধ চক্র ও আজ্ঞা চক্র।সুষুম্মা নাড়ী গুহ্যদেশ থেকে শিরোদেশ পর্যন্ত প্রবাহিত।এই নাড়ী দিয়েই চিৎশক্তির যাতায়ত।গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যে মূলাধার চক্র,লিঙ্গমূলে স্বাধিষ্ঠান চক্র।নাভিমূলে মনিপুর চক্র,হৃদয়ে অনাহত চক্র,কন্ঠে বিশুদ্ধ চক্র,ভ্রূমধ্যে আজ্ঞা চক্র।
শাক্তপদাবলী প্রকৃতপক্ষে শক্তিতত্ত্বেরই সঙ্গীতগীত।শাক্ত কবিরা প্রথমে সাধক তারপরে কবি।সাধনলব্ধ সত্যকে, ব্যক্তিগত অনুভুতিকে তারা কাব্যিক ভাবব্যঞ্জনার সংগীতে উৎসারিত করে দিয়েছেন। দুরহ জটিল শক্তিতত্ত্বকে তারা নিত্য প্রচলিত ঘরোয়া আটপৌরে ভাষায় লোকজীবন থেকে আহৃত রূপক উপমা ও চিত্রকল্পের সাহায্য মূর্ত করে তুলেছেন। ঐশ্বর্য ও মাধুর্যের সমন্বয় ঘটেছে শাক্ত পদাবলীতে।ব্রহ্মময়ী আদ্যাশক্তি ইচ্ছাময়ী ও লীলাময়ী মা হয়ে উঠেছেন।হয়ে উঠেছেন কালভয়হারিণীও করুণাময়ী মা।
আদ্যাশক্তি মহামায়া নিজের ইচ্ছাশক্তিকে অবলম্বন করে বিশ্বসংসারে বিচিত্র লীলা করে চলেছেন, তাঁর ইচ্ছা কর্মে ও আচরণে লীলাকারে প্রকাশ পাচ্ছে। সমগ্র সৃষ্টিই তাঁর লীলা। মায়াবদ্ধ সংসারী মানুষ তার লীলার খেলনা।শাক্তপদাবলী তন্ত্রসাধনার পশুভাব ও বীরভাবের প্রসঙ্গ নেই।সাধক কবিরা বামাচারের সাধন স্তর অতিক্রম করে বীরভাবকে পশ্চাতে রেখে শক্তি-সাধনার সমুন্নত লক্ষ্য ও আদর্শ যে দিব্যভার তারই সুউচ্চস্তরে উপস্থিত হওয়ার জন্য বিচিত্র আকাঙ্খাকে প্রকাশ করেছেন। পারিবারিক জীবনের চিত্র,নিপীড়িত মানবের চিত্র উজ্বল রেখায় পরিস্ফুট হয়েছে শাক্ত পদাবলীতে। তত্ত্ব ও জীবন রসের সুন্দর সমন্বয় সাধিত হয়েছে এখানে।বহু বিচিত্র চিত্র ও চরিত্র, নানাপ্রকার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভাব কল্পনার স্বচ্ছন্দ রুপায়ন ঘটেছে শাক্ত পদাবলীর সুরমুমাধুর্যে।
শাক্ত পদাবলীর সামাজিক পটভূমি
শাক্তপদাবলী বা শক্তি বিষয়ক সংগীত বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এই শাক্ত পদাবলীর সমৃদ্ধি ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীতেই।পূর্বই আলোচনা করেছি যে যখন সারা দেশব্যাপী চলতে থাকে এক চরম বিশৃঙ্খলা। দেশের সর্বত্র অত্যাচার অবিচার। চতুর্দিকে সে এক ‘মাৎসন্যায়’এর মত অবস্থা। এর ওপর এ সময়েই ( ১৭৪২-১৭৫১ )শুরু হয় ফিরিঙ্গি,মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদের অত্যাচার বর্গীয় হামলা। এই অত্যাচার ও অবিচারের সংকটময় অবস্থায় বিপন্ন মানুষ অতিষ্ঠ ও দিশেহারা হয়ে সন্ধান করে কোনো এক বরাভয়দাত্রি শক্তির আশ্রয়।যে শক্তি তাদের রক্ষা করবে ওই সব বিপদ আপদ থেকে।উদ্ধার করবে নির্যাতন থেকে।ভয় থেকে নিয়ে যাবে অভয়লোকে। এমনতর আশ্রয় হতে পারে একমাত্র ‘কালভয়হারিনি জগৎজননীর’ চরণই।সেই পরম নির্ভয় করুণাময়ী জগৎজননীর উপাসনারই আরেক নাম শাক্তসাধনা। আর সেই সাধনার অঙ্গ হিসাবে সাধক পদকর্তাগণ যে সমস্ত গান রচনা করেছিলেন,সেগুলো হল শাক্তপদাবলী। দেবতাকে প্রিয় করার সাধনা বা দেবতার উপর মানবত্ব আরোপের প্রবণতা ভারতীয় আধ্যাত্ব সাধনা র অন্যতম বৈশিষ্ট্য।বিশ্বের মূলীভূতা পরাশক্তি।আদ্যাশক্তির ভূমিকা মাতা এবং কন্যার এই বিশিষ্ট ভাবনার উপরই অষ্টাদশ শতকে শাক্ত পদাবলীর প্রতিষ্ঠা।
“দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি।”ফলে স্বভাবতই আমাদের ধর্ম ভাবরসে পরিপূর্ণ। তা শুষ্ক জ্ঞান মাত্র নয় লৌকিক সম্পর্কেরমধুর বন্ধনে আমাদের কাজে বাধা পড়ে অব্যক্ত অচিন্ত্য তত্ত্বও।ফলে লৌকিক ভাবের সুর ধ্বনিত হলেও শাক্তপদাবলীতে দেবতার দেবসত্তা এতোটুকুও ম্লান হয়নি। কেবল মাত্র লীলা নয়,লীলা ও তত্ত্বের অদ্বৈত সন্ধি এই শাক্ত পদাবলী।
শাক্ত পদাবলীর জন্ম বাঙালি তন্ত্র সাধনা ও শক্তি উপাসনার মধ্য দিয়েই। কিন্তু সংগীতের স্বাভাবিক প্রাণাবেগ ও কাব্যের নিজস্ব সূত্রে অনুসরণ করে শাক্তগীতি পদাবলী বাংলা গীতিকবিতা ধারায় একটি মহৎ ঐতিহ্যর জন্ম দিয়েছে। আর এজন্যই শাক্ত পদাবলীর ধর্মনিরপেক্ষ আবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।শাক্ত কবিদের জীবন শক্তি এবং বাৎসল্যবৃত্তি, সংসারমুখীতা ও বাস্তবচেতনা, অশ্রুবাষ্পে এবং নিবিড় অনুরাগে মাতৃ নামোচ্চারণ – এইসব জীবনধর্মী সাহিত্যের লক্ষণ হিসেবেই চিহ্নিত।ভাবের সারল্য ও অকৃত্রিমতা শাক্ত পদাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই ভাবাশ্রয়ী পদগুলি অনুভূতির নিবিড়তায় পাঠক/ শ্রোতার মর্মকে স্পর্শ করে।পারিবারিক জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ের অভিজ্ঞতা, সমাজচেতনা,লোকজীবনের ক্রীড়া-কৌতুক, পাশাখেলা,ঘুড়ি ওড়ানো, শিকার ধরা,কলুর বলদের ঘানিটানা,এমনকি ভানুমতির ভেলকিও তারা অনুপুঙ্খভাবে দেখেছেন। ধর্ম-পথ পরিক্রমা করতে করতে শাক্ত পদকর্তাগণ বিশেষ বস্তুুনিষ্ঠা ও মর্মপ্রীতির পরিচয় দিয়েছেন।ফলে শাক্ত সংগীতগুলীর কাব্যমূল্যও অস্বীকার করবার জো নেই।
শাক্তপদগুলীর মধ্যে জনজীবনের বিচিত্র সুখ বেদনা,আশা-আকাঙ্ক্ষার সুর ধ্বনিত হয়েছে।শাক্ত পদাবলীর রচয়িতা ও শ্রোতা উভয়েই সমসাময়িককালের নিষ্পেষিত বাঙালি সমাজ।স্বভাবতই সংগীতগুলী তাই রচিত হয়েছে বাংলা ভাষাতেই।শাক্ত সাধক কবিরা সকলেই প্রায় গৃহী।সে জন্যই তাদের শক্তি সাধনা মধ্যে সংসারের ত্যাগের কথা নেই।পলায়নী মনোবৃত্তিও আদৌ নয়।বরং দুঃখকে জয় করার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে চেয়েছিলেন তারা।অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই নির্বিচার পীড়নের মুখে অসহায়,ভয়বিহ্বল জীবনে নিঃসন্দেহে শক্তি সঞ্চার করেছিল এই শাক্তগীতি।হতোদ্যম জীবনে এই নব নবচেতনার মন্ত্র কবিদের বিশেষ উৎসাহিত করেছিল।এই নব চেতনার প্রথম সার্থক রূপকার সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন ও পরে কমলাকান্ত।
শাক্ত পদাবলীর কাব্যমূল্য
শাক্ত সংগীতে বাঙালির প্রাণের সার্বিক অভিব্যক্তি ঘটেছে।মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় প্রভূত পরিমাণে বৈষ্ণব পদাবলী রচিত হয়েছিল বটে কিন্তু তার সঙ্গে বাঙালির বাস্তব জীবনের তেমন কোনো যোগ ছিল না। বৈষ্ণব পরকীয়া তত্ত্ব বাঙালির গৃহ জীবনে ছিল একান্তভাবেই অনাকাঙ্খিত,এর ঠাঁই ছিল গ্রাম প্রান্তে অবস্থিত বোষ্টম-বোষ্টমীর আখড়ায়।প্রক্ষান্তরে শক্তি-সাধনায় তখন জগতজননীকে আপন গৃহে মাতৃরূপে স্থাপন করা হল।তখন একদিকে যেমন বাঙালির ভক্তি সাধনার একটি বিশেষ দিক লক্ষ্য করা গেল তেমনি অবারিত ভাবে আত্মপ্রকাশ করল কবিত্বের ধারা। অর্থাৎ একদিক দিয়ে জগজ্জননীর দিব্যরূপ প্রকাশে যেমন বাঙালির আধ্যাত্ম পিপাসার নিবৃত্ত ঘটে তেমনি এক রসরূপ উদঘাটনে কাব্যরস পিপাসাও পরিতৃপ্ত হতে পারে।
শাক্ত পদাবলীর দুটি প্রধান পর্যায় – একটি উমা-সঙ্গীত বা আগমনী-বিজয়ার গান,অপরটিশ্যামা সঙ্গীত শ্যামাসংগীত তথা সাধন সঙ্গীত। আগমনি-বিজয়ের পদে উপাস্য দেবী কন্যারূপিনী উমা,এখানে দেবীর দিব্যভাব প্রকাশের সুযোগ অপেক্ষাকৃত স্বল্প হলও একেবারেই অনুপস্থিত নয়।ভক্তকবি যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই উমাকে দিব্য শক্তির আধারে জগতজননী রূপে উপস্থাপিত করেছেন।মেনকার আকুতিতে কৈলাসে গিয়ে গিরিরাজ উমাকে নিয়ে গৃহে ফিরলেন।
উমা তখন চন্ডী রূপেই দেখা দিয়েছেন। মেনকা ভীত চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আর তাকে চিনতে পারেন না, তাই বলেন :
“গিরি কার কণ্ঠহার আনিলে গিরি-পুরে?
এতো যে উমা নয় ভয়ঙ্করী হে দশোভূজা মেয়ে।
কিংবা -‘কে নারী অঙ্গনে এলো চিনতে না পারি।
অঙ্গনে দাঁড়ায়ে এ নয় আমার প্রাণকুমারী।।”
অথবা –
“তুমি নও সামান্য কন্যা, ভবদারা ত্রিলোকমান্যা
আছি মা তোমারি জন্য, পথ নিরীক্ষণ করি।।”
উমার এই দিব্যমূর্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে শাক্ত কবিদের আধ্যাত্মরস পিপাসারই পরিচয় পাওয়া যায়।
শক্তি-সাধনকে বাঙালির নিজস্ব সাধনা বলে অভিহিত করলে অত্যুক্তি করা হয় না।সর্ব বৈষ্ণব সাধনা সর্বভারতে পরিব্যাপ্ত কিন্তু শক্তিসাধনার যে দুটি বিশেষ রূপ – ‘কন্যাসাধনা’ ও ‘মাতৃ সাধনা’ শাক্ত পদাবলীর মাধ্যমে পরিবেশিত হয়েছে তেমনটি আর কোথাও হয়নি। ধর্মীয় আচার-আচরণ অথবা শাস্ত্রীয় মন্ত্র-তন্ত্রাদির অতিরিক্ত অথবা তা থেকে পৃথক এই সাধনা রুপ ও রসমূর্তি লাভ করেছে শাক্ত সংগীতের মধ্য দিয়ে। শাক্ত পদের বিভিন্ন পর্যায়ে আধ্যাত্মিকতা ও কাব্যরস এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়েছে যে এক থেকে অপরটি পৃথক করা দুঃসাধ্য।ডক্টর অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন :
“সাধারণ কাব্য বিচারের মানদণ্ডের আদর্শে শাক্তপদাবলী বিচার করতে গেলে কবি সাধকদের কাব্যবিচার করা হইবে।কারণ ইহারা কেহই নিছক কাব্য করিবার জন্য বা শ্রোতাদের সংগীত পিপাসা নিবারণ করিবার জন্য এই গীতিকাসমূহ রচনা করেন নাই। তাহারা মূলত সাধক ও মোক্ষভিলাষী,গৌণ কবি। তাই সাধারণ কাব্যকবিতার আদর্শে দেখিলে সাধক ও শাক্ত পদাবলীর অনেকটাই খর্ব মনে হইবে।”
কবি সাধকগণ নানা উপমা অলংকার ইঙ্গিতের আভাসে জগৎজননী আদ্যাশক্তির স্বরূপ নির্ধারণ করে গিয়েছেন কারণ যাকে ভক্তি করতে হয় তার একটা রুপায়তন না হলে চলে না। যখন কবি কালভয়হারিনী মহাকালীকে নিজ অন্তরে উপলব্ধি করেন তখনই তা শিল্পরূপ লাভ করে :
“সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনমোহিনী.
যখন ব্রহ্মান্ড না ছিল হে মা মুন্ডমাল্য কোথা পেলি।
কিংবা যখন সাভিমানে কালিকাকে সম্বোধন করে বলেন :
“যে ভালো করেছ কালী আর ভালোতে কাজ নাই।…
জানি শত শত কপাল ছাড়া পথ নাই।।”
তখন তাতে মর্তের স্নেহাভিমান চমৎকার রসরূপ লাভ করে।
আগমনী- বিজয়ার গানে তত্ত্বকথা প্রায় নেই – সেখানে একটা পারিবারিক পরিবেশে সশাক্তপদকর্তারা কবিত্ব-শক্তি-বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ লাভ করেছেন। সে স্থলে দেবীকে কবিরা মানবী রূপের মধ্যে নিবিড় ভাবে উপলব্ধি করেছেন। অথচ দেবী মহিমা অক্ষুন্ন রয়েছে।
মোহবদ্ধ জীবকে শাক্ত কবিরা নানাভাবে চিত্রিত করেছেন। মোহবদ্ধ জীব চিত্রের পদ্মেতে পড়া ভ্রমর, কোথাও কলুর বলদ, কোথাও ভানুমতির কুহকে মোহমুগ্ধ বেদে। রূপক অলংকারময় ভাষায় শাক্ত কবিরা বাঙালি প্রাণের অকৃত্রিম ভাষাতে পদ রচনা করেছেন।তাদের সহজ কবিত্বধর্ম পদগুলির বিশিষ্ট সম্পদ।ভাষা ব্যবহারে – জারি ভাঙ্গা, কায়দা করা,দেঁতোর হাসি,ভোজের বাজী,ঠারে ঠারে,চোখে ঠুলি প্রভৃতি বিশিষ্টার্থক পদের ব্যবহার; পাকা ধানে মই, ভূতের বেগার,ছেলের হাতের মোয়া, কিল খেয়ে কিল চুরি করা প্রভৃতি প্রৌঢ়েক্তির সাহায্যে কবিরা সংগীতের ভাষাকে চলমান জীবনের বেগবতী ভাষায় পরিণত করেছেন। সমকালীন সমাজের প্রাণরসে শাক্তপদাবলী যেমন সঞ্জীবিত তেমনি তা গীতিকাব্যোচিত ব্যাক্তিভাবনার আদিগঙ্গা হরিদ্দার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি কে?
শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠ্য কবি হলেন রামপ্রসাদ সেন।ভারতীয় ঋষিগণ যে অর্থে ‘কবি’ সংজ্ঞার নির্দেশ করেছিলেন সেই অর্থেই তিনি কবি।কবি সিদ্ধপুরুষ,সত্যদ্রষ্টা – তিনি ঋষির। চব্বিশ পরগনা জেলার হালিশহরের কাছে ভাগীরথীর তীরে কুমারহট্ট গ্রামে এক কুলীন বৈদ্য বংশে রামপ্রসাদ জন্মগ্রহণ করেন। ১৭২০-২১খ্রিস্টাব্দে। রামপ্রসাদ ছিলেন তার পিতার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন রামপ্রসাদ।কৃষ্ণচন্দ্রই রামপ্রসাদ কে কবিরঞ্জন’ উপাধি দিয়েছিলেন।এই কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশেই রামপ্রসাদ রচনা করেছিলেন ‘কালিকামঙ্গল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যটি।আর দেওয়ান রাজকিশোর রায়ের আদেশে রামপ্রসাদ লিখেছিলেন ‘কালীকীর্তন’ কাব্যটি।
রামপ্রসাদ গৃহী লোক ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র রামদুলাল ও রামমোহন। আর দুই কন্যা পরমেশ্বরী ও জগদীশ্বরী। গৃহী রামপ্রসাদ ছিলেন কালীসাধক। জমিদারের মুহুরি হিসাবে কাজ করতে গিয়ে রামপ্রসাদ মায়ের চিন্তায় তন্ময় হন ও স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে শ্যামাসংগীত রচনা করেন। রামপ্রসাদ নির্জন অরণ্যে বসে তপস্যা করেন নি। সংসারের চাপে পিষ্ট হয়ে খেদ করেছেন।এই খেদোক্তি বেদনা আর আর্তি একান্তভাবে মানবমনের অন্তর্গত। আধুনিক কবি যেমন বলেন,’The world is too much with us’ – রামপ্রসাদ যেন সেই অনুভূতিরই অংশভাগী। আমাদের প্রাত্যহিক সংসারের ক্রন্দন,আশাভঙ্গ জনিত বেদনা, হতাশা, নৈরাশ্য,আর্তি ও সংশয় এখানে ধরা পড়েছে।
“কেবল আসার আশা ভবে আসা আসামাত্র হল
যেন চিত্রের পদটমেতে পড়ে ভ্রমর ভুলে রল।”
তখন মনে হয় এই বেদনার গানতো আমাদেরই মতো জীবন যুদ্ধে পর্যুদস্ত,শান্ত, বিধ্বস্ত প্রায় পথিকের ভয় হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়েছে। অথচ তিনি শুষ্ক বিদ্বেষী কাপালিক মাত্র নয়।
আধুনিক কবি মানস জীবনর সত্যকে আপন অন্তরে অন্বেষণ করেন।
” অন্তর মাঝে তুমি শুধু একা একাকী/ তুমি অন্তরবাসী।”
অথবা – “ওহে অন্তরতম মিটেছে কি তব সকল তিয়াস আসি অন্তরে মম।”
রামপ্রসাদও তেমনি তার জননীকে খুঁজে পেয়েছেন আপন অন্তর প্রদেশে। রামপ্রসাদের সঙ্গীত গুলি তাই মানবতার সঙ্গে আধ্যাত্বিক আকুতির ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন করেছে। রামপ্রসাদ সহজ সরল লোকায়ত জীবনের কথা
“মা আমায় ঘুরাবি কত
কলুর চোখ ঢাকা বলদের মতো।”
আবার অন্যত্র –
“আমি নই আটাশে ছেলে
ভয়ে ভুলব না চোখ রাঙালে।”
রামপ্রসাদের কবিতা নিঃসন্দেহে তত্ত্বপ্রধান।
একদিন মহাপ্রভুর অশ্রু কম্প,পুলক,স্বেদাদিযুক্ত উদন্ত কীর্তন যেমন করে বঙ্গবাসীকে পাগল করে তুলেছিলো, রামপ্রসাদের প্রসাদি সংগীতও তেমনি করে এদেশের শিরায় শিরায় উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে। এদিক থেকে রামপ্রসাদ হলেন সাধক ও কবি রামপ্রসাদ –
“ডুব দে রে মন কালী বলে
হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।”
এই বলে নিজে ডুব দিয়ে আহরণ করেছেন এবং বিলিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবাসীকে। তাই বাঙালির কণ্ঠে অতীতেও যেমন বেজেছে রামপ্রসাদের গান আজও তেমনি ধ্বনিত হচ্ছে তার সংগীত লহরী, ভবিষ্যতেও ঝংকৃত হবে তাঁরই পরম আত্মনিবেদনের সুর –
Leave a comment