কোনো কোনো বিদগ্ধ সমালোচক আপত্তি জানালেও, একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে বৈষ্ণব পদাবলীর আদলেই বাংলা ভাষার শাক্ত পদাবলীর উদ্ভব ঘটেছে। তাই শাক্ত পদাবলীতেও বৈষ্ণব পদাবলীর কিছু অনুকরণ থাকা স্বাভাবিক। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য— কৃষ্ণের বাল্যলীলার অনুসরণে রচিত উমার বালালীলা এবং প্রায় অনুল্লেখযোগ্য গোষ্ঠলীলা, রাসলীলা প্রভৃতি। ঐতিহাসিক কারণেই শাক্ত পদাবলীতে বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণের কথা উল্লেখ করা হল, নতুবা গুরুত্বের বিচারে এদের বিশেষ কিছু মূল্য স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। শাক্ত পদাবলী স্বাধীন ভাবেই গড়ে উঠেছে এবং তার নিজস্ব কারণেই এর মধ্যে যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে সেই ধারাতেই এই শ্রেণীবিভাগ কল্পিত হ’য়ে থাকে।
‘শাক্ত পদাবলী’ নামটি এককালে সৃষ্টি হয়েছে সম্ভবত বৈষ্ণব পদাবলীর সাদৃশ্যে। এর পূর্বে বিভিন্ন নামে এর স্বরূপ-নির্ণয়ের চেষ্টা হয়েছে এবং নাম থেকেই বিষয়বস্তুর কিছুটা পরিচয় অনুমান করা চলে। এই প্রচলিত নামগুলির মধ্যে আছে—– ‘আগমনী-বিজয়া’, ‘মালসী’, ‘কালীকীর্তন’, ‘শ্যামা-সঙ্গীত প্রভৃতি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে অমরেন্দ্রনাথ রায় কর্তৃক সম্পাদিত ও সংকলিত ‘শাক্ত পদাবলী’ প্রকাশিত হবার পূর্বে শাক্তপদের বিষয়গত শ্রেণীবিভাগ নিয়ে বিশেষ কোন আলোচনা হয়নি। তিনিই উক্ত গ্রন্থে সর্বপ্রথম বিষয়বস্তুর বিচারে পদগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেন যদিও এই শ্রেণীবিন্যাসের যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
সমগ্র শাক্তপদাবলী সাহিত্যকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় ‘শক্তি’র দু’টি প্রধান রূপ কল্পনা অবলম্বন করে। একরূপে তিনি হিমালয় মেনকা দুহিতা ও শিব গৃহিণী উমা-পার্বতী— তার গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে যুক্ত পদগুলিকে এক শ্রেণীতে এবং অসুর-দলনী চণ্ড-মুণ্ড-বিঘাতিনী কালীরাপিণী ভগবতীর সঙ্গে যুক্ত পদগুলিকে অন্য এক শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা চলে। উমা এবং কালী একই শক্তির রূপভেদ হলেও এঁদের পারস্পরিক সম্পর্কসূত্র আবিষ্কার করা কষ্টকর।
ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষের অন্যতম কন্যা সতী মহাদেবের সঙ্গে বিবাহিতা হ’য়েছিলেন। একবার দক্ষযজ্ঞে অনিমন্ত্রিতা সতী উপস্থিত হলে দক্ষ তার সামনে শিবনিন্দা করেন। স্বামীনিন্দা শ্রবণে সতী যজ্ঞস্থলেই দেহত্যাগ করেন এবং উমা-পার্বতী-রূপে হিমালয়গৃহে মেনকা গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ঐ জন্মেও তিনি মহাদেবকেই স্বামী রূপে বরণ করেন এবং স্বামীর সঙ্গে কৈলাসবাসিনী হন। কালে তার কার্ত্তিক এবং গণেশ নামক দু’টি পুত্র জন্মে। বৎসরে একবার দেবীর পিতৃগৃহে আগমন এবং স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তন অবলম্বনে মাতৃহাদয়ের উচ্ছ্বাস বর্ণিত হ’য়েছে প্রথমোক্ত শ্রেণীর পদগুলিতে।
দেবাসুরের যুদ্ধকালে শুষ্ক-নিশুন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতারা পরাজিত হয়ে স্বর্গচ্যুত হন এবং আদ্যাশক্তি দেবী ভারতীর স্তুতি করতে থাকেন। যেন দেবীর দেহ কোষ থেকে দেবী কৌষিকীর আবির্ভাব ঘটে; তিনি নিষ্ক্রান্ত হবার পর দেবী ভগবতী কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন এবং কালী বা কালিকা-রূপে পরিচিতা হন। আবার দেখা যায় সিংহবাহিনী দেবী কৌষিকীকে শুম্ভ সেনাপতি চণ্ড-মুণ্ড আক্রমণ করলে দেবীর কপাল থেকে নরমুণ্ডমাল্যবিভূষিতা, করালবদনা, কৃষ্ণবর্ণা এক দেবী আবির্ভূতা হয়ে চণ্ড-মুণ্ডকে নিহত করেন এবং এই কারণে দেবীর নাম হয় চামুণ্ডা। কল্পনা করা যায়, এই কৌষিকীই দেবী উমা-পার্বতী এবং চামুণ্ডাই কালী। আমরা দেবী দুর্গার মধ্যে উভয়ের সমন্বয় অনুভব ক’রে থাকি। দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণীর পদে এই দেবী কালীকেই জননী রূপে গ্রহণ ক’রে ভক্ত কবিরা ভক্তির অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন।
সাধারণভাবে শাক্ত পদাবলীকে দুটি প্রধান শ্রেণীবদ্ধ করা চলে। শাক্ত পদাবলীর একটি ধারায় আছে ‘বাৎসল্যরস’—সেখানে উমা এবং মা মেনকাই কবির বিষয়বস্তু এই ধারাটিকে বলা চলে ‘উমাসঙ্গীত’। এর মধ্যে উমার বাল্যলীলা, আগমনী এবং বিজয়ার গানই শুধু স্থান লাভ করতে পারে। এই হিসাবে এই পর্বকে ‘লীলাপর্ব’ নামেও অভিহিত করা চলে। অপর ধারায় বর্ণিত বিষয় “শ্যামা মা’ বা ‘কালীমাতা’—অতএব এই ‘মাতৃসঙ্গীত’-কে ‘শ্যামাসঙ্গীত’ বা কালীকীর্তন নামে অভিহিত করা চলে। আবার এতে বিভিন্ন তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে বলে এই পর্বকে ‘তত্তপর্ব’ নামেও আখ্যায়িত করা চলে। বস্তুত ‘উমাসঙ্গীত’ এবং ‘শ্যামাসঙ্গীত’—এই দুটি প্রধান ধারাকে স্বীকৃতি দিয়েই একে বিভিন্ন উপবিভাগে বিন্যস্ত করা চলে।
অমরেন্দ্রনাথ রায় ‘শাক্ত পদাবলী’ গ্রন্থে বিভিন্ন পদকে বিষয়ানুযায়ী বিভিন্ন শীর্ষনামে ভূষিত করেছেন। যথা— ‘বাল্যলীলা, আগমনী, বিজয়া, জগজ্জননীর রূপ, মা কি ও কেমন, ভক্তের আকৃতি, মনোদীক্ষা, ইচ্ছাময়ী মা, লীলাময়ী মা, করুণাময়ী মা, কালভয়হারিণী মা, ব্রহ্মময়ী মা, মাতৃপূজা, সাধনশক্তি, নামমহিমা, চরণতীর্থ।
খণ্ড খণ্ড ভাবে যদি বিচার করা যায় তবে এই শীর্ষনাম তথা শ্রেণীবিভাগের সার্থকতাকে অস্বীকার করা চলে না। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে শাক্ত পদাবলীকে এত বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করার যৌক্তিকতা বিষয়ে সংশয় জাগে। বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়া—স্পষ্টতঃই একটি সুস্পষ্ট শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এগুলিকে পূর্বে আমরা ‘উমাসঙ্গীত’ নামে অভিহিত করেছি। এদেরই ‘লীলাসঙ্গীত’ নামেও আখ্যায়িত করা চলে। পরবর্তী যে শ্রেণীগুলির উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলি সবই ‘শ্যামাসঙ্গীত’ বা ‘কালীকীর্তন’ নামে পরিচিত হতে পারে। বিষয়গত দিক থেকে এগুলিকে অবশ্য দুটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। একটি জগজ্জননীর রূপ —এই শীর্ষনাম ছাড়াও ‘মা কি ও কেমন’, ইচ্ছাময়ী মা, লীলাময়ী মা, করুণাময়ী মা, কালভয়হারিণী মা এবং ব্রহ্মময়ী মা’—এইসব শ্রেণীভুক্ত পদগুলিকেও অনায়াসেই ‘জগজ্জননীর রূপ’ নামক বৃহত্তর শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত করা চলে। এ ছাড়াও একটি প্রধান পর্ব ‘ভক্তের আকৃতি’— এই পর্বের অন্তর্ভুক্ত হ’তে পারে মাতৃপূজা, সাধনশক্তি, নামমহিমা এবং চরণতীর্থ। বিষয়বস্তুর বিচারে অবশ্য ‘মনোদীক্ষা’ পৃথক শ্রেণীভুক্ত হবার দাবি রাখে এবং অব্যবহিত পূর্ববর্তী শ্রেণীর কোনো কোনো পদকেও এই শ্রেণীতে স্থান দান করা চলে।
অধ্যাপক জাহবীকুমার চক্রবর্তী তার ‘শাক্তপদাবলী ও শক্তিসাধনা’ গ্রন্থে শাক্তপদের আরও গভীরে প্রবেশ ক’রে বহুধাবিভাগ বর্জন ক’রে সমগ্র পদাবলীকে তিনটি মাত্র শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। অমরেন্দ্রনাথ-কৃত শ্রেণীগুলি এদের অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে কোনো বিষয় বর্জিত হয়নি এবং বহুতর শ্রেণীর উল্লেখে অকারণ জটিলতার সৃষ্টি হয়নি। অধ্যাপক চক্রবর্তী-কৃত স্থূলবিভাগ— (১) লীলাপর্ব, (২) উপাস্যতত্ত্ব এবং (৩) উপাসনাতত্ত্ব। তিনি নিম্নোক্তক্রমে তার শ্রেণীবিভাগ ও তার যাথার্থ ব্যাখ্যা করেছেন—
(১) লীলাপর্ব : “কাব্য ও পুরাণের বহুস্থলে জগজ্জননীর লীলা বর্ণনা করা হইয়াছে। এই লীলাগুলির মধ্যে হিমালয় ও মেনকার গৃহে উমারূপী দেবীর যে লীলা, তাহা সুন্দর মানবীয় ভাবে পূর্ণ। লীলাংশ লইয়া অনেক কবি পদ রচনা করিয়াছেন। ‘বাল্যলীলা’, ‘আগমনী’ ও ‘বিজয়া’র গানগুলি লীলা পর্বের অন্তর্ভুক্ত।”
(২) উপাস্য তত্ত্ব: “শাক্ত সাধকের উপাস্য শক্তি দেবী। এই শক্তিই দৈত্যবধের জন্য ও সাধকের সুবিধার জন্য গু% ও ক্রিয়া অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করিয়াছেন। শাক্ত সঙ্গীতের বহু পদে এই উপাস্যের তত্ত্ব, রূপ ও গুণ বর্ণনা করা হইয়াছে—এইগুলি উপাস্যতত্ত্বমূলক গান। ‘জগজ্জননীর রূপ’, ‘মা কি ও কেমন’, ‘ইচ্ছাময়ী মা’, ‘লীলাময়ী মা’, ‘কালভয়হারিণী মা’, করুণাময়ী মা’ ও ‘ব্রহ্মময়ী মা’ শীর্ষনামাঙ্কিত পদগুলি উপাস্যতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে।”
(৩) উপাসনা তত্ত্বঃ “শাক্ত সঙ্গীতের অধিকাংশ গান সাধনতত্ত্বের গান। এই গানগুলিতে শক্তি-আরাধনার ক্রম ও উপায় বর্ণনা করা হইয়াছে। যিনি জগতের নিয়ন্ত্রী শক্তি, যিনি সর্বভূতে বিরাজমান, যাঁহার কৃপা ভক্তের কাম্য, তাহাকে উপাসনা করিতে হইবে কি প্রকারে? সাধন ক্রিয়াই শক্তি-সাধকের প্রধান অবলম্বন। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিতে হইলে প্রথমে প্রয়োজন উপাস্যের প্রতি সুতীব্র শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধার উদয়ে বিষয়ের প্রতি বৈরাগ্য জন্মে, মায়ের প্রতি একান্ত নির্ভরতার ভাব জাগ্রত হয়। ‘ভক্তের আকৃতি’ই ভক্তকে ‘নাম মহিমা’য় উদ্দীপ্ত করে, মায়ের “চরণতীর্থে’র প্রতি অচলা মতি জন্মায়। এই সুতীব্র আগ্রহ হইতে আসে দীক্ষা’র কথা। দীক্ষা না হইলে শাক্ত সাধনার অধিকার জন্মে না। দিব্যমন্ত্রীর দীক্ষা সাধারণত মনোদীক্ষা। এই ‘মনোদীক্ষা’র কথা অনেকগুলি সঙ্গীতে প্রকাশ করা হইয়াছে। দীক্ষার পরে মাতৃপূজায় অধিকার লাভ হয়। ‘মাতৃপূজা’য় পূজার অস্তনির্হিত তাৎপর্যের কথা ব্যক্ত করা হইয়াছে। এইরূপ সাধনা হইতেই সাধক সিদ্ধিলাভ করিয়া থাকেন; তখন তিনি যে শক্তি অর্জন করেন, তাহাই ‘সাধন শক্তি’। অতএব আলোচ্য শাক্তপদাবলীর ভক্তের আকৃতি, মনোদীক্ষা, নামমহিমা, চরণতীর্থ, মাতৃপূজা ও সাধন শক্তি পর্যায়ের গান উপাসনা তত্ত্ব বিষয়ক।”
“অবশ্য শাক্তপদাবলীর অধিকাংশ পদেই লীলা ও তত্ত্বের কথা ওতপ্রোত। লীলা অংশও সম্পূর্ণরূপে-তত্ত্ব-বিরহিত নয়। ‘আগমনী’ অংশেও উমা যে চৈতন্যরূপিণী, তিনিই যে ব্রহ্মা বিষ্ণু-বন্দিতা জগজ্জননী, তাহার আভাষ আছে; আবার তত্ত্ব অংশেও লীলা-কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। শাক্তপদাবলী লীলা ও তত্ত্বের যুগললব্ধ সঙ্গীতমুর্তি। কেবল আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা এইরূপ স্থূল বিষয় বিভাগ স্বীকার করিয়া লইতেছি।”
(বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণীতে শুধু ‘আগমনী, বিজয়া ও ভক্তের আকৃতি পাঠা তালিকাভুক্ত। এই কারণে অপ্রয়োজনীয় বিধায় শ্রেণীর বিস্তৃত পরিচয় দান করা হয় নি। আগমনী, বিজয়া ও ভক্তের আকৃতি বিষয়ে পরে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।)
Leave a comment