শস্য-শ্যামল, কোমল বাংলার আবহাওয়াতে শাক্তপদাবলি রচিত। সমগ্র শাক্ত পদাবলিতে ঐশ্বর্য ও মাধুর্য রূপের একাত্মতা লক্ষ করা যায়। শাক্ত পদাবলি শক্তিসাধনার সঙ্গীত, যেখানে শক্তির মাহাত্ম ও গুণকীর্তি কীর্তিত্ব হতে হতে ধীরে ধীরে ঐশ্বর্য ভাব মাধুর্যে পর্যবসিত হয়েছে।

ঐশ্বর্যের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘তৎকর্ম’, ‘তদ্‌দ্ভাব’, ‘ঈশ্বরের কর্ম বা ভাব’। শাক্ত পদাবলিতে পুরাণের শক্তিদেবীর রুদ্র ভীষণ। ভয়ংকরা, অট্টহাসিনী রূপের মধ্যে শক্তিদেবীর ঐশ্বর্যরূপের পরিচয় প্রস্ফুটিত হয়েছে। শাক্তপদাবলিতে মায়াকে মহামায়ায় সমর্পণ, মায়ার ভিতর দিয়ে মহামায়ার রসাস্বাদন ও তত্ত্বের প্রকাশ আগমনী বিজয়া সঙ্গীতে ঐশ্বর্যাদি ভাবের প্রকাশ ঘটেছে। দেবী বালিকা চামুণ্ডারূপিনী, অট্টহাসিনী, খড়গধারিণী, নরমুণ্ডমালিনী রূপের মধ্যে দেবীর ঐশ্বর্য ভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে–

ঢলিয়ে ঢলিয়ে কে আসে, গলিত চিকুর আসর আবেশে 

বামারণে দ্রুত গতি চলে, দলে দানব দলে, ধরি করতলে গরজে গরাসে।”

কমলাকান্ত ও দেবীর মধ্যে ঐশ্বর্যভাবের বর্ণনা করেছেন–

“ইন্দীবর জিনিতনু সজল জলদ জিনি কায়া।

নীলামুজ নীলমরকত হিমবার দিনকর দিবা পুরজায়া।”

অশুভদলনী দেবীকে দেখে মনে হয় তিনি মধুর বাৎসল্যময়ী ও দৃপ্তশাসিকা শ্যামশ্রী জগন্মাতা। ঐশ্বর্য ও মানুষের এমন অপরূপ মিলন বাঙালির আধ্যাত্মিক সাধনায় অভিনব এবং মাতৃসাধনার অনন্যতার অভিজ্ঞান।

শক্তি ও মাধুর্যের সমন্বয়ী ভাব নানাভাবেই দেখা দিয়েছে শাক্তগানে। আগমনী-বিজয়া, জগজ্জননীর রূপ, মা কী ও কেমন, ভক্তের আকৃতি, ইচ্ছাময়ী মা, করুণাময়ী মা প্রভৃতি সকল পর্যায়েরই পদাবলিতে। ভক্তচিত্তের প্রার্থনায় ধ্বনিত হয়েছে অশুভ দলনের আর্তি এবং স্নেহাশ্রয় লাভের করুণ আকাঙ্ক্ষা। দাশরথির কণ্ঠে তাইতো ধ্বনিত হয়েছে–

“করো করো নৃত্য নৃত্য কালী, একবার মন সধে,

রণক্ষেত্রে মা! মোর হৃদয় মাঝে।

দেহের ভেদী ছ’জন কুজন,

এরা বাদী ভজন-পূজন-কাজে।”

দেবীর ঐশ্বর্যরূপের পাশাপাশি চিত্রিত হয় তাঁর মাধুর্য রূপের চিত্রখানিও। ভক্ত কবি রামপ্রসাদ সন্তানরূপে নিজের অধিকার প্রাপ্তিতে দেবীকে বাঙালি ঘরের মাতার ন্যায় মূর্তি দান করেছেন –

“মা খেলবি বলে ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতলে।

এবার যে খেলা খেলালে মাগো, আশা না পুরিল।”

‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ে সাধক কবি বহু পদেই দেবীকে সবৈশ্বর্যময়ী রূপের পাশাপাশি জননীরূপও দেখেছেন। একইসঙ্গে ঐশ্বর্য ও মাধুর্য রসের সমন্বয় ঘটেছে একটি পদে–

“বলমা আমি দাঁড়াই কোথা।

আমার কেহ নাই শঙ্করি হেথা

মার সোহাগে বাপের আদর, এ দৃষ্টান্ত যথা তথা।

যে বাপ বিমাতাকে শিরে ধরে,

এমন বাপের ভরসা বৃথা।”

কমলাকান্তের একটি পদে – গিরিরাজ কৈলাসে গমন করলেন সেখানে গিয়ে জামাতা শিবের সাথে গিরিরাজ দেখা না করে – ‘গমন করিল গিরি শয়ন মন্দিরে পিতাকে দেখে কন্যা ছুটে এলেন। যিনি জগজ্জননী শিরে ঘরোনী–

“জগজ্জননী তায় প্রণাম করিতে চায় 

নিষেধ করহে গিরি ধরি দুই করে।”

নিজের সন্তান হয়েও উমা আদ্যাশক্তি তাই গিরিরাজ তাঁর প্রণাম গ্রহণ করলেন না। এখানে একইসঙ্গে ঐশ্বর্য ও মাধুর্যরস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

ধর্মসমন্বয়ের আধ্যাত্মিক কল্পনা শক্তি ও মাধুর্যের মিলন-ভাবনাতেই সম্ভব হয়েছে শাক্ত পদাবলির মূল ভাব পরিস্ফুটন। সমকালীন বৈষ্ণব ভক্তিভাবনায় আপ্লুত হয়ে শাক্ত কবি তাঁর হৃদয়ের আর্তি জানিয়েছেন

“হৃদয়-তাসমন্দিরে, দাঁড়াত মা ত্রিভঙ্গ হয়ে

একবার হয়ে বাঁকা, দে মা দেখা, 

শ্রীধর বামে লয়ে।”

সমালোচক ত্রিপুরাশঙ্কর সেনশাস্ত্রী বলেছেন— “শাক্তসাধকগণ শুধু জগন্মাতার মাধুর্যলীলারই বর্ণনা করেন নাই, তাঁহার ঐশ্বর্যেরও বর্ণনা করিয়াছেন। ‘আগমনী-বিজয়া’র গানে জগদম্বার লীলা দশমহাবিদ্যার রূপ বর্ণনায় তাঁহার ঐশ্বর্যভাব প্রাধান্য লাভ করিলেও তাঁহার মাধুর্য ঘন দিব্যমূর্তির কথাও পুরাণকার বিস্মৃত হন নাই।”