(১) জীবনকথা: সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন অষ্টাদশ শতকের আনুমানিক দ্বিতীয় দশকে হালিশহর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের বিস্তৃত কাহিনী জানবার উপায় নেই। তিনি কোনো এক জমিদারের সেরেস্তায় গোমস্তা ছিলেন এরাণ একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় তাঁর যাতায়াতের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অস্তত কৃষ্ণচন্দ্র যে তাকে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি দিয়েছিলেন এবং তার বসবাসের জন্য প্রচুর নিষ্কর জমি ও বৃত্তি দান করেছিলেন, এটি ঐতিহাসিক সত্য। রামপ্রসাদ স্বগৃহে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা ক’রে গৃহী সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করতেন। তিনি কর্মজীবনের শুরু থেকেই স্বীয় অস্তরের প্রবর্তনায় শ্যামাসঙ্গীত রচনা করতেন। দেওয়ান রাজকিশোর রায়ের আদেশে রামপ্রসাদ ‘কালীকীর্তন’ গ্রন্থ এবং রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে ‘কালিকামঙ্গল’ তথা ‘বিদ্যাসুন্দর কাহিনী রচনা করেছিলেন। কালীমূর্তি বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও আত্মবিসর্জন করেন। এরূপ একটি বিশ্বাস এখনও প্রচলিত আছে।

কালের বিচারে কমলাকান্ত রামপ্রসাদের উত্তরাধিকারী। সম্ভবত রামপ্রসাদের দেহাবসানের স্বল্প পরেই কমলাকান্তের জন্ম। কাজেই উভয়ের মধ্যে যুগোচিত একটা ব্যবধান, যাকে একালে বলে generation gap তা অবশ্যই প্রত্যাশিত। এ ছাড়া দু’জনের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারেও একটি ব্যবধান ছিল বলে মনে হয়। রামপ্রসাদ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না, পক্ষান্তরে কমলাকান্ত যে বিভিন্ন শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন ক’রে স্বয়ং একটি চতুষ্পাঠীর অধ্যাপকপদে বৃত্ত হয়েছিলেন, এ ঘটনা সর্বজনজ্ঞাত।

(২) আগমনী-বিজয়া : রামপ্রসাদই বাংলা ভাষায় প্রথম শাক্ত পদাবলী রচনা করেন। শাক্ত পদাবলীর প্রধান দুটি ধারা— ‘উমাসঙ্গীত’ এবং ‘শ্যামাসঙ্গীত’; রামপ্রসাদ দুটি ধারাতেই পদরচনার প্রবর্তক হলেও ঊমাসঙ্গীতে তাঁর রচনার পরিমাণ খুবই নগণ্য। তিনি মূলত সাধক ছিলেন বলেই সাধনসঙ্গীত রচনাতেই প্রধানত আত্মনিয়োগ করেছিলেন। পক্ষান্তরে, দ্বিজ কমলাকান্তও ছিলেন সাধক কবি। তিনি প্রকৃতপক্ষে রামপ্রসাদের যথার্থ উত্তরসূরী। শাক্তপদ-রচয়িতাদের মধ্যে রামপ্রসাদের পর সর্বাধিক শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত নামটি কমলাকান্তের পরিমাণগত ও গুণগতভাবে তাঁর রচিত পদগুলিই অনেক সময় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। বিশেষত আগমনী বিজয়ার যে পদগুলি শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, তাদের অধিকাংশই কমলাকান্তের রচনা। এই পর্যায়ে কমলাকান্তই সম্ভবত শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করতে পারেন। এই পর্যায়ে রামপ্রসাদের পদের সংখ্যা এত কম যে গুণগতভাবে সেগুলি উৎকৃষ্ট বিবেচিত হলেও অপরের সঙ্গে তাকে তুলনা করা সঙ্গত নয়। আগমনী-বিজয়ার যে সামান্য কয়টি পদ রামপ্রসাদ রচনা করেছেন, তাতে তার গভীর আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া গেলেও এতে কোনো চরিত্রের বিশেষ রূপ কিংবা কোনো ভাবের বিশেষ তাৎপর্য ফুটে ওঠার অবকাশ পায়নি। পক্ষান্তরে কমলাকান্ত আগমনী-বিজয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের পদ রচনা করায় যেমন তার রচনার মধ্যে দিয়ে একটি কাহিনী গড়ে তোলা যায় তেমনি গিরিরাজ, মেনকা এবং উমার চরিত্র বৈশিষ্ট্যেরও পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর রচনায়। অতএব ‘আগমনী-বিজয়া’র পদ-রচনায় শুধু রামপ্রসাদ এবং কমলাকাত্তের মধ্যে একাত্তই তুলনা টানতে হয়, তবে বিজয়লক্ষ্মীর বরমাল্যটি যে কমলাকান্তের গলাতেই শোভা পাবে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

(৩) ভক্তের আকৃতি: ‘ভক্তের আকুতি’ এবং জগজ্জননীর রূপ’ অর্থাৎ উপাস্য-উপাসনা তত্ত্বের কথা যাবতীয় সাধনতত্ত্বের পদ রচনার পদপ্রদর্শক সাধক কবি রামপ্রসাদ সাধনার ভাবে তিনি আত্মসমাহিত, সম্ভবত তিনি সাধনার সর্বোচ্চ স্তরেই উপনীত হয়েছিলেন— ফলে উপাস্যা দেবীর সঙ্গে তার বেলায় সম্বন্ধ যতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, তেমনটি অপর কোনো কবির বেলায়ই হয়নি— এমনকি সাধক কবি কমলাকান্তও সেই পর্যায়ে আরোহণ করতে পারেননি। বলে কোনো কোনো সমালোচক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। একটি অতি সাধারণ দৃষ্টান্ত থেকেই ব্যাপারটি স্পষ্টতর হতে পারে। রামপ্রসাদ সর্বত্র তার গানে অবাধ্য দেবীকে শুধু ‘মা’ এই একাক্ষর শব্দেই অভিহিত করেছেন। তার রচিত পদসমূহে ‘মা’ শব্দটির একেবারে ছড়াছড়ি। পক্ষান্তরে কমলাকান্ত কখনও ‘জননী’র ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন নি এবং তারও সংখ্যা অতি সীমিত। এর মধ্যেই সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কার কতখানি ছিল, তা অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না।

অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “শক্তি সাধনার নানা স্তর আছে। রামপ্রসাদ সিদ্ধির ঊর্ধ্বস্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন, কমলাকান্ত হয়তো ততদুর পৌঁছিতে পারেন নাই। রামপ্রসাদ মাতৃসাধনার সুউচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন বলিয়াই এবার কালী তোমায় খাব’ বলিয়া স্পর্ধা প্রকাশ করিতে পারিয়াছিলেন। যে সাধনশক্তি আয়ও হইলে সাধক লয়মুক্তি লাভ করিতে পারেন, রামপ্রসাদ তাহার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তিনি লয়মুক্তি কামনা করেন নাই বলিয়াছেন, ‘নির্বাণে কি ফল বল না’ অথবা ‘চিনি হওয়া ভাল নয়, চিনি খেতে ভালবাসি। কমলাকান্ত এই চিনি খেতে ভালবাসি’র স্তর পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিলেন তর্ধ্বে উঠেন নাই। তাহার ‘মজিল মনভ্রমরা কালীপদ নীলকমলে’—পদটিতে মাতৃ চরণ-কমল-মধু পানের আবিষ্টতাও তদ্‌গতচিত্ততার অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে। অবশ্য ইহাও একপ্রকার মুক্তির অবস্থা।”

এ বিষয়ে অধ্যাপক ত্রিপুরাশঙ্কর সেনশাস্ত্রী অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, বাংলার এই দুইজন শ্রেষ্ঠ শক্তিসাধকের রচনাবলীর ওপর নির্ভর করিয়া এরূপ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার অধিকার আমাদের নাই। কোনো সাধক সাধনার কোন স্তরে পৌঁছিয়াছেন সাধক বা সিদ্ধপুরুষগণই তাহার বিচার করিতে পারেন। আমরা শুধু এইটুকু জানি যে, রামপ্রসাদের সাধন-সঙ্গীতের ন্যায় কমলাকান্তের গানগুলিও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। অবশ্য যে ভাষায় শ্রীরামপ্রসাদ জগন্মাতাকে ভর্ৎসনা করিয়াছেন অথবা তাহার নিকট আব্দার ও অভিমান করিয়াছেন, সে ভাষা কমলাকাত্তের পদাবলীতে নাই। কিন্তু ইহার মূলে হয়তো আছে উভয় সাধকের প্রকৃতিগত পার্থক্য।” সাধক কমলাকান্তও যে সাধনার উচ্চস্তরে অধিরূঢ় হয়েছিলেন, তার প্রমাণস্বরূপ অধ্যাপক সেনশাস্ত্রী কমলাকান্ত রচিত ‘সদানন্দময়ী কালী পদটির উল্লেখ করেছেন।

‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ের পদগুলিতে শাক্ত কবিদের কামনায় কোনও পার্থিব সম্পদ নেই, এমন কি তারা মুক্তি কামনাও করেননি, শুধু মায়ের অভয় পদের দিকেই তাঁরা লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। রামপ্রসাদ বলেন

‘দুর্গা দুর্গা বলে তরে গেল পাপী কত।

একবার খুলে দে চোখের ঠুলি, দেখি শ্রীপদ মনের মত।।

কুপুত্র অনেক হয় মা কুমাতা নয় কখন তো।

রামপ্রসাদের এই আশা মা অন্তে থাকে পদানত।।’

কামনার দিকে কমলাকাস্তও রামপ্রসাদের মতই শুধু মায়ের চরণ-প্রত্যাশী। তিনি বলেন

‘মা না করি নির্বাণ আশ    না চাহি স্বৰ্গাদি বাস,

নিরখি চরণ দুটি হৃদয়ে রাখিরে।’

সমন্বয় সাধনার দিক থেকেও রামপ্রসাদ এবং কমলাকাণ্ডের রচনায় বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। রামপ্রসাদ গেয়েছেন

‘কালী হলি মা রাসবিহারী 

নটবর বেশে বৃন্দাবনে।’

কমলাকাস্তও অনুরূপভাবেই চিন্তা করেন

‘জানে নারে মন,    পরম কারণ,

কালী কেবল মেয়ে নয়,

মেঘের বরণ    করিয়ে ধারণ

কখন কখন পুরুষ হয়।।

কভু প্রজপুরে আসি,    বাজাইয়ে বাঁশী

ব্রজাঙ্গনার মন হরিয়ে লয়।।’

‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ের পদে পদকর্তারা সকলেই কিন্তু নিজেদের জগজ্জননীর সস্তানরূপে পরিচয় দিয়েছেন, ফলত এর মধ্যে মাতৃসাধনার ভাবই পরিব্যক্ত। এর রস মূলত ভক্তিরস, অথবা উমা সঙ্গীতের বাৎসল্য রসের বিপরীতক্রমে একে বলতে পারি প্রতি বাৎসল্য রস। এতে আছে সস্তানের অভিযোগ, রামপ্রসাদের ভাষায়—

‘কোন্ অবিচারে আমার পরে করলে দুঃখের ডিক্রি জারি।’ 

মা, নিম খাওয়ালে চিনি বলে কথায় ক’রে ছলো।

ওমা মিঠার লোভে, তিতমুখে সারা দিনটা গেল।।’

শুধু অভিযোগই নয়, রামপ্রসাদের অভিমানও স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে

‘আমায় কি ধন দিবি তোর কি ধন আছে

তোমার কৃপাদৃষ্টি পাদপদ্ম, বাঁধা আছে হরের কাছে।’

সংসারে থেকে সংসার-ধর্ম ক’রে সাধক কবি তো আর ত্রিতাপ জ্বালার হাত থেকে নিস্তার পেতে পারেন না। তাই কবিকে মুখ ফিরিয়ে আবার তাকাতে হয় মায়ের দিকেই—

‘বল্ মা আমি দাঁড়াই কোথা?

আমার কেহ নাই শঙ্করী হেথা।’

‘ভক্তের আকৃতি’র শেষ কথা – পরম শরণাগতির আকুতি। নির্মাণমুক্তি শাক্তভক্তের কামনা নয়, তার কামনা জীবন্মুক্তি। মুমুক্ষু ভক্তের শরণাগতির মাতৃচরণে প্রপত্তির আকাঙ্ক্ষাই জীবমুক্তির আকাঙ্ক্ষা – কবি রামপ্রসাদের ভাষায়

‘এমন দিন কি হবে তারা, 

যবে তারা তারা তারা বলে 

তারা বেয়ে পড়বে ধারা।’

আগমনী-বিজয়া-সঙ্গীতে কমলাকান্ত অনেকখানি এগিয়ে থাকলেও ভক্তের আকৃতি পর্যায়ে তিনি রামপ্রসাদের মতো এতো বৈচিত্র্য এবং আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেন নি। এই পর্যায়ের পদে আরও কোনো কোনো কবিও কমলাকান্তের তুল্য কৃতিত্ব প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন।

(৪) সামগ্রিক তুলনা: সামগ্রিকভাবে রামপ্রসাদ আর কমলাকান্তের রচনার তুলনামূলক আলোচনায় বলা চলে যে আগমনী-বিজয়ার পদে কমলাকান্ত সার্থকতর, অন্যত্র রামপ্রসাদই প্রধান ব্যক্তি। রামপ্রসাদ এবং কমলাকান্ত— উভয়েই ছিলেন সাধক কবি। তবে রামপ্রসাদ যতটা ছিলেন কবি, তার চেয়ে বেশি তিনি সাধক – তাই তাঁর কাব্যসৃষ্টিতে কোনো সযত্ন প্রয়াস লক্ষিত হয় না। পক্ষান্তরে কমলাকাস্ত ছিলেন সচেতন শিল্পী, উৎকৃষ্ট বাছাই করা শব্দের সমাহারে তাঁর রচিত পদ নিটোল গীতিকাব্যের রূপ পরিগ্রহ করেছে। রামপ্রসাদের পদ যেমন শুধুই গেয়, সুর-বর্জিত পাঠে এর মনোহারিত্ব থাকে না, কমলাকাস্তের পদ তেমন নয়। একালের গীতিকবিতার মতোই এগুলি পাঠ-যোগ্যও বটে।

এঁদের দু’জনের মধ্যে আরও একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। রামপ্রসাদের কবিত্ব ছিল সহজাত, অপৃথগ্যত্নপ্রতিপাদ্য। তাই তাঁর সাধনা প্রকাশের ভাষাই ছিল কবিতা। কমলাকান্ত ছিলেন পণ্ডিত কবি। কবিত্ব প্রকাশের জন্য তিনি বিষয়বস্তুকে গ্রহণ করেছিলেন যেমন তাঁর সাধনার বস্তুকে, তেমনি অপর সাধারণ বিষয়কেও যেমন রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী।

কমলাকাস্তের পদে বৈষ্ণব ভাবের প্রবলতা লক্ষ্য করা যায়, তুলনামূলকভাবে রামপ্রসাদের বৈষ্ণব প্রভাব অপেক্ষাকৃত গৌণ। কমলাকান্তের পদে শুধু বৈষ্ণবোচিত বিনয়ই নয়, তিনি বৈষ্ণব পদের মতো ব্রজবুলি ভাষাতেও কোনো কোনো পদ রচনা করেছিলেন। তার পদের ভণিতায় বৈষ্ণবপদকর্তাদের অনুকৃতি রয়েছে। আবার বৈষ্ণবপদকর্তাদের মতই কমলাকান্ত ‘আগমনী-বিজয়া’ সঙ্গীতে কখন কখন দ্রষ্টা, উপদ্রষ্টা বা দাস-রূপে ভণিতা রচনা করেছেন।

রামপ্রসাদ ও কমলাকাস্তের তুলনা প্রতিতুলনায় অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন— বৈষ্ণব পদাবলী রচনায় চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাস কবিরাজের যে পার্থক্য, শাক্ত পদাবলী রচনায় রামপ্রসাদ এবং কমলাকান্তের মধ্যেও সেই পার্থক্য। একজন ভাবতন্ময়, আত্মহারা- অন্যজন সচেতন শিল্পী, একজন সরল অনাড়ম্বর—তাহাতে ছন্দনৈপুণ্য নাই, বাকচাতুরী নাই আছে আত্মহারা ভক্তের আত্মহারা ভাব; অপরজন আত্মময় হইলেও আত্মহারা নহেন, তাহার বিচার আছে, সংযম আছে—তাই ছন্দের মাধুরী ও শ্রুতিমধুর শব্দ ঝঙ্কারের প্রতি তাঁহার সজাগ দৃষ্টি, রসনারোচন, শ্রবণ বিলাস, রুচির পদ’-এর আকর্ষণ।” কমলাকান্ত যে শুধু রূপসজ্জার দিক থেকেই রামপ্রসাদকে অতিক্রম ক’রে গেছেন তাই নয়, কবিত্বের দিক থেকেও তার কোনো কোনো পদ রামপ্রসাদের অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট—এগুলিকেও বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ বিবেচনা করা চলে।

কমলাকান্ত সচেতনভাবেই রামপ্রসাদের অনুসরণ ক’রে শাক্তপদ রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। উভয়েই সমানধর্মী বলে ব্যাপারটা তার কাছে অনেক সহজ এবং স্বাভাবিক ছিল। ফলে কমলাকান্তের রচনায় বহুস্থলেই রামপ্রসাদের শুধু অনুসরণ নয়, অনুকরণও আছে, এমন কি শব্দ প্রয়োগে সাদৃশ্যই বহুস্থলে লক্ষ্য করা যায়। রামপ্রসাদের প্রভাব ছিল সম্ভবত তার ওপর অনিবার্যভাবেই। এই প্রসঙ্গে কমলাকাস্তের অন্যতম জীবনীকার যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলেন— “এইরূপ অনেক সঙ্গীতেই কমলাকাস্তের গানের ওপর রামপ্রসাদের প্রভাব দেখা যায়। তাহাতে দোষের কিছু নাই। রামপ্রসাদের বহু প্রচলিত সঙ্গীতসমূহ তো আর কমলাকান্তের অজ্ঞাত ছিল না। আর মহাকালীর উপাসক দুই মহাসাধকের সঙ্গীতের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা অসম্ভব নহে। কেন না, উভয় সাধকেরই নবজলধরকায় কালরূপে আঁখি জড়াইয়াছিল। উভয়েই অনন্তরূপিণী মহাকালীর চরণপদ্মের ছিলেন যুগল ভ্রমর। “

(৫) রামপ্রসাদের জনপ্রিয়তা: শাক্ত কবিদের মধ্যে কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন যে সর্বাধিক জনপ্রিয়, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাঁর জনপ্রিয়তার পেছনে কাব্যোৎকর্ষ কিছুটা দায়ী হ’লেও এটিই একমাত্র কারণ নয়। শাক্ত পদাবলীর প্রথম প্রবর্তক রামপ্রসাদ তার জনপ্রিয়তার এটি একটি মুখ্য কারণ। শাক্ত পদাবলীর একটি নামান্তর প্রসাদী সঙ্গীত’— বলা বাহুল্য রামপ্রসাদের নামের সঙ্গেই এটি যুক্ত হয়ে আছে। অনেক অভা পাঠক এবং শ্রোতা এই ‘প্রসাদী সঙ্গীত’ নামের দৌলতে যাবতীয় শাক্ত পদাবলীকেই রামপ্রসাদের রচনা বলে বিবেচনা ক’রে থাকেন। এটিও রামপ্রসাদের প্রচারে আনুকূল্য বিধান করেছে। কবিবর ঈশ্বর গুপ্ত ১৮৩৩ খ্রিঃ রামপ্রসাদের জীবনী এবং তার রচিত ‘কালীকীর্তন’ প্রকাশ করায় শিক্ষিত সমাজে তিনি অপর শাক্ত কবিদের তুলনায় অনেক আগেই পরিচিতি লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন।

এ সমস্ত কারণ ছাড়াও যে কারণে রামপ্রসাদ বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, সে বিষয়ে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন– “সারা দেশে রামপ্রসাদের জনপ্রিয়তার একটা কারণ বাস্তব দুঃখকে তিনি বৈষ্ণব পদাবলীর মতো সূক্ষ্ম রসে পরিণত করেন নাই; তাহাকে স্বীকার করিয়া তাহা হইতে মুক্তির পথ খুঁজিয়াছেন। দুঃখবেদনা হইতে পলায়ন নহে, তাহার দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়াও নহে— আদ্যাশক্তির কৃপায় কবি সমস্ত সুখ-দুঃখ ত্যাগ করিয়া মুক্তির পথ খুঁজিয়াছেন। তখন কবি বলেন—

‘আমি কি দুঃখেরে ডরাই….’

কবি দুঃখের আঘাতে আরও নিবিড় করিয়া জননীকে চিনিয়া লইয়াছেন—এইজন্যই দুঃখ লইয়া তাহার বড়াই, শ্যামার দেওয়া দুঃখ তাঁহাকে অগ্নিশুদ্ধ স্বর্ণের মতো বিশুদ্ধি দান করিয়াছে। কবি দেখিয়াছেন, দুঃখ হইতে পরিত্রাণের পথ শ্যামার চরণে আশ্রয় গ্রহণ একযুগের বাঙালী এ কথায় বড়ো সান্ত্বনা পাইয়াছিল। তদানীস্তন কুশাসন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নিত্য দারিদ্র্য— ইহা হইতে মুক্তির পথ কোথায়? সেই পথই রামপ্রসাদ দেখাইয়াছেন। কাজেই তার গানের মধ্যে দুঃখবেদনার কথা থাকিলেও সেই দুঃখবেদনা প্রসাদী সঙ্গীতে ফলশ্রুতি নহে—বাস্তব দুঃখ হইতে সাধনার চিদানন্দময়লোকে উত্তরণই কবির অভিপ্রেত সাধারণ গৃহী মানুষ ইহা হইতে আশার আলোেক লাভ করিয়াছে, মুমুক্ষু ইহা হইতে মুক্তি মোক্ষের এষণা লাভ করিয়াছে, লীলারসিক এই সমস্ত গানে মাতাপুত্রের বাৎসল্য রসের সম্পর্ক দেখিয়া তৃপ্ত হইয়াছে। এইজন্যই বাঙালী জাতির বিশেষ ঐতিহাসিক ক্ষণের সঙ্গে রামপ্রসাদের পদাবলী জড়াইয়া গিয়াছে। ত্রিতাপজার মানুষের সান্ত্বনার বাণী আছে বলিয়া ইহার কাব্যমূল্য যেমনই হোক না কেন, বাঙালী মানসে ইহার বিশেষ প্রভাব ও চিরকালীন আবেদন অস্বীকার করা যায় না।

ধর্মীয় উদারতা রামপ্রসাদের প্রিয়তার অপর প্রধান কারণ। “আমার ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে – এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি সাম্প্রদায়িক ধর্মবিদ্বেবের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। শাস্ত্র বা পূজার উপকরণের তুচ্ছতার বিষয়ে তিনি বলেন—

‘জাঁক জমকে করলে পূজা অহঙ্কার হয় মনে মনে

তুমি লুকিয়ে তারে করবে পূজা,

জানবে না রে জগজ্জনে।’

ঈশ্বর আরাধনা একান্তভাবেই উপলব্ধির বিষয়। তার এই উদার দৃষ্টিভঙ্গিটি ধরা পড়েছে নিম্নোক্ত পদটিতে—

‘মন কর কি তত্ত্ব তারে

ওরে উন্মত্ত আঁধার ঘরে। 

সে যে ভাবের বিষয় ভাবব্যতীত 

অভাবে কি ধরতে পারে ….

প্রসাদ বলে আমি মাতৃভাবে তত্ত্ব করি যারে

সেটা চাতরে কি ভাঙবো হাঁড়ি 

বুঝরে মন ঠারেঠোরে।।’

রামপ্রসাদের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ যে তাঁর এই সহনশীল সর্বজনীন উদার দৃষ্টিভঙ্গী, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।