“শশী চরিত্রে দু’টি সুস্পষ্ট ভাগ আছে। একদিকে তাদের মধ্যে যেমন কল্পনা, ভাবাবেগ ও রসবোধের অভাব নাই, অন্যদিকে তেমনি সাংসারিক বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তির প্রতি মমতাও তাহার যথেষ্ট। তাছাড়া কল্পনার অংশটা গোপন ও মুক।”—তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র নায়ক শশী চরিত্রের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে। শশী গাওদিয়া গ্রামের ছেলে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে এসে গ্রামে ডাক্তারী করছে। তার জীবন অভিজ্ঞতার কাহিনী ‘পুতুল নাচের ইতিকথার’ মূল আখ্যান। শশী গ্রাম বাংলার মানুষ, গ্রামকে ভালোবাসে, গ্রামের মানুষজনের উপকারে সে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করে। তার পরার্থপরায়ণতা ও সেবার মনোভাব তাকে গ্রামে এক নায়কোচিত মর্যাদা দিয়েছে। সে সকলের হৃদয়রাজ্যের নায়ক হয়ে উঠেছে। এই গ্রামের সঙ্গে জড়ানো তার জীবন। এটা তার সত্তার এক দিক। সে গ্রামের মধ্যে একাকার হয়ে মানুষের সুখে-দুঃখের সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু গ্রামজীবনের সঙ্কীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, হানাহানি তাকে ক্লান্ত করে তোলে। সে তার “নূতন জগতে, নূতন ধারায় জীবন আরম্ভ করিতে চায়।” শশী চরিত্রের মধ্যে এই দুই সত্তার স্ববিরোধ বর্তমান। ব্যক্তিত্বের মধ্যে দুই দিকের আকর্ষণ তাকে আন্দোলিত করে। তার মনে সাম্যুস্যের অভাব সৃষ্টি করে। নানা ব্যাপারে সে বুদ্ধিমান ও সংযমী। কখনও সে অকস্মাৎ কোনো কিছু করে না। এই সকল গুণ সংসারে টিকে থাকার পক্ষে প্রয়োজন। মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে সহিষ্বতা তার অসাধারণ। তার দায়িত্ববোধের প্রশংসা মানুষের মুখে মুখে। শশী কর্মী মানুষ। কর্ম জগতের নিষ্ঠা তার চরিত্রের বাস্তববুদ্ধিতার পরিচায়ক। সেনদিদিকে অক্লান্ত সেবা ও নিষ্ঠা দিয়ে ভালো করে তুলে, সে তার পসার বাড়িয়ে দেয়। সে ব্যস্ত চিকিৎসক। কিন্তু তার মনের গোপন কোণে আছে কল্পনার উৎস। কল্পনা মানুষকে দূরের জগতে পৌঁছে দেয়। তার কল্পনা তার মধ্যে প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতি আকৃতিকে সার্থক করে তুলেছে। তার কল্পনা প্রেরণার নিদর্শন কুসুমের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক। কুসুমের হাস্য-লাস্য, কিশোরী সুলভ চাঞ্চল্য, নানা ভাবে-রূপে-দৃশ্যে-ভঙ্গীতে তার গোপন প্রণয়ের আত্মপ্রকাশে তাকে সৌন্দর্যপিয়াসী করে তুলেছে। তালপুকুরের ধারে সে মিলিত হয়। এই সংক্ষিপ্ত কালাতে তার কল্পনাপ্রিয়তার প্রকাশ উপস্থিত হয়। তালবনে শশীর কল্পনার মাধুরী পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, তাই কুসুম চলে যাবার পর সে আর তালবনে যায় না। কুসুমের প্রেম নিবেদন ও দেশত্যাগের মধ্যে দিয়ে শশীর কল্পনা নারী হৃদয় রহস্যকে জানতে চায়। কুসুমের বিচ্ছেদ শশীকে বিপর্যস্ত করে দেয়। দুই সত্তার বিরোধ শশীর মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে।
“গাওদিয়ার লোকসমাজ তাহাকে পরিহাস করিয়া বলিত ভদ্দর লোক।”—কার চরিত্র সম্পর্কে একথা বলা হয়েছে? উক্তিটির তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।
গাওদিয়া গ্রামের হারু ঘোষের চরিত্র সম্পর্কে এই উক্তি করা হয়েছে।
হারু ঘোষ গাওদিয়ার মতো গণ্ডগ্রামে মানুষ হয়ে অনেকখানি উচ্চাশী হয়ে উঠেছিল। হারু গোপসমাজের সঙ্কীর্ণ পরিসর থেকে সরে গিয়ে স্বতন্ত্র পথে জীবনের সাফল্যকে দেখতে পেয়েছিল। হারু দরিদ্র হয়ে জন্মেছিল, গোপ সমাজের দারিদ্র্য সে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিল। কিন্তু নিজের চেষ্টায় বাড়ির অবস্থা ফিরিয়েছিল। সে বড়লোক হয়েছিল। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ ফিরিয়েছিল। হারু ছিল যথেষ্ট চালাক, তাই বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়োগ করে সে বাড়ির অবস্থা ফিরিয়েছিল। গোপেরা দুগ্ধ ব্যবসায়ী, তাই তারা সঙ্কীর্ণ পরিধির বাইরে কোনো কিছুই ভাবতে পারে না। হারু ঘোষের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল উঁচু স্তরের। সে অবস্থাপন্ন হয়েছিল আবার পরে দরিদ্র ও হয়ে গিয়েছিল। সে জীবনের উত্থান-পতনকে বোঝে। তাই কন্যার বিয়ের জন্য সে বাজিতপুরে সম্বন্ধ দেখতে গিয়েছিল। বাজিতপুরে মোটর চলে, গাওদিয়ায় চলে না। তুলনায় গাওদিয়া থেকে বাজিতপুরের সামাজিক অবস্থা বেশি ভাল। তাই মেয়ের বিবাহের জন্য সেখান থেকে পাত্র আনাই বাঞ্ছনীয়। গ্রামের নিম্নবর্ণের মানুষ সঙ্কীর্ণ পরিবেশে বাঁচে, তাই আত্মতৃপ্তিই তাদের সম্বল। তাদের চাওয়া-পাওয়া সীমিত। যারা এর বাইরে চলে যায়, তাদের লোকে ভদ্দরলোক বলে ব্যঙ্গ করে। কারণ ভদ্দরলোক হতে গেলে গাওদিয়ার সঙ্কীর্ণ সীমা ভেঙে এগোতে হয়। হারুও অনেকটা সেইরকম শ্রেণীর মানুষ। তারা উচ্চাশার জন্যই সে ছোটবেলায় স্কুলে পড়ে বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখে এবং শেষ পর্যন্ত সঙ্গতিপন্ন হয়ে ওঠে। নিতাই গোপসমাজের মানুষ। তার প্রকৃতি ছিল সঙ্কীর্ণ। সে হারু ঘোষের এই ধরনের প্রবণতাকে ভদ্দরলোকের প্রবণতা বলে মনে করত। নিতাই তার ভাগ্নে সুদেবের সঙ্গে মতির বিবাহের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হারু রাজী হয়নি। বাজিতপুরের পাত্র ম্যাট্রিকুলেশন পাশ। তাই সেখানকার পাত্র দেখতে গিয়ে অকালে তার প্রাণ গেল। ‘ভদ্দরলোক’ হতে গিয়ে হারু ঘোষকে এই দণ্ড দিতে হল। বাদল সন্ধ্যায় এক জনমানবহীন স্থানে, সর্পসঙ্কুল ভূমির বুকে বটগাছের গুঁড়িতে বৃষ্টি-বজ্র থেকে রক্ষা পেতে গিয়ে হারু ঘোষ স্বর্গে চলে গেল।
Leave a comment