শরৎচন্দ্রের এমন কতকগুলাে রচনা আছে যাদের মধ্যে উপন্যাসের বিস্তৃতি ও জটিলতা নেই, আবার এই ক্ষুদ্রায়তন গল্পগুলাের মধ্যে ছােটগল্পের ভাবসংহতি, একটা বিশেষভাবে চকিত স্ফুলিঙ্গ দীপ্তিতে জীবনের উদ্ভাস, তার রসনিটোলতা আমরা দেখতে পাই না। বস্তুত তার অধিকাংশ বড় গল্পগুলােই সংক্ষিপ্ত উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত।
শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’ (১৯১৪), ‘রামের সুমতি’ (১৯১৪), ‘কাশীনাথ’, ‘মেজদিদি’, ‘মামলার ফল’ (১৯২০), ‘হরিলক্ষ্মী’ (১৯২৬), ‘পরেশ’ (১৯২৪) প্রভৃতি গল্পগুলােতে বাঙালী পরিবারের বিরােধ ও স্বার্থ এবং বিশেষ মানসিক প্রবণতাসঞ্জাত ঘাত-প্রতিঘাত নিখুঁত বাস্তবতায় চিত্রিত হয়েছে। অন্যান্য লেখকদের তুলনায় শরৎচন্দ্রের গল্পে পারিবারিক জীবনে স্নেহপ্রেম প্রভৃতি আবেগ-অনুভূতির বঙ্কিম গতির চিত্রণে বাস্তবতার সুর আরও তীক্ষ্ণ ও অসংশয়িত। এক পক্ষ প্রবল অত্যাচারী ও অন্যপক্ষ দুর্বল, নিরীহ ও অসহায়, পূর্বে পারিবারিক জীবনচিত্রণের এই সরলীকরণ শরৎচন্দ্র গ্রহণ করেন নি। তার গল্পগুলােতে আমরা দেখি, প্রতিটি চরিত্রই দোষ ও গুণে গঠিত, বিরােধের উৎস মূলত তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেই নিহিত বলে তার দায়িত্ব প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই প্রায় সমান। বিন্দুর ছেলে’তে পালিত পুত্র আমুল্যধনের প্রতি বিন্দুর তীব্র স্নেহাতিশয্য, মাত্রাজ্ঞানের অভাব, নিদারুণ অভিমান ও অসহিষ্ণুতা, ঐশ্বর্যের অহংকার—তার চরিত্রের তীক্ষ্ণ বৈশিষ্ট্যগুলােই বিরােধের পটভূমিকাকে প্রস্তুত করেছে; এলােকেশী ও নরেনের আবির্ভাবে বাইরের কারণটাকে অবলম্বন করে পারিবারিক বিরােধ ধূমায়িত ও অবশেষে প্রজ্বলিত হয়েছে।
‘রামের সুমতি’তে অবশ্য রামের দুর্দমনীয় দুরন্তপনা ও নারায়ণীর মাতার সংকীর্ণতা, ঈর্ষার পারিবারিক বিরােধের জটিলতা সৃষ্টি করেছে। ‘মেজদিদি’ গল্পে বাড়ির বড়বউয়ের ভাই অনাথ কেষ্টর প্রতি মেজবউ হেমাঙ্গিনীর সহানুভূতিসঞ্জাত স্নেহ চারিদিকের বাধাপ্রতিকূলতায় স্বাভাবিক আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে না পেয়ে কেষ্ট ও তার সম্পর্কে যেমন, তেমনি পারিবারিক জীবনেও সমস্যার আবর্ত সৃষ্টি করেছে। ‘মামলার ফল’-এও স্নেহের বক্র, তির্যক গতি চিত্রিত। আখ্যানাংশ অনেকটা পরিমাণে মেজদিদি’র অনুরূপ। ‘হরিলক্ষ্মী’তে ভ্রাতৃবিরােধ কিভাবে দুই ভাই এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পারস্পরিক সম্পর্ককে দ্বন্দ্ব-জটিল এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিষাক্ত ও নির্মম করে তােলে, তারই একটা মনােঞ্জ ক্ষুদ্র চিত্র দেওয়া হয়েছে। এখানেও আমরা দেখি, হরিলক্ষ্মী এবং তার ছােট জায়ের চরিত্র ভাল মন্দ মিশ্রিত। ‘পরেশ’ গল্পটিতে ভ্রাতৃবিরােধের চিত্রণ ভাবালুতার অসংযমের জন্য রসােত্তীর্ণ হতে পারে নি।
শরৎচন্দ্রের কোনও কোনও গল্পে মানবচরিত্রের বিচিত্র রহস্য ও সাধারণ জীবনের দুঃখদৈন্য বিড়ম্বনার মর্মস্পর্শী কারুণ্য চিত্রিত হয়েছে। শরৎচন্দ্র তাঁর গভীর জীবনানুসন্ধানী দৃষ্টিতে হীন ও নীচের মধ্যেও মহত্ত্বের যে বিচিত্র স্ফুরণ আবিষ্কার করেছেন, ‘একাদশী বৈরাগী’ (১৯১৮) গল্প তার সেই মানব-মহিমাবােধের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একাদশী একদিকে চক্ষুলজ্জাহীন, কঠোর-হৃদয়, সুদখাের, কিন্তু এই কঠোরতার পাষাণস্তুপের মধ্যেও তার ভগিনীর প্রতি ঐকান্তিক স্নেহ ও অর্থ সম্বন্ধে অটল ধর্মজ্ঞানের ফলধারা প্রবাহিত হয়েছে।
শরৎচন্দ্রের শিল্পীহৃদয়ের সমবেদনাক্নিগ্ধ দুটি নিটোল ছােটগল্প ‘অভাগীর স্বর্গ’ ও ‘মহেশ’। কেবলমাত্র এই দুটি রচনার মধ্যেই ছােটগল্পের রূপরস পূর্ণমাত্রায় পাওয়া যায়, এখানে অন্যান্য গল্পের কাহিনী চরিত্রের পল্লবিত বিস্তারের পরিবর্তে ছােটগল্পের কেন্দ্রীয় ভাবসংহতিসঞ্জাত শিল্পরূপ লক্ষ্য করি। ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের নায়িকা দুলে ঘরের চিরদুঃখিনী, স্বামীপরিত্যক্তা কাঙালীর মা অভাগী, ব্রাহ্মণ জমিদার গৃহিণীর শেষকৃত্যের বিপুল সমারােহ, ‘পুত্রহস্তের মন্ত্রপুত অগ্নির সংযােজনে প্রজ্বলিত চিতা’ দেখে নিজের জন্যেও এরপ সকারের কামনায় ব্যাকুল হয়েছে। কিন্তু মায়ের সামান্য সাধটুকু পূর্ণ করতে গিয়ে হতভাগ্য দারিদ্রঘরের কাঙালিচরণ এই মনুষ্যত্বহীন সমাজের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছে।
‘মহেশ’ গল্পটিতে করুণরস আরও গভীর ও মর্মস্পর্শী। আমাদের উচ্চবর্ণ শাসিত হিন্দুসমাজের নিষ্ঠুর নীচতার পটভূমিতে মূক প্রাণী মহেশের প্রতি দরিদ্র মুসলমান কৃষক গফুরের ঐকান্তিক বাৎসল্য, তার দারিদ্র্যবিড়ম্বিত জীবন, সমাজের নির্মম অত্যাচার, মহেশকে প্রতিপালন করতে না পারার জন্যে গভীর মর্মবেদনা, অভাবের তাড়নায় তার সাতপুরুষের ভিটা ত্যাগের সময় বেদনায় দীর্ণ তার হৃদয় রচনাটিতে সংহত রূপ লাভ করেছে।
‘মন্দির’ (১৯০৩), ‘দর্পচূর্ণ (১৯১৫), ‘বােঝা’, ‘অনুপমার প্রেম’ (১৯১৭), ‘আলো ও ছায়া’ (১৯১৭), ‘কাশীনাথ’ (১৯১৭), ‘স্বামী’ (১৯১৮), ‘নববিধান’, ‘সতী’ (১৯৩৪) প্রভৃতি গল্পগুলােতে মূলত সমাজবিধির সীমাতেই দাম্পত্যপ্রেম ও বিরােধ চিত্রিত হয়েছে।
১৯০৩ সালে শরৎচন্দ্র ‘মন্দির’ রচনা করে কুন্তলীন পুরস্কার লাভ করেন। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যসাধনার উন্মেষ পর্বের এই রচনাটিতে নায়ক নায়িকার বাল্যজীবনের আবহচিত্রণে, তাদের মনস্তত্ত্বের ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত দানে, অপর্ণার দাম্পত্যজীবনের অসামঞ্জস্য, স্বামীর সঙ্গে তার প্রণয়ােন্মেষের পথে সূক্ষ্ম বাধা-অন্তরায়গুলির ‘মনস্তাত্ত্বিক-চিত্রণকৌশল-চিহ্নিত’ বর্ণনায় শক্তিনাথের প্রতি অপর্ণার ‘কঠোর কোমলে মেলা’ মনােভাবটির রূপায়ণে, সংযমের সঙ্গে কাহিনীর পরিণতির করুণরসের পরিস্ফুটনে শরৎচন্দ্রের পরিণত প্রতিভার পূর্বাভাস লক্ষণীয়।
১৯১৭ সালে প্রকাশিত হলেও ‘বােঝা’ শরৎচন্দ্রের প্রথম বয়সের রচনা। ভাবােচ্ছাস-প্রবণ, খেয়ালী সত্যেন স্ত্রীর মৃত্যুর পর নলিনীকে বিবাহ করলেও পূর্ব স্ত্রীর স্মৃতির রােমন্থনে এবং অকারণ অভিমানে দ্বিতীয়া স্ত্রীর প্রতি বিমুখ হয়ে তাকে পরিত্যাগ করে তৃতীয়বার বিবাহ করে, আর সপত্নীকে স্বামী প্রদত্ত আংটিটি উপহার দিয়ে নলিনীর ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণে ‘বােঝা’র উপসংহার রচিত হয়। এই করুণ রসাত্মক কাহিনীটির মধ্যে এবং চরিত্র- চিত্রণে জীবনদৃষ্টির কোনও গভীরতা লক্ষিত হয় না। রচনাভঙ্গিতে শরৎচন্দ্র সম্পূর্ণরূপেই বঙ্কিমচন্দ্রকে অনুসরণ করেছেন।
‘অনুপমার প্রেম’ ও শরৎচন্দ্রের প্রতিভার স্বকীয়তাবর্জিত। গল্পের উপক্রমণিকায় পিতামাতার আদরিণী কন্যা অনুপমার অবাস্তব আতিশয্যপূর্ণ প্রেমস্বপ্নবিহুলতার ব্যঙ্গমিশ্রিত চিত্রণে এবং উপসংহারের নির্মম উৎপীড়ন তার লাঞ্ছনা—এদের মধ্যে কোন ভাবগত সঙ্গতি নেই। ‘আলাে ও ছায়া’র কাহিনী অবিশ্বাস্য, চরিত্রগুলাের অস্বাভাবিকতা কাহিনীর ভাবগত পটভূমি, আতিশয্যমূলক কাল্পনিকতা প্রভৃতি সত্ত্বেও এখানে শরৎচন্দ্রের পরিণত জীবনদৃষ্টির কিছু পরিচয় মেলে। ‘স্বামী’ গল্পটিতে নিজের চরিত্র-মাহাত্ম্যে স্বামী কর্তৃক পরপুরুষে আসক্ত স্ত্রীর চিত্ত অধিকারে অবৈধ প্রেমের ওপর দাম্পত্যপ্রেমের জয় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
‘দর্পচূর্ণ’ (১৯১৫), ‘কাশীনাথ’ (১৯১৭), ‘নববিধান’ প্রভৃতি রচনাগুলোতে ‘দাম্পত্য বিরােধ ও মনােমালিন্যের কাহিনী পাই। কাশীনাথের স্বভাবগত ঔদাসীন্য ও সংসার-বিমুখতা এবং তার স্ত্রী কমলার অভিমানের চিত্রণ আকর্ষণীয় হলেও তাদের দাম্পত্য-সম্পর্কের সংঘর্ষ ও তার ক্রম পরিণতি খুব সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে বলে মনে হয় না।
‘দর্পচূর্ণ’ গল্পটিতে দারিদ্র্যের অভাব-অনটনের পটভূমিতে শাস্ত প্রকৃতি অথচ আত্মমর্যাদায় দৃঢ়, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নরেন তার বড়লােক ঘরের মেয়ে, পিতৃগৃহের ঐশ্বর্যচেতনায় অসহিষ্ণুতায় যথেচ্ছ ব্যয়ের অহংকারপ্রমত্ততায় উদ্ধত, স্ত্রী ইন্দুর সংঘর্ষ ও হারাবার পর তার চৈতন্যোদয়ের চিত্ৰণ উপভােগ্য। এতে চরিত্রের কোনও উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য স্ফুরিত না হলেও এটি নাটকের ঘাত-প্রতিঘাত ও মানস পরিবর্তন প্রতিক্রিয়ার সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে প্রাণবান হয়েছে।
‘নববিধান’-এ সাহেবী জীবনযাত্রায় অভ্যন্ত শৈলেশ এবং তার বিদেশী ভাবাপন্ন পারিবারিক পরিবেশের সঙ্গে তার প্রথমা স্ত্রী, প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত পরিবারের কন্যা উষার জীবনের বিরােধ ও অসঙ্গতি এবং অবশেষে নানা অভিজ্ঞতায়, টানাপােড়েনে পরিবর্তিত শৈলেশের সঙ্গে তার পুনর্মিলন রূপায়িত হয়েছে। এই কাহিনীটাতেও মানবজীবনের কোনও গভীর সত্য কিংবা মানবচরিত্রের কোনও উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যের উদ্ভাস পাওয়া যায় না।
‘পথনির্দেশ’-এ (১৯১৪) দেখি ধর্মমতের ব্যবধানের জন্য ব্রাহ্ম গুণিন ও হেমনলিনী পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেও হিন্দুত্ব-সংস্কারে আজন্ম অভ্যস্ত হেমনলিনীর মতাে সুলােচনা তাদের সম্পর্ক-বিষয়ে সন্দেহের বিষবাষ্প অনুভব করে ও তার হিন্দু পরিবারে কন্যার বিবাহের ইচ্ছা জেনে উদারহৃদয় সংযতরুচির গুণিন হেমের বিবাহ দিয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর হেমনলিনী আবার গুণিনের কাছে এসেছে এবং তারা এক জটিল, দুঃসহ অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। গুণিন তার স্বভাবগত আত্মদমনের ক্ষমতা হারায় নি, কিন্তু নলিনীর সমগ্র হৃদয় এই দ্বন্দ্বের তীব্রতায় মথিত হয়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী গুণিনের কাছে সে আর আত্মসংবরণ করতে পারেনি। এই অন্তর্বিরােধের চিত্রণে শরৎচন্দ্রের বিশ্লেষণ-নৈপুণ্যের উজ্জল পরিচয় মেলে। ‘ছবি’ রচনাটিতে ব্রহ্মদেশের নায়ক ও নায়িকা বাথিন ও মা-শােয়ের সম্পর্কের বিরােধ ও তার অবসান চিত্রিত- বাথিনের ঔদাসীন্যে, উপেক্ষায় মা-শােয়ের ক্ষোভ, তার প্রতি বাথিনের অন্তরগঢ় প্রেমের ইঙ্গিতময় প্রকাশ, তার জীবনের চরম সংকটমুহূর্ত্তে নিজের প্রেমের শক্তিতে, সেবাপরায়ণতায় মা-শােয়ের বাথিনের হৃদয় জয়—এই প্রেমচিত্রণ পাঠককে আকৃষ্ট করে। ‘ছবি’তে উন্নত শিল্পকলার পরিচিতি না মিললেও সামাজিক রীতি-নীতি ও প্রণয়-প্রকাশ-পদ্ধতির পার্থক্য সত্ত্বেও ব্রহ্মদেশের রমণী যে বাঙালিনীদের সহােদরা, প্রেমরহস্যের এই সার্বভৌম পরিচয়টিই কাহিনীর মধ্যে মুদ্রিত হয়েছে বলে তার একটা বিশেষ মূল্য আছে।
বিবাহাস্তিক কাহিনী সংবলিত হলেও ‘অনুরাধা’য় (১৯৩৪) প্রেমের কোনও সমস্যা চিত্রিত হয়নি। প্রধানত মাতৃহীন বালকপুত্র কুমার এবং কিছুটা পরিমাণে নিজের বাড়ির মেয়েদের আত্মকেন্দ্রিকতা ও শিক্ষিতা নারীদের সংসার-সম্বন্ধে ঔদাসীন্যের পরিচয়ের জন্য বিলাতপ্রত্যাগত, নিজের আভিজাত্য-সম্বন্ধে সচেতন জমিদারপুত্র বিজয় তার ফেরারী কর্মচারীর বূপহীনা, সহায়সম্পন্নবঞ্চিতা কন্যা অনুরাধাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছে। অনুরাধার চরিত্রচিত্ৰণই রচনাটির সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য দিক। হিন্দুসমাজে অতি প্রচলিত সতী-শক্তির বিপরীত দিক ‘সতী’তে (১৯৩৪) রূপায়িত। হরিশের স্ত্রী নির্মলা যেমন নিজে পাতিবরত্যের শক্তিতে স্বামীকে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করেছে, তেমনি স্বামীর প্রতি ইতর সন্দেহপরায়ণতায়,তার প্রত্যেকটি পদক্ষেপের ওপর সতর্ক প্রহরীর দৃষ্টি রেখে তীক্ষ্ণ শ্লেষবাণের জ্বালায় তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
‘আঁধারে আলাে’ এবং ‘বিলাসী’তে সমাজবিরােধী প্রেমের বিভিন্ন দিক চিত্রিত হয়েছে। ‘আঁধারে আলাের নায়ক সত্যেন পতিতা নারী বিজলীর প্রকৃত পরিচয় বুঝতে না পেরে তাকে প্রেমিকারুপে লাভ করতে চেয়েছে, অন্যদিকে বিজলীও ছলনার জাল বিস্তার করে তার অনভিজ্ঞ মনের আবেগ-সারল্য নিয়ে কৌতুক করতে থাকে। অবশেষে একদিন বাঈজী বিজলীর প্রকৃত স্বরূপ সত্যেনের নিকট উঘাটিত হয় ও এই পতিতা রমণী তার বিলাসসঙ্গীদের সম্মুখেই সত্যেনের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে ব্যঙ্গ-পরিহাস করে। তখন সত্যেনের আহত আত্মমর্যাদাবোেধ বিজলীকে আঘাত করে, তার সম্বন্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে সে বিদায় নেয়। অতঃপর সত্যেন যেন নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্যেই বিয়ে করে এবং নিজের পুত্রের অন্নপ্রাশনে বিজলীকে নাচ-গানের বায়না দিয়ে পূর্বের অপমানের প্রতিশােধ দিতে চায়। আঘাতের বেদনার মধ্য দিয়ে সত্যেনের চরিত্রগৌরবমুগ্ধ ও নিজের আচরণে অনুতপ্ত বিজলী তার কলঙ্কিত জীবনের বৃত্তিকে পরিত্যাগ করেছে ও সত্যেনের ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছে। সত্যেনের বাড়িতে তার স্ত্রীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে ও তাকে দিদি সম্বােধন করে তার নিকট ঋণ স্বীকার করেছে। সত্যেনের নির্মল দাম্পত্যপ্রেম এই কলুষিত উৎস থেকে সঞ্জাত। বিষ থেকেই অমৃতের উদ্ভব হয়েছে; বিষের জ্বালা বিজলী ভােগ করেছে, কিন্তু অমৃতের আস্বাদনে সত্যেন্দ্রপত্নীর জীবন ধন্য হয়েছে।
‘বিলাসী’তে সমাজের নীচতার পটভূমিতে অসামাজিক প্রেম সেই প্রেমঘটিত অসবর্ণ বিবাহে এবং নায়িকার শােচনীয় জীবনাবসানের চিত্র পাই। ব্রাহ্মণ সন্তান মৃত্যুঞ্জয়ের কঠিন পীড়ার সময় বেদের মেয়ে বিলাসী তাকে প্রাণ ঢেলে সেবাশুশ্রুষা করে তার হৃদয় জয় করে, তারা দাম্পত্য সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়। সংস্কারান্ধ সমাজ চরম হীনতায় বিলাসীকে লাঞ্ছিত করে। মৃত্যুঞ্জয়ের সর্পদংশনে মৃত্যু এবং শােচনীয় দুর্ঘটনার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বিলাসীর অনুগমন—তাদের জীবনাবসানকে পাপের নিশ্চিত প্রমাণরূপে গ্রহণ করে সমাজনেতারা উল্লসিত হন।
শরৎচন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসগুলাের মত এই গল্পগুলােতেও নারীর ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল মহিমাদীপ্ত রূপ অঙ্কিত হয়েছে। বিন্দু, নারায়ণী, শৈলজা,উষা, হেমনলিনী, বিলাসী প্রভৃতি চরিত্রগুলাের মধ্যে শরৎচন্দ্রের শিল্প্রতিভার বিশেষ মৌলিক গুণ নারী চরিত্র-চিত্রণের অসামান্য দক্ষতার পরিচয় মেলে। ইচ্ছাশক্তির প্রবলতা, সেবা করার প্রচণ্ড জিদ, স্বাধীনচিত্ততার আতিশয্যে পুরুষের সহিত সমকক্ষতার স্পর্ধা, সত্যভাষণে দৃপ্ত সাহসিকতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যে শরৎচন্দ্রের গল্পের নারীচরিত্রগুলাে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তার ভাষারও একটা নিজস্ব মাধুর্য ও সৌন্দর্য তার গল্পগুলাের আকর্ষণীয়তাকে বৃদ্ধি করে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের কাব্যব্যঞ্জনার বিচিত্র ঐশ্বর্য অবশ্যই শরৎচন্দ্রের রচনায় মেলে না, কিন্তু তার ভাষাভঙ্গির স্বকীয়তাও কম নয়। তার ভাষার কথাভঙ্গিসুলভ সহজ বৈশিষ্ট্য শিল্পীর আবেগতপ্ত ব্যক্তিহৃদয় কণ্ঠস্বরটিকে আমরা যেন স্পষ্ট শুনতে পাই, সেই অনলংকৃত সাবলীল ভাষা প্রকাশের প্রত্যক্ষতা আমাদের বুকে যেন দাগ কেটে যায়।
Leave a comment