অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বংশী ও বিরহ খণ্ডের চিত্রিত বড়ায়ি চরিত্র বিশ্লেষণ কর

উত্তর : শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে অন্যতম উল্লেখ্য চরিত্র হচ্ছে বড়ায়ি এবং এ চরিত্র পরিকল্পনায় কবি বড়ু চণ্ডীদাসের কৃতিত্ব অবশ্য স্মরণীয়। বড়ায়ি টাইপ চরিত্র। হয়তো দামোদর গুপ্তের ‘কুট্টিনীমতন’, বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ বা জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ‘বর্ণনরত্নাকারের কুট্টিনী চরিত্রের আদর্শে কবি বড়ায়ি চরিত্র অঙ্কন করেছেন। তবে বড়ায়িকে শুধু কুট্টিনী বলে এক কথায় চরিত্রালোচনা শেষ করা যায় না। তার বাহ্যিক আকার প্রকার কামশাস্ত্রোক্ত দূতী বা কুট্টিনীর অনুরূপ হলেও সে মানব সম্পর্কে বর্জিত নয়। সমগ্র কাব্যে তার মানবিক রূপটি আমাদের অধিকতর মুগ্ধ করে। সমালোচক ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ভাষায়, “বড়ায়ি আমাদের সংসার জীবনের একটি সুন্দর রূপময় চরিত্র। আমাদের সমাজে ঠাকুমা দিদিমা বা দাদি নানি শ্রেণির চরিত্র এটি।” (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: কাব্য পাঠের ভূমিকা)

বড়ায়ি চরিত্র সৃষ্টিতে কবির মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রচলিত পদাবলীতে রাধার যে সমস্ত সখীর উল্লেখ রয়েছে, বড়ায়ি তাদের সমপর্যায়ভুক্ত নয়। এ কাব্য বর্ষিয়তী বড়ায়ি দৌত্যকার্যে নিযুক্ত এবং সখীর ভূমিকা সেই গ্রহণ করেছে। বড়ায়ির ভূমিকা অনেকটা গুরু বা পথপ্রদর্শকের মতো। এ প্রসঙ্গে সমালোচক ক্ষেত্রগুপ্ত বলেছেন,

“বড়ায়ির ভূমিকা টাইপ জাতীয়। রসিকতায়, কূটবুদ্ধিতে, ছদ্ম অভিনয়ে, রাধাকৃষ্ণের কলহ ও বিলাস থেকে রহু দূরে অবস্থান, কিন্তু প্রয়োজনমতো অনুপ্রবেশ করে সন্ধি স্থাপনে সাহায্য করায় তার দূতী ভূমিকা সার্থক।” (প্রাচীন কাব্য সৌন্দর্য জিজ্ঞাসা ও নবমূল্যায়ন)

বড়ায়ির মধ্যস্থতা ভিন্ন রাধা এবং কৃষ্ণের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠা সম্ভব ছিল না। এ মিলন বা মধ্যস্থতায় বড়ায়ির কোনো স্বার্থ নেই। কৌতুক আর আনন্দই একমাত্র লক্ষ্য। কৃষ্ণের ঐশ্বরিক রূপ সম্বন্ধে সে সচেতন, কৃষ্ণের অবতারত্বে সে আস্থাবতী শুধু নয়, ভক্তিমতীও। অন্যদিকে, রাধার শুভাশুভের প্রশ্নে সে হৃদয়াবেগে মুক্ত। বড়ায়ির সাথে রাধার প্রাণের সম্পর্ক স্বার্থের নয়।

রাধার তত্ত্বাবধানের জন্য আইহনের মা পদুমার নিকট হতে বৃদ্ধা বড়ায়িকে আনিয়েছে। বড়ায়ির পরিচয় হলো সে পদুমার অর্থাৎ রাধার মায়ের পিসি। সুতরাং সে রাধার বড়ো আয়ি (বৃদ্ধা আর্থিকা) বা মাতামহী। বার্ধ্যক্যের ছাপ বড়ায়ির চেহারার মধ্যে সুস্পষ্ট। তার রূপ বর্ণনায় কবি যেন চরিত্রটির অন্তর পরিচয় উদঘাটিত করেছেন,

‘শ্বেত চামর সম কেশে।

কপাল ভাঙ্গিল দুঈ পাশে।

ভ্রূহি চুনরেখ যেহ্ন দেখি।

কোটর বাটুল দুঈ আখি।’

তার দাঁতগুলো দেখলে ভীতির সঞ্চার হয়। ঠোঁট দুটি বেশি পরিমাণে ঝুলে পড়েছে। চলতে গেলে ঘন ঘন কাশি হয়।

এ বড়ায়ির উপর দায়িত্ব পড়েছে রাধার রক্ষণাবেক্ষণের। রাধা ও অন্যান্য গোপীগণকে সাথে নিয়ে বড়ায়ি দধি দুগ্ধ বিক্রয় করতে প্রত্যহ মথুরায় যেত। দূতীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও স্নেহবশত সে রাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটাতে তৎপর হয়েছে। ‘তাম্বুল খণ্ড’ হতে ‘বানখণ্ড’ পর্যন্ত বড়ায়ি কৃষ্ণের পক্ষ অবলম্বন করে রাধাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করেছে। শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্যে যে শুধু আস্থাবান নয়, তাঁর সন্তোষ দ্বিধাই তো জীবনের পরম কাম্য- তাই বড়ায়ির কর্তব্য রাধাকে বার বার কৃষ্ণের প্রতি আকর্ষিত করা। কাজেই কৃষ্ণের কামাচার সূচক তাম্বুল ও পুষ্প এনে সে রাধাকে কৃষ্ণের সাথে মিলিত হতে অনুরোধ করেছে। রুষ্টা রাধা তাকে চপেটাঘাত করলে সে ক্ষুব্ধ হয়ে কৃষ্ণের কাছে গিয়ে সব কথা সবিস্তারে জ্ঞাপন করে এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কৃষ্ণকে পীড়াপীড়ি করে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে বড়ায়ির পরামর্শ ও প্ররোচনায় অধিকাংশ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ‘দানখণ্ডে’ তারই ষড়যন্ত্রে রাধা কৃষ্ণের কবলে পড়েছে। এখানে কবি বড়ু চণ্ডীদাস বড়ায়িকে ঠৈষ্ঠালি চতুর কুটিল কৌশলী বলে উল্লেখ করেছেন। নৌকাখণ্ডেও বড়ায়ি সুকৌশলে রাধাকে কৃষ্ণের কবলিভূত করে দিয়েছে। ‘বাণখণ্ডে’ও কৃষ্ণের সাথে ষড়যন্ত্র করে রাধাকে পুষ্পবাণে আহত করতে উপদেশ দিয়েছে।

তবে এ ‘বাণখণ্ড’ হতেই বড়ায়ি চরিত্রের ক্রম পরিবর্তন লক্ষিত হয়। এ পর্যন্ত যে মুখ্যত কৃষ্ণের সমর্থন করে আসছিল; কিন্তু ‘বাণখণ্ডে’ কৃষ্ণের শরের আঘাতে রাধা মূর্ছিত হয়ে পড়লে বড়ায়ি কৃষ্ণের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে তিরস্কার করে এবং রাধার প্রাণদানের ব্যবস্থা করে। এখানেই বড়ায়ি সাধারণ কূটনী চরিত্র হতে মানবিক মর্যাদা লাভ করে।

পরবর্তী ‘বংশী’ ও বিরহ’ খণ্ডে বড়ায়ি প্রধানত রাধার পক্ষ অবলম্বন করেছে। বিরহ ব্যাকুলা রাধাকৃষ্ণের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য বড়ায়ির শরণাপন্ন হয়েছে। রাধার মানসিক বিবর্তন বড়ায়ির চিত্তে বেখাপ্পা করেছে। যে কৃষ্ণকে রাধার কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেনি; তারই পরামর্শে রাধাকৃষ্ণের মোহন বাঁশী চুরি করে।

কাম শাস্ত্রোক্ত দূতীর আদর্শে অঙ্কিত হলেও বড়ায়ির প্রখর বুদ্ধি ও চাতুর্য আমাদের মুগ্ধ করে। ‘বংশী’ খণ্ডে বড়ায়ি রাধার পক্ষ অবলম্বন করে কৃষ্ণকে ছলনা করেছে। রাধার ১৬০০- গোপিনীর সামনে কৃষ্ণকে জোড়হাত করাতে বাধ্য করেছে। রাধার কাছ থেকে বাঁশিটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কৃষ্ণ বড়ায়িকে বার বার অনুরোধ করলে বড়ায়ি তাকে বলেছেন,

‘যোড়হাতে বুলিহ বচনে।

সুখী হইব রাধার মণে। ল কাহ্নাঞি॥

কেহ্নে তোওঁ কাজ না বুঝসি।

তড়ী কয়িলে না পাইবে বাঁশী।’ (বংশী, ৩৭)

অতঃপর বাঁশীর জন্য কৃষ্ণ ক্রন্দন শুরু করলে বড়ায়ি রাধাকে বাঁশী প্রত্যর্পণ করতে অনুরোধ করেছে:

‘বাঁশরী শোকেঁ চক্রপাণী।

এঁবে তাক দেহ আনী।

যোড়হাথ কৈল দেব কাহ্নে।

এবে তাক বাঁশী দেহ দাণে॥’ (বংশী, ৩৮)

বার্ধক্যের ভারে জর্জরিতা বড়ায়ি। (বংশী, ৩৮) রাধাকে বার বার বলেছে,

মোওঁ ত সুন্দরি রাধা আতি বড় বুঢ়ী ল

বেড়ায়িতে মোতে বল নাহী। (বিরহ, ৯)

তবু বড়ায়ির কর্মতৎপরতার অভাব নেই। বিরহিণী রাধার বেদনা তার চিত্তে ব্যথা ও করুণার সৃষ্টি করেছে। বলহীনা হয়েও রাধাকৃষ্ণের মিলনে তার সক্রিয়তা লক্ষ করার মতো। একদিন রাধার কাছে গিয়ে সে কৃষ্ণের বিরহ ব্যাকুলতার কথা বলেছিল, আজ কৃষ্ণের কাছে সে বিরহিণী রাধার অবস্থা বর্ণনা করেছে এভাবে,

“তোহ্মাক চিন্তে রাধা নিশ্চল মনে।

খনে হাসে খনে রোষে।

খনে কাঁপএ তরাসে।

খনে কান্দে রাধা খনে করএ বিলাপে।” (বিরহ, ৪৮)

রাধার দুঃখে দুঃখিত হয়ে বড়ায়ি কৃষ্ণকে মথুরা হতে বৃন্দাবনে আনবার জন্য বহু চেষ্টা করেছে। রাধার প্রতি অনাসক্ত কৃষ্ণকে বড়ায়ি মৃদু তিরস্কার করে বলেছে,

“ভাত না খাইলে তবে তাহার কারণে

শাকর খাইতে তোক্ষে আদরাহ কেহ্নে৷৷

ভাঁগিল সোনার ঘট যুড়ীবাক পারী।

উত্তম জনের নেহা তেহেন মুরারী। (বিরহ , ৬৮)

কৃষ্ণ যখন রাধাকে পরিত্যাগ করে মথুরায় চলে যায়, তখন কৃষ্ণের প্রতি বড়ায়ির এ উক্তি যেন অন্যায়কারীর প্রতি ভর্ৎসনা। বড়ায়ি চরিত্রে রাধার প্রতি এ সমবেদনা তাকে অধিকতর প্রেমময়ী ও স্নেহময়ী করে তুলেছে।

মানব দরদী কবি বড়ায়িকে যত ভক্তিভাবেই ভাবিত করুন না কেন, সংসার বুদ্ধি কোনো কোনো জায়গায় তাকে মানবিক রূপ দান করেছে। সব কাজই সে রাধাকে গোপনে সারতে বলেছে। রাধাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছে,

“করিব আপণ কাজ না জাণিব আনে৷৷

বড় কাজ করিআঁ না করী জানাজাণী।

চিরকাল সুখ ভুঞ্জে সেসি সিআণী।” (বিরহ, ৬২)

অবশ্য মধ্যে মধ্যে বড়ায়ি নাতিনী রাধাকেও উর্ৎসনা করেছেন,

কাহ্নের তাম্বুল রাধা দিলোঁ তার হাথে।

সে তাম্বুল রাধা তোঁ ভাগিলি মোর মাথে।

এবেঁ ঘুসঘুসাআঁ পোড়ে তোর মন।

পোটলী বান্ধিআঁ রাখ নহুলী যৌবন। (বিরহ, ৪)

কখনো বা বলেছে,

‘নিলজী নিকুপে থাক কথাঁ গিআঁ পাইব তাক

পাপমতী না বাসসি লাজো।’ (বিরহ, ৬৬)

কৃষ্ণ ও রাধার অবৈধ মিলনের জন্য মাতামহ স্থানীয়া বৃদ্ধা বড়ায়ির দৌত্যকার্য সামাজিক পটভূমিকায় স্বীকৃত না হলেও এটা বলতেই হবে যে কবি এ চরিত্র চিত্রণে প্রশংসনীয় চাতুর্য দেখিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে যেটুকু নাট্যরস জমেছে, তার মূলে রয়েছে বড়ায়ির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে সমালোচক অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,

“বলিতে গেলে রাধা ও কৃষ্ণের ঘটনা বড়াইয়ের সাহায্য না পাইলে অগ্রসর হইতেই পারিত না। ইহার নাটকীয় অংশটুকু বড়াইয়ের দ্বারা সমাধা হইয়াছে। এ ‘বড়াই বুড়ী’র ‘আদর্শ পরবর্তীকালেও যাত্রা পাঁচালীতে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিল। বাংলার পদাবলী ও অন্যান্য লৌকিক কৃষ্ণায়নক্লাব্যে বড়াই চরিত্রটি দীর্ঘকাল অস্তিত্ব রক্ষা করিয়াছে। ১৮শ-১৯শ শতাব্দীতে কৃষ্ণযাত্রাতে বড়াই চরিত্র না থাকিলে চলিত না।” (শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চরিত্র চিত্রা ও কাব্যস্বরূপ)

সুতরাং বলা যায় যে, বড়ায়ি চরিত্রের আবেদন সমগ্র রসিক সমাজে। বড় চণ্ডীদাস তাকে কূটনী হিসেবে শুরু করলেও তাকে ভারতচন্দ্রের হীরা মালিনীর সাথে তুলনা করা কুশলা দূতী সমগ্র কাব্য পাঠে বুঝা যায় বড়ায়ি চরিত্রটিকে কবি কপট কুশলা দূতী চরিত্ররূপে শুরু করেছিলেন, কিন্তু স্নেহ প্রীতি মমতায় পরিপূর্ণ একটি মানবীয় চরিত্ররূপে শেষ করেছেন। এখানেই বড়ায়ি চরিত্রের সার্থকতা।