ভূমিকাঃ মানুষ তার মনের ভাবকে অন্যের নিকট প্রকাশ করার জন্য কথা বলে। এ কথাগুলো হলো কতিপয় অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি। আর এ অর্থপূর্ণ ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টিকে শব্দ বলে। শব্দ ভাষার অন্যতম মৌলিক উপাদান। বাংলা ভাষা একটি সমৃদ্ধ ও আন্তজার্তিক স্বীকৃত ভাষা। হাজার বছরের নানা পরিবর্তন বিবর্তনের মাধ্যমে নানা ভাষী ও জাতির সংস্পর্শে এ ভাষার শব্দভাণ্ডার হয়েছে সমৃদ্ধ, উন্নত ও পরিপূর্ণ।
শব্দের সংজ্ঞাঃ
১. সাধারণ কথায় মানুষের মুখনিঃসৃত এক বা একাধিক ধ্বনি বা বর্ণ মিলিত হয়ে যদি একটি অর্থ প্রকাশ করে, তবে তাকে শব্দ বলে। যেমন- কলম, আমরা, মা, গোলাপ ইত্যাদি।
২. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টিকে শব্দ বলে।”
৩. ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “অর্থবোধক ধ্বনিকে শব্দ (word) বলে। কোনো বিশেষ সমাজের নরনারীর কাছে যে ধ্বনির স্পষ্ট অর্থ আছে, সেই অর্থবোধক ধ্বনিই হচ্ছে সেই সমাজের নরনারীর ভাষায় শব্দ।”
৪. অশোক মুখোপাধ্যায়ের মতে, “এক বা একাধিক ধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি অর্থবোধক ও উচ্চারণযোগ্য একককে শব্দ বলা হয়।”
বাংলা শব্দভাণ্ডারের সমৃদ্ধির ইতিহাসঃ যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যত বেশি সমৃদ্ধ, সে ভাষা তত উন্নত। ড. হুমায়ুন আজাদের মতে, “যে রাজকোষে যত বেশি মুদ্রা, সে রাজকোষ তত বেশি ধনাঢ্য। ভাষার রাজকোষ ভরে থাকে শব্দে । সোনালি শিকির মতো শব্দ, রুপোলি আধুলির মতো শব্দ, ঝলমল করে চকচক করে। যে ভাষার ভাণ্ডারে যত বেশি শব্দ সে ভাষা তত বেশি ধনী।”
বাংলা ভাষা একটি শব্দসমৃদ্ধ ভাষা। হাজার বছরের নানা পরিবর্তন বিবর্তনের মাঝে অজস্র শব্দ জমেছে বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডারে। নদীর স্রোতের ন্যায় প্রতিটি সজীব ভাষাও বারবার তার ধারা বদল করে। পুরনো খাত ছেড়ে নতুন পথে বয়ে চলে। যুগে যুগে ভাষার মধ্য থেকে আবার অনেক শব্দ হারিয়ে যায়, জন্ম হয় নতুন শব্দ। শব্দ সমৃদ্ধির এ ইতিহাস খুবই বিচিত্র, চিত্রাকর্ষক। এর পেছনে লুকানো থাকে অতীত সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বস্তু ব্যবহারের নানান গোপন তথ্য।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচীন ভারতীয় আর্য শাখার ক্রম বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা বর্তমান রূপ লাভ করেছে। তাই এ ভাষায় সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি দেশি বিদেশি অসংখ্য শব্দের উপস্থিতি বিদ্যমান। প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষার অঙ্গরূপে স্থান করে নেয়। ১৩শ শতকে বঙ্গে মুসলিম শাসনের পর থেকে আরবি, ফারসি ও তুর্কি শব্দের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৬শ শতকে বঙ্গঅঞ্চলে পর্তুগিজদের আনীত শব্দাবলি বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। ১৭শ শতকে এ অঞ্চলে বিদেশিদের আগমন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজি শব্দের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৮শ/১৯শ শতকে ইংরেজদের শাসনের ফলে বাংলা ভাষায় অসংখ্য ইংরেজি শব্দ প্রবেশ করে। এভাবে বর্জন নয় গ্রহণের নীতিতে, মৌচাকে মধু সঞ্চয়ের পদ্ধতিতে বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দসম্ভার সংগ্রহ করে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছে।
অতএব ভাষা তার আপন গতিতে চলে এবং কালক্রমে বিবর্তিত হয়।
Leave a comment