অর্থবােধক ধ্বনিসমষ্টিকে বলা হয় ‘শব্দ’। অতএব অর্থ বােঝানাের জন্যই শব্দের সৃষ্টি, কিন্তু এমন কোন শব্দ খুঁজে পাওয়া মুস্কিল, চিরকাল যার একটিমাত্র অর্থই প্রচলিত রয়েছে। দেশকালপাত্রের প্রেক্ষাপটে, শব্দের অর্থ নানাভাবে পরিবর্তিত হয়—এই সহজ সত্যটি আর স্বীকৃতির অপেক্ষা রাখে না— ‘পা’ ধাতুর সঙ্গে বিভিন্ন প্রত্যয় যােগে নিষ্পন্ন হাতে পারে তিনটি শব্দ ‘পতি, পাতা, পিতা’—এই তিনটি শব্দেরই মূল অর্থ ‘যিনি পালন করেন অথচ তিনটি শব্দের ব্যবহারিক অর্থে কত পার্থক্য।

শব্দের অর্থ কেন পরিবর্তিত হয়, এককথায় তার কোন উত্তর দেওয়া যায় না। নানা কারণেই শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে থাকে। এই কারণের সংখ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব হলেও স্থূল এবং প্রধান কারণগুলিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা সম্ভবপর। বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানী শব্দার্থ-পরিবর্তনের কারণগুলিকে বিশ্লেষণ করে তাদের তিনটি প্রধান শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছেন

  • (ক) ভিন্ন পারিবেশিক কারণ, 

  • (খ) মনােবিষয়ক কারণ, এবং 

  • (গ) আলঙ্কারিক কারণ।

ভিন্ন পারিবেশিক কারণ: কোন শব্দ যে অঞ্চলে যে অর্থে সৃষ্টি হয়েছিল, পরিবেশ পরিবর্তনে তার অর্থের পরিবর্তন হতে পারে—তাই শব্দের এ জাতীয় অর্থ পরিবর্তনকে পারিবেশিক কারণ-জাত অর্থ পরিবর্তন বলে মনে করা হয়।

  • স্থান কালের পরিবর্তনে শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে। ফারসীতে ‘দরিয়া’ শব্দের অর্থ ‘নদী’; ‘মুর্গ’ অর্থ—যে কোন পাখি; কিন্তু বাঙলায় এ দুটি শব্দের অর্থ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ‘সমুদ্র’ ও ‘কুক্কুট’।

  • কালের পরিবর্তনেও শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হতে পারে—‘উষ্ট্র’ একসময় ‘আরণ্য বৃষ’ (Bison) বােঝাততা, এখন ‘উট’ (Camel)।

  • ধর্ম-সমাজ-রাষ্ট্র জাতি প্রভৃতির কালানুক্রমিক পরিবর্তনেও শব্দের প্রচলিত অর্থ ভিন্ন রূপ ধারণ করে। ‘Mother’ ও ‘Sister’ শব্দ দুটি এখন পারিবারিক গণ্ডী ছাড়িয়ে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করেছে। আবার ‘বুর্জোয়া, জোতদার, অসুর’ প্রভৃতি শব্দ মূলতঃ উক্তৃষ্ট, অর্থে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে হীন অর্থে ব্যবহৃত হয়।

  • একটি শব্দের একাধিক রূপ ভিন্ন অর্থে প্রযুক্ত হতে পারে।- ‘ভােজ’ ও ‘ভােজন’, ‘সৌভাগ্য’ ও ‘সােহাগ’ মূলতঃ একার্থক হলেও ব্যবহারিক অর্থে তাদের পার্থক্য রয়েছে; ‘বিবাহ, পরিণয়, পাণিগ্রহণ’ প্রভৃতি শব্দে যে বলপ্রয়ােগের ভাব ছিল তা এখন অন্তর্হিত।

  • পাত্র ও বস্তুর পরিবর্তনেও শব্দের অর্থান্তর ঘটে-‘Penna’ বা পালকের তৈরি লেখনী ছিল pen, এখন Steel-এরও pen হয়।

মনােবিষয়ক কারণঃ শব্দার্থ-পরিবর্তনে মনস্তত্বের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপর দুটি কারণের সঙ্গেও অনেক সময় এটি জড়িত থাকে।

  • নানাবিধ মানসিক সংস্কারের জন্য আমরা অশুভ-কুরুচিকর কিংবা ভীতিজনক শব্দ পরিহার করে ভিন্ন শব্দ দ্বারা ঐ বিষয়টি প্রকাশ করতে চেষ্টা করি।—‘চাউল বাড়ন্ত’, ‘শাখা শীতলানাে’ শব্দ দিয়ে আমরা অশুভ ভাবকে এড়িয়ে যাই; ‘বাথরুম পাওয়া’ বা ‘ঘাটে যাওয়া’ শব্দের সাহায্যে কুরুচিকর শব্দ পরিহার করি এবং ‘বসন্তে’র বদলে ‘মায়ের দয়া’, ‘সাপে’র পরিবর্তে ‘লতা’ ব্যবহার করে ভয়ের কারণটি বাদ দিতে চেষ্টা করি।

  • হীন কাজকে শােভনতা দানের উদ্দেশ্যেও আমরা মহৎ অর্থযুক্ত শব্দ ব্যবহার করে থাকি-রান্না করার পুরুষকে ‘মহারাজ/ঠাকুর’ বলি, কাজের মেয়েকে কন্যার মর্যাদা দিয়ে বলি ‘ঝি’। এখন ‘ঝি’ বল্লেও তারা অসন্তুষ্ট হয় বলে তাদের বলি ‘কাজের লােক’ কিংবা ‘মাসি’।

  • শব্দপ্রয়ােগে অসতর্কতা বা অজ্ঞতার জন্যও শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়। ‘পাষণ্ড’ শব্দের মূল অর্থ ছিল, ‘বৌদ্ধ সন্ন্যাসী’, কিন্তু অজ্ঞতাহেতু এখন ‘নিষ্ঠুর’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। বক্তার ইচ্ছানুসারেও শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়, যথা- ‘বারুণী’ শব্দের অর্থ ‘মদ্য’, মধুসূদন বরুণপত্নী ‘বরুণানী’-স্থলে ‘বারুণী’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।

  • শব্দকে সংক্ষিপ্ত করার ফলেও অর্থ-পরিবর্তন ঘটে।- ‘ক্ষৌরকর্ম’ থেকে সংক্ষেপে ‘কামানাে’, ‘দণ্ডবৎ প্রমাণ’ ‘দণ্ডবৎ’, ‘বাইসাইকেল’ থেকে ‘বাইক’।

  • সাদৃশ্য শব্দার্থ-পরিবর্তনে এক বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে। দেশের মধ্যে ‘মাথা’র স্থানই সর্বোচ্চ এবং মাথাই শ্রেষ্ঠ—এই বিবেচনায় যাবতীয় শ্রেষ্ঠত্ব বােঝাতেই ‘মাথা’ শব্দ প্রযুক্ত হয়।- ‘দইয়ের মাথা, গায়ের মাথা, মাথা খাওয়া, মাথা ধরা, তেমাথা’ প্রভৃতি।

আলঙ্কারিক কারণ: মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি—অলঙ্কার দিয়ে কথা বলা। এই অলঙ্কার-আরােপের ফলে বাক্যের সৌন্দর্যই শুধু বৃদ্ধি পায় না, শব্দার্থেরও যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয়।

  • রূপকাদি অলঙ্কার ব্যবহারের ফলে শব্দের অর্থ এমনভাবে পরিবর্তিত হতে পারে যে মৌলিক অর্থের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে। গােরুর চোখের মতাে আকৃতি ছিল বাতায়নের, তাই নাম ছিল ‘গবাক্ষ’—কিন্তু এখন এর আকৃতি চৌকো। ‘বীণাবাদনে দক্ষ’ বলেই ‘প্রবীণ’, কিন্তু এই ‘বীণার’ সঙ্গে ‘প্রবীণতা’র কোন সম্পর্ক নেই।

  • উপমা-উৎপ্রেক্ষা-আদি অলঙ্কার বাক্যে এমনভাবে লুকিয়ে থাকে যে বােঝবার উপায় নেই, ফলে পরিবর্তিত অর্থের সঙ্গে এর সম্পর্কও বােঝা যায় না।- ‘বেলাভূমিকে অতিক্রান্ত’ অর্থে ‘উদ্বেল’, কিন্তু আমাদের হৃদয়ও উদ্বেল হয়।

  • ব্যষ্টির স্থলে সমষ্টি এবং সমষ্টির স্থলে ব্যকষ্টির প্রয়ােগেও অর্থ-পরিবর্তন ঘটে।- ‘লাল পানি’ মানে আর লাল রঙের যে কোন পানীয় নয়, একটি বিশেষ পানীয় অর্থাাৎ ‘মদ্য’। আবার ‘ভাত-কাপড়’ বলতে শুধু ভাত আর কাপড়ই বােঝায় না, যাবতীয় ভরণপােষণের ব্যবস্থাই বােঝায়।

  • নম্রতা প্রদর্শনের জন্যেও শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে।- দেবতার জন্য খাদ্য ‘ভােগ’, নিজের বাড়ি ‘গরীবখানা’।

  • বক্রোক্তির সাহায্যে দূষণীয় শব্দে ছদ্মবেশ পরিয়ে তার অর্থ পরিবর্তন করা হয়।- ‘হাতটান’, ‘শ্বশুরবাড়ি’ (জেলখানা), বা ‘শ্রীঘর’ বাস।